জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের চরিত্র!
শিক্ষিত লোক যখন অশিক্ষিত হয়, তখন খুব বেশি রকমের হয়। সেই অশিক্ষিতকে কিছুতেই শিক্ষিত করা যায় না। কেননা, শিক্ষার বোধটি তার মধ্যে তৈরি হয়নি। সার্টিফিকেট জুটেছে। ডিগ্রি হয়েছে। হতে পারে সেটা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি। হয়তো সেটির জোরে বড় কোনো চাকরিও জুটেছে। আর যদি রাজনৈতিক তকমা থাকে তবে তো ‘সোনায়-সোহাগা’।
পদ-পদবী, মাইনে সব মিলে দারুণ ব্যাপার-স্যাপার। কিন্তু সেই অশিক্ষিত মূর্খটি কিন্তু অশিক্ষিতই থেকে গেল, যতই ডিগ্রি অর্জন করুক না কেন। তার মানসিকতার কোনো শ্রেণি উত্তরণ ঘটেনি। ফলে সে ব্যক্তি সচিব কি সম্পাদক, অধ্যাপক কি আইনজীবী, ব্যাংকার কি ব্যবসায়ী- জিনিস একই। ব্যক্তি হিসেবে চিন্তার দিক থেকে সে পড়ে আছে কুয়োর তলানিতেই।
গত ক’দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শাবিপ্রবির উপাচার্যের একটি অডিও এবং বক্তব্য ভেসে বেড়াচ্ছে। বাজে জিনিস সহজেই ভাইরাল হয়, ফলে ‘জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের সহজে বউ হিসেবে নিতে চায় না, সারারাত এরা ঘুরাঘুরি করে’ উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের এই বক্তব্য এখন আলোচনায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো উপাচার্যের মন্তব্য, বক্তব্যের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, যৌক্তকতার চেয়ে আরও আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের চরিত্র’।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা ভালো? নাকি মন্দ? এমন মন্তব্য আর আলোচনাও চলছে ঢালাওভাবে। একধরনের কুৎসিত আগ্রহ আর অশ্লীল কৌতূহল তৈরি হয়েছে বহু পুরুষদের মনের ভেতর।
শাবিপ্রবি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদের সঙ্গে অন্যান্য মূর্খদের খুব বেশি পার্থক্য নেই। হয়তো ধাচ বা ধরনে দূরত্ব থাকলেও মৌলিকত্বে তারা একই। বিশ্ববিদ্যালয় কী মেয়েদের সতীত্বের সার্টিফিকেট দেওয়ার জায়গা? নাকি ম্যারেজ মিডিয়া? তবে কেন বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ঘটক পাখি ভাই’ হয়ে দায়িত্ব নিতে হবে? কিংবা মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা কেবল বিয়ের জন্য? ভালো বিয়ের আশা নিয়েই তারা এখানে ভর্তি হয়েছে, এ অমূলক ধারণা কে দিয়েছে তাদের?
আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে, উড়াল সেতু-পাতাল টানেল আরও কত কী! কিন্তু মানসিকতার কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না, উন্নতি ঘটছে না। কেবল স্থাপনা হচ্ছে, কাঠামোগতভাবে কিন্তু কোনো মানসিক উন্নয়ন ঘটছে না। সমাজে লুণ্ঠন, লুটপাট বাড়ছে। ভোগবাদিতা সীমাহীন মাত্রায় পৌঁছে গেছে।
ফলে উড়াল সেতু বা উচ্চ ভবনের মতো বড় উঁচু পদে গিয়েও একজন নেতা বা উপাচার্যের চিন্তা জুতার তলানিতেই থেকে যাচ্ছে।
একজন উপাচার্য নিজেই বলুন আর যত বড় ছাত্রনেতার বরাত দিয়েই বলুন, তিনি যে চরম অশ্লীল মন্তব্য করেছেন সেটি বোঝার বোধও তাদের নেই সম্ভবত।
তিনি বা তার সঙ্গীরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের বিয়ের ইজারা নিয়েছেন? কে দিয়েছে তাদের এই দায়িত্ব? তাহলে মেয়েরা কী করলে, আর কী না করলে, বিয়ে হবে কি হবে না তা নিয়ে তিনি ও তার সঙ্গীদের মাথা ব্যথা কেন?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সম্পর্কে যে ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে আমি মনে করি তাতে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের অসম্মান ও শ্লীলতাহানি করা হয়েছে। মেয়েদের সম্পর্কে আমাদের যে অসুস্থ চিন্তাচেতনা, মানসিকতা তাতে আরও জল ঢালা হয়েছে।
আমি নিজে লেখাপড়া করেছি দেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার ন্যূনতম অভিজ্ঞতা থাকলে কোনো লোক এমন মন্তব্য করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যে বয়স, সে বয়সে কাউকে ভালো লাগা বা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া খুব স্বাভাবিক। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রেমের ধারণায় হয়তো নানা মাত্রা যোগ হয়। কিন্তু এ বয়সের প্রেম বা সম্পর্ক নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য করা রীতিমতো অশ্লীল। মেয়ে বা ছেলে কোনো শিক্ষার্থীই এখানে সারারাত ঘোরাফেরা করে না। করতে পারেও না।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এই কথিত ছাত্রনেতারাই নষ্ট করেছে। নিজেদের বাণিজ্যের হাট বানিয়েছে নেহাত উপার্জনের স্বার্থে। সঙ্গে যোগ হয়েছে কথিত উপাচার্যরা যাদের হয়তো দলীয় ক্যাডার হওয়া ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা নেই। তাদের কাছ থেকে বোধ বিবেচনার কতটুকুইবা আশা করা যায়!
জব্বার হোসেন ।। সম্পাদক, আজ সারাবেলা