কমিকসের জাদুকর নারায়ণ দেবনাথ
মাঝে মাঝে ভাবি, বাঙালি কি হাসে? হাসেই তো; কারণ গোপাল ভাঁড়, বীরবল, নাসিরউদ্দিন হোজ্জা, জোলা, টুনটুনির মতো হাসির চরিত্র আছে বাঙালির জীবনে। এই সেদিন এক বন্ধুকে বললাম, হাসি তো দূরের কথা, কখনো কখনো মনে হয় বাঙালি কড়কড় করে তিন বেলা লোহা চিবিয়ে খায়।
এসব কথায় নিশ্চিত বাড়াবাড়ি আছে। তবু কেন যেন বাঙালির জীবন থেকে হাসি ফুরিয়ে গেছে। নয়তো সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছাকাছি একজনকেও আর পাওয়া গেল না কেন? হাসি পেতে চাও? তাহলে ফিরে যাও সেই এক সম্বলের কাছে—হুমায়ূন আহমেদ। আরা বাচ্চাদের হাসিঠাট্টার কথা যদি তোলা হয়, ওমা! এত হাসির কী আছে! বই পড়ো, জিপিএ ফাইভ পেতে হবে।
বাচ্চারা কি সেসব কথা শোনে? ঠিক ঠিক পাঠ্যবইয়ের তলায় লুকিয়ে বই পড়ে, কমিকস পড়ে। বাচ্চাদের জন্য কমিকস, কার্টুন এক ধরনের জাদু। কিন্তু এরকম জাদুকর বাঙালির ইতিহাসে খুব বেশি নেই। আর তাই একজনের নাম না নিয়ে বাঙালির উপায় নেই; তিনি নারায়ণ দেবনাথ।
সদ্য প্রয়াত এই কমিকস লেখকের বই পড়ে বড় হয়েছেন এমন বুড়ো বাঙালির অভাব নেই। অন্তত পশ্চিমবঙ্গে তো নেই-ই। এমনকি বাংলাদেশেও তার অজস্র পাঠক। নন্টে ফন্টে কিংবা বাঁটুলকে সবাই প্রায় ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো চেনে।
নারায়ণ দেবনাথ ড্রইংরুম আলোকিত করা চিত্রশিল্পী নন। তিনি কার্টুন আঁকতেন, বইয়ের প্রচ্ছদও অলংকরণ করতেন। এঁকেছেন কমিকস স্ট্রিপ। আর তাই দিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন শিশুকিশোর, তরুণ পাঠকের মনে। বড় পাঠকের বৈঠকখানা নয়, কোমল পাঠকের অন্দরমহল তিনি ভালোভাবেই গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।
শুরুটা হয়েছিল ষাটের দশকে। পাক-ভারত যুদ্ধ তখন। বাঁটুলকে চরিত্র করে এঁকেছিলেন ধারাবাহিক কমিকস। হাস্যকর কৌশল দিয়ে বাঁটুল ঘায়েল করতো পাকসেনাদের। ভারতীয় পাঠকরা মহাখুশি। সমরাস্ত্র দিয়ে আঘাত করার পাশাপাশি কার্টুনও হানতে থাকল দুরন্ত আঘাত। এতে করে হাস্যরস তো পাওয়া গেলই আলতোভাবে কার্টুন ও জাতীয়তাবাদের সম্পর্কও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। ভারতীয় বাঙালি পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে গেলেন নারায়ণ দেবনাথ।
নারায়ণ দেবনাথ ড্রইংরুম আলোকিত করা চিত্রশিল্পী নন। তিনি কার্টুন আঁকতেন, বইয়ের প্রচ্ছদও অলংকরণ করতেন। এঁকেছেন কমিকস স্ট্রিপ। আর তাই দিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন শিশুকিশোর, তরুণ পাঠকের মনে...
বাঁটুল দি গ্রেটে আটকে থাকেননি তিনি। অবশ্য তার আগেই ১৯৬২ সালে তার আঁকায় এসে গেছে হাঁদা ভোঁদা। চরিত্র হিসেবে এসেছে পটলচাঁদ ম্যাজিশিয়ান, নন্টে ফন্টে, খাঁদু, কেমিক্যাল দাদু, পেটুক মাস্টার বটুকলাল। চরিত্র হিসেবে এসেছে বাহাদুর বিড়াল। অনেকটা টম অ্যান্ড জেরির টমের মতো দেখতে কালো বিড়ালটি বহু রকম হাস্যকর ঘটনার জন্ম দেয়।
একবার বাহাদুরের পাহারায় সাপের ঝাঁপি রেখে খেতে গিয়েছেন সাপুড়ে। বাহাদুর বিন বাজিয়ে সাপটিকে নিয়ে খেলতে লাগল। পরের দৃশ্যে দেখা গেল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে সাপটির গায়ে গিঁট লেগে গেছে। বাহাদুরের ঝটপট জবাব, ‘আমি শুধু ওকে গিঁটনাট্যম শেখাতে চেষ্টা করছিলাম।’ ভরতনাট্যমের সঙ্গে মিলিয়ে গিঁটনাট্যম! নতুন শব্দ। শব্দের এই খেলা কৌতুকও কমিকের প্রাণ।
১৯৬২ সালে শুকতারা পত্রিকায় জায়গা করে নেয় নতুন চরিত্র হাঁদা ভোঁদা। বিখ্যাত লরেল ও হার্ডির অনুসরণে তৈরি করেছিলেন এ দুটি চরিত্র। একজন শুকনা মতো, আরেকজন মোটাসোটা। মজার সব কাণ্ডকারখানার জন্ম দেওয়াই তাদের কাজ। ১৯৬৯ সালে কিশোর ভারতী পত্রিকার জন্য নারায়ণ দেবনাথ আঁকতে শুরু করেন নন্টে ফন্টে। এরাও দুরন্ত। প্রায় ৫০ বছর ধরে সক্রিয় থেকেছে নন্টে ফন্টে। এর মাঝখানে তারা বড় হয়েছে, কলেজের হোস্টেলেও থাকতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু চঞ্চল কিশোরের মনকে নারায়ণ দেবনাথ অক্ষত রেখেছেন।
নারায়ণ দেবনাথের লেখা ও আঁকার বৈচিত্র্য ঈর্ষণীয়। পৌরাণিক গল্প, জাতক, কিংবদন্তী, ইতিহাস, অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি, বৈজ্ঞানিক কল্পগল্পকে স্থান দিয়েছেন লেখা ও আঁকার জমিনে। একই সঙ্গে এঁকেছেন দুর্গেশনন্দিনীর গল্প, বিবেকানন্দের জীবনচরিত।
নারায়ণ দেবনাথের প্রতিটি চরিত্র মজার। গল্পগুলোতে থাকে চমৎকার সব ঘটনা। বুদ্ধি ও হাসির ঝিলিক ঝট করে টান দেয় পাঠককে। আর কচি কচি পাঠকরাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর তাই বেশিক্ষণ লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া যায় না।
নারায়ণ দেবনাথের লেখা ও আঁকার বৈচিত্র্য ঈর্ষণীয়। পৌরাণিক গল্প, জাতক, কিংবদন্তী, ইতিহাস, অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি, বৈজ্ঞানিক কল্পগল্পকে স্থান দিয়েছেন লেখা ও আঁকার জমিনে। একই সঙ্গে এঁকেছেন দুর্গেশনন্দিনীর গল্প, বিবেকানন্দের জীবনচরিত। চাইলেই এই বৈচিত্র্য তৈরি করা যায় না। পড়ে নিতে হয় পাঠকের মন। নারায়ণ খুব মন দিয়ে পড়তে পারতেন।
যুগে যুগে নতুন শিশুকিশোররা এলেও তাদের মনের সঙ্গে নিজের মনের মিতালি পাতাতে পেরেছিলেন তিনি। এ কারণেই নব্বই পেরিয়েও কমিকের জগতে সেঞ্চুরি হাঁকাতে পেরেছেন। তবে অনুতাপের সঙ্গে এও বলতে হয় প্রাপ্য মর্যাদা ও ভালোবাসা বাঙালি তাকে দেয়নি। বাঙালির শিশুকিশোরের এই শৈশব সঙ্গীকে হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখাই হয়নি।
বেশকিছু সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় আমাদের। প্রথমত, কমিকস-কার্টুনের জনপ্রিয় বিষয়বস্তুকে আমরা আলোচনা যোগ্য মনে করি না; বিদ্যায়তনিক পরিসরে পাতে তোলার যোগ্য মনে করে না এইসব বিষয়বস্তুকে। দ্বিতীয়ত, কমিকস বা কার্টুনের জন্যে আমরা খুব বেশি পৃষ্ঠা বা স্থান বরাদ্দ করি না। তৃতীয়ত, আমরা মনেই করি, এগুলো সস্তা দরের জিনিস। অথচ কোন তারকা কোথায় খেলেন, খাবেন, খাচ্ছেন বা হানিমুনে যাবেন, যাচ্ছেন অথবা তার সম্ভাব্য শয্যা সঙ্গী কে হতে পারে, তার জন্য দেদারসে স্থান বরাদ্দ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, যাদের হাত দিয়ে বাঙালির কমিকসে হাতেখড়ি ও বোঝাপড়া সেই ব্রিটেন বা মার্কিন মুলুকে সিরিয়াস জ্ঞানচর্চা হয় কমিকস-কার্টুনের মাধ্যমে। বিশ্বাস না হয়, তো ঘেঁটে দেখুন, মডার্নিজম থেকে পোস্টমডার্নিজম, হেগেল, মার্কস, দেরিদা, ফুকো, এমনকি পর্নোগ্রাফির তত্ত্বচিন্তা উঠে আসছে কমিকের মাধ্যমে।
চিন্তা ও ভাবকে বোধগম্য করার মাধ্যম হিসেবে পাশ্চাত্য দুনিয়া বহু আগেই কমিকস বা কার্টুনকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। এ ধরনের সিরিয়াস কাজও করেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলা নিয়ে ১৯৬২ সালে এঁকেছিলেন ‘রবি-ছবি’। বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষায় বেরিয়েছিল এই কমিকস বই।
এত বড় কমিকস শিল্পী, অথচ তার লেখা ও আঁকায় প্রত্যক্ষ কোনো রাজনীতি নেই। পাক-ভারত যুদ্ধের বাঁটুল পর্বকে বাদ দিলে পুরো জীবনে রাজনীতি নির্ভর কমিকসের সংখ্যা প্রায় শূন্য। তবে কি তিনি শিশুর মনস্তত্ত্বকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন?
একটি জায়গায় এসে খানিকটা চমকাতে হয়; এত বড় কমিকস শিল্পী, অথচ তার লেখা ও আঁকায় প্রত্যক্ষ কোনো রাজনীতি নেই। পাক-ভারত যুদ্ধের বাঁটুল পর্বকে বাদ দিলে পুরো জীবনে রাজনীতি নির্ভর কমিকসের সংখ্যা প্রায় শূন্য। তবে কি তিনি শিশুর মনস্তত্ত্বকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন? সত্যিকার অর্থে অরাজনৈতিক বলে কিছু নেই। লৈঙ্গিক রাজনীতির জায়গা থেকে প্রশ্ন তো তোলাই যায়, এত বড় কমিকস লেখকের একটি প্রধান চরিত্রও নারী নয় কেন? মূলত বাঙালির শিশুসাহিত্যে মেয়েরা নেই, মেয়েবেলা নেই; যা আছে তা হলো ছেলেদের শৈশব।
খুব ছোটবেলায় দেখেছি ইত্তেফাকের পাতায় টারজান ছাপা হতো। বিচিত্রার পাতায় রনবী আঁকতেন টোকাই। দীর্ঘদিন প্রথম আলো ছেপেছে বেসিক আলী। পত্রিকার পাতায় হরহামেশা কার্টুন ক্যারিকেচার চোখে পড়ত। আশির দশকে ক্যারিকেচারের জনপ্রিয় চরিত্র ছিলেন সামরিক রাষ্ট্রপতি এরশাদ। তার মানে, ফ্যাসিবাদী মুহূর্তেও কার্টুন আঁকা যেত। কিন্তু একালে?
কার্টুনিস্টকে জেলে ঢুকানো হয়। বায়তুল মোকাররম মসজিদে গিয়ে ক্ষমা চাইতে হয় পত্রিকার সম্পাদককে। হিসেব করে কড়ায় গণ্ডায় মেপে আঁকতে হয়। এত হিসেবে করে কোনো শিল্পীই আঁকতে পারেন না। কলমের মুখ থেকে আঁকার বদলে স্তব্ধতা নেমে আসে। এমন বাস্তবতায় কমিকস-কার্টুন কী বের হবে? মনে মনে ভাবছি, নারায়ণ দেবনাথের মতো এক জাদুকর তো গেলেন। অন্য জাদুকররা কে কোথায়?
সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়