সাংবাদিকতায় নারীর চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা
১
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রথম মাসে বসে এই শিরোনামে আমাকে একটি লেখা লিখতে হচ্ছে, এটাই হচ্ছে সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকতার বাস্তবতা। অর্থাৎ সাংবাদিকতা এখন সকল দেশে সর্বোতভাবেই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, তা নারী কিংবা পুরুষ সাংবাদিকতা বলে আলাদা করে নয়, সার্বিকভাবেই। এমতাবস্থায়, স্বাভাবিক ভাবেই একথা বোধগম্য যে, নারীর ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের এবং আরও ভয়ংকর এক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। অবাধ তথ্যপ্রবাহ আর সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন যে কোনও সংবাদ গণমাধ্যমে আসার আগেই মানুষ সেটির আদ্যোপান্ত জেনে বসে থাকে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্য-মিথ্যা-গুজব মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলে তখন সুষ্ঠু ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক তা প্রথম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সাংবাদিক যদি নারী হন তাহলে তার জন্য পরিস্থিতি হয় আরও ভয়াবহ, বিশেষ করে তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে যে কুৎসিত প্রচার-প্রচারণা এবং আক্রমণ চালানো হয় তাতে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। কিন্তু এর মধ্যেও নারী সাংবাদিকরা কাজ করেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই তার পুরুষ সহকর্মীর মতোই এসব চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করেন।
সাংবাদিক যদি নারী হন তাহলে তার জন্য পরিস্থিতি হয় আরও ভয়াবহ, বিশেষ করে তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে যে কুৎসিত প্রচার-প্রচারণা এবং আক্রমণ চালানো হয় তাতে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে।
ইউরোপকে আমরা পৃথিবীর অন্য মহাদেশের তুলনায় শান্ত এবং গণতান্ত্রিক বলে জানি। সেই ইউরোপের ছোট্ট দ্বীপদেশ মাল্টা। খুব ভালো আবহাওয়া বলে সেখানে মূলত অন্যান্য ইউরোপীয়রা ছুটি কাটাতেই যান। কেউ কেউ সেখানে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। সেই দেশের মূল আয় পর্যটন থেকে এবং এশিয়া/আমেরিকা/আফ্রিকা থেকে বিত্তবানরা এই মাল্টাতে তাদের অবৈধ অর্থ রাখেন কারণ এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি সেখানে অর্থ রাখার সুযোগ করে দেয় ট্যাক্স ছাড় দিয়ে। ফলে এখানকার মন্ত্রী/প্রেসিডেন্ট/প্রধানমন্ত্রী সকলেই কখনও না কখনও জড়িত হয়ে পড়েন বড় ধরনের দুর্নীতিতে। এই মাল্টার একজন ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক ডাফনে কারুয়ানা গালিজিয়া (Daphne Caruana Galizia)। তিনি এসব দুর্নীতি উন্মোচন করতে গিয়ে ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর নিহত হন তার গাড়ির ভেতর আগে থেকে রাখা বোমা বিস্ফোরণে। ধারণা করা হয় যেসব মন্ত্রীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি লিখতেন তারাই এই ভয়ঙ্কর কাজটি করেছেন। তার দুই পুত্রের একজন বসবাস করেন লন্ডনে, আরেকজন সুইজারল্যান্ডে। লন্ডনে যিনি থাকেন তিনি সাংবাদিক এবং যিনি জুরিখে থাকেন তিনি কাজ করেন ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখার দায়িত্বেও তিনি আছেন। দু’জনের সঙ্গেই আমার পরিচয় আছে। এক ভাই মাল্টা সরকারের পররাষ্ট্র দফতরে কাজ করতেন, দিল্লিতে কর্মরত ছিলেন কিন্তু তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, আরেক ভাই মাল্টাতে থাকতে পারেননি বলে এখন লন্ডনে গিয়ে সাংবাদিকতা করছেন। সবচেয়ে কষ্ট ও দুঃখের কথা হচ্ছে, ডাফনে হত্যাকাণ্ডের বিচার কিংবা তদন্ত কোনটিই এখনও পর্যন্ত এগোয়নি। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ ইউরোপের প্রতিটি সংসদ থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও তদন্তের জন্য মাল্টাকে জানানো হয়েছে। কিন্তু মাল্টা কর্তৃপক্ষ এটা করেনি কারণ তাতে এমন হতে পারে যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশের মন্ত্রী/এমপিদেরও দুর্নীতি উন্মুক্ত হতে পারে। এই গল্পটুকু বলার উদ্দেশ্য এটাই যে, সাংবাদিকতাই যেখানে আক্রান্ত, যেখানে নারী কিংবা পুরুষ নির্বিশেষে সাংবাদিকতার জন্য ‘ভিকটিম’ হয়ে পড়ছেন, সেখানে চ্যালেঞ্জটি কেবলমাত্র নারীর ক্ষেত্রে যে নয় সেটা বোঝানোর জন্য।
২
বাংলাদেশের কথা বলি। বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় নারীর চ্যালেঞ্জ বহুমুখী। বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে যে কোনও নারীই আসলে তার পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় অনেকটাই ‘ভালনারেবল’ অবস্থায় থাকেন, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তাই। তবু এই সংকটের মধ্যে থেকেও বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় এক ঝাঁক নারী নিজেদের অবস্থানকে যে অত্যন্ত সুস্থির করতে সক্ষম হয়েছেন তার প্রমাণ হিসেবে জাতীয় প্রেসক্লাবে সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনে একজন নারী প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়াকে উল্লেখ করা যেতে পারে। এর আগে তিনি দুইবার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এটাকে অর্জন ধরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলি আর টিভি টক শো’র হোস্ট হিসেবে সাংবাদিকতাকে যে মাত্রায় নিয়ে যেতে পেরেছেন এদেশের নারী সাংবাদিকরা একদশক আগেও তা ভাবা ছিল অসম্ভব। কিন্তু তাতে কি নারীর প্রতি সহিংসতা, আক্রমণ এবং নারী সাংবাদিককে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিকৃষ্ট ভাষায় অবমাননা কিছুমাত্র কমেছে? উত্তরটি হতাশাজনক ভাবে হচ্ছে ‘না’ এবং ‘না’।
কলাম লেখক যে কোনও বিষয়ে কলাম লেখেন। একজন পুরুষ লেখকের ক্ষেত্রে নীচের মন্তব্যে বড়জোর ‘দালাল’ গালি শুনতে হয় কিন্তু নারী লেখককে তার লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে নোংরা এবং অকথ্য ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য আক্রমণের শিকার হতে হয়।
সুখের কথা হলও, রাষ্ট্র এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন আগের চেয়ে খানিকটা সচেতন ও সোচ্চার। এক্ষেত্রেও বিষয়টি কেবল নারী সাংবাদিক বলে নয়, সামগ্রিক ভাবে নারীর প্রেক্ষাপটেই বিচার করতে হবে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করায় যেমন রাষ্ট্র বাধ্য হল তেমনই নারী অবমাননা কিংবা নিগ্রহের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের আইন ও আইনের প্রয়োগকারীরা যদি কঠোর হন তাহলে পরিস্থিতি বদলাতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে নারী সাংবাদিকও নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তা এবং কর্মক্ষেত্রে কোনও ধরনের নিগ্রহের শিকার হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন, অন্য যে কোনও কর্মজীবী নারীর মতোই। সে কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে বার বার বিষয়টির সামগ্রিকতার ওপর নজর দেবার কথা বলি। একজন কলাম লেখক যে কোনও বিষয়ে কলাম লিখতে পারেন। একজন পুরুষ লেখকের ক্ষেত্রে কলামের নীচের মন্তব্যের ঘরে বড়জোর ‘দালাল’ বলে গালি শুনতে হয় কিন্তু একজন নারী লেখককে তার লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণেই যে নোংরা এবং অকথ্য ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য আক্রমণের শিকার হতে হয়, তারপর সেই নারী লেখকের পক্ষে নতুন কোনও লেখার আগ্রহ থাকাটা সত্যিকার অর্থেই অনেক শক্ত মানসিকতার অধিকারী হতে হয়, না হয় আর লেখা বেরুনোর কথা নয়। এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই আমি এখানে কাজে লাগিয়েছি এবং আরও অনেক লেখকের কথাও জানি। একাত্তর টেলিভিশনের জনপ্রিয় টক শো একাত্তর জার্নালের ফেইসবুক পাতায় যেভাবে নারী উপস্থাপক এবং নারী অতিথির অবমাননা করা হয় সেটি কোনও ভাবেই যে সুষ্ঠু সাংবাদিকতার পক্ষে সহায়ক কোনও কাজ হতে পারে না সেকথা বলে বোঝানোর বোধকরি প্রয়োজন নেই।
৩
কারো রাজনৈতিক অবস্থান কিংবা বক্তব্য আপনার ভালো না লাগতেই পারে কিন্তু তাই বলে তাকে অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ এবং হুমকি যে ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে এই ধারণাটুকু না থাকায় সমস্যাটি এখন সত্যিই বিশাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক’জনকে আইনের আওতায় আনার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলবেন আপনি? সচেতন নিজেকে হতে হবে, পারিবারিকভাবে সেটা তৈরি হতে হবে, না হলে আপনি ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে নারীকে চরম নোংরা ভাষায় আক্রমণ কিংবা হুমকি দেওয়া ঠেকাতে পারবেন না। ফলে কেবল সাংবাদিকতা নয়, সার্বিকভাবেই নারীকে একজন পুরুষের তুলনায় বেশি ও ভিন্নমাত্রার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, সেটা সাংবাদিকতা হোক কিংবা সরকারি বা বেসরকারি চাকরিক্ষেত্রে হোক। সাংবাদিক নারী এক্ষেত্রে অনেক বেশি সহ্যক্ষমতা অর্জন করেছেন বলে এখন আর তাদেরকে দমানো যাচ্ছে না, কিন্তু অন্যক্ষেত্রে চাকরি ছেড়ে দেওয়াদের তালিকা কিন্তু বিশাল।
মাসুদা ভাট্টি ।। এডিটর-ইন-চার্জ, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি