মেগা প্রকল্প, উচ্ছেদ ও কর্মসংস্থানের ভ্রান্ত প্রতিশ্রুতি
১
মেগা প্রকল্প মানেই উন্নয়ন এমন একটা বোঝাপড়া তো তৈরি হয়েই আছে মধ্যবিত্ত মানসে। সেটা বিদ্যুৎকেন্দ্র হোক বা ব্রিজ হোক, হাইওয়ে হোক বা টার্মিনাল হোক। এই সরকারের আমলে মেগা প্রকল্প মানেই উন্নয়ন, মানুষের উন্নতি, প্রচুর কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক লাভ, এমন একটা প্রচ্ছন্ন ইমেজও তৈরি করা হয়েছে। যা কিছু মেগা তার সঙ্গে অর্থনীতি আর জিডিপির একটা সম্পর্ক তো আছেই, কিন্তু মেগার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক জটিল। প্রচলিত ধারণা হলো, মেগা প্রকল্প প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করে, পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর উন্নয়ন হয়, বেকার জনগোষ্ঠীর জন্যে চাকরি তৈরি হয়, মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হয়। কিন্তু মেগা প্রকল্পর ফলে ঠিক কোন মানুষগুলোর উপকার হয়? উপরতলার মানুষের সঙ্গে মেগা প্রকল্পের সম্পর্ক অর্থের, ক্ষমতার এবং লবিং-এর। আর নিচের তলার মানুষের সঙ্গে? সেই কথা নাই বললাম।
এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, মেগা প্রকল্পের ফলে স্থানীয় জনগণ উচ্ছেদ হলেও পরবর্তীতে মেগা প্রকল্পের নির্মাণ কাজে তারাই চাকরি পায় এবং প্রকল্পের ফলে ওই এলাকাগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ব্যবসা বাণিজ্য বা শিল্পায়নের সুযোগ তৈরি হয়। ‘বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে’ এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, বাস্তবে কিন্তু একেবারেই উল্টো ছবি দেখা যায়।
মেগা প্রকল্পের নির্মাণ কাজ চলাকালীন সময়ে যে চাকরিগুলো তৈরি হয় তা একেবারেই সাময়িক। ‘পার্মানেন্ট’ বা দীর্ঘস্থায়ী চাকরি নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লিখিত চুক্তি বা কাগজপত্রের বালাই থাকে না। অর্থাৎ এইসব কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে মানুষের বেকারত্ব ঘোচার কোনোই সম্ভাবনা থাকে না। কৃষক ও তার পরিবার পরিজনকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হলেও পরবর্তীতে দেখা যায় এলাকার বেকার যুবকদের প্রাধান্য না দিয়ে কনট্রাক্টরের পছন্দ অনুযায়ী অন্য এলাকা থেকে দক্ষ শ্রমিক নিয়ে এসে চাকরি দেওয়া হয়। এছাড়া বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলোতে অন্য দেশের সরকার বা বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা জড়িত থাকায়, বিদেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে আসার ব্যাপারটিও ইদানীং সামনে এসেছে। যেমন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করছে কয়েকশ ভারতীয় শ্রমিক (করোনা বিস্তারের শুরুতে তারা দেশে ফেরার আন্দোলন শুরু করলে বিষয়টা সামনে আসে।)
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজের জন্যে চীন থেকে শত শত শ্রমিক আনা হয়েছে, এই তথ্যটিও স্থানীয় শ্রমিকদের সঙ্গে একটি সংঘর্ষের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সামনে এসেছিল। এছাড়াও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজে স্থানীয় বেকার যুবকদের নেওয়া হয়নি বরং অন্যান্য জেলা থেকে শ্রমিক নিয়ে আসা হয়েছে। মাতারবাড়ির স্থানীয় যুবকদের মধ্যে এই নিয়ে প্রচুর অসন্তোষও রয়েছে।
‘বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে’ এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, বাস্তবে কিন্তু একেবারেই উল্টো ছবি দেখা যায়। মেগা প্রকল্পের নির্মাণ কাজ চলাকালীন সময়ে যে চাকরিগুলো তৈরি হয় তা একেবারেই সাময়িক। দীর্ঘস্থায়ী চাকরি নয়।
সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই দাবি করা হয় যে, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিয়েই এলাকার জমি অধিগ্রহণ করা হয়। অথচ প্রকল্প এলাকাগুলোর বাস্তবতা ভিন্ন। মাতারবাড়ি, পায়রা, বাঁশখালী বা রামপালের মানুষ বরাবরই বলে এসেছে, সরকার বা কোম্পানির জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটি জবরদস্তিমূলক। এলাকার উন্নয়নের কথা বলে জমি অধিগ্রহণ করা হলেও, প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে এই ‘উন্নয়ন’ স্থানীয় জনগণ চায়নি। এটা শুধু বাংলাদেশের ৪-৫টি বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই নয়, বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই দেখা গেছে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে।
গত দুই তিন দশকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প বা অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত আন্দোলন হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, কৃষক জমির ক্ষতিপূরণ নিয়ে আলাপ করতেই আগ্রহী নন। এমনকি মহারাষ্ট্রের রাইগড়ের কৃষক তো তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা আগুনে পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এদেশেও মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হয়েছে-রামপালে, বাঁশখালীতে, মাতারবাড়িতে।
রামপালে কৃষি জমি অধিগ্রহণ ঠেকাতে ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটিও গঠিত হয়েছিল। ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে কৃষকদের এই বিরূপ আচরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করায়- ‘কৃষি জমির আদৌ কোনো ক্ষতিপূরণ হয় কি?’ বাস্তবে কৃষকের একখণ্ড কৃষিজমি তার এবং তার পরবর্তী প্রজন্মের উপার্জনের একমাত্র সম্বল। কাজেই সারাজীবনের জীবিকার একমাত্র বাহনটি কেড়ে নিয়ে, শুধুমাত্র মার্কেট প্রাইস বা বাজার মূল্যের উপর ভিত্তি করে একটি এককালীন ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ গছিয়ে দিয়ে এতো অসংখ্য কৃষকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
২
রামপাল বা মাতারবাড়িতে আমরা অসংখ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে দেখেছি। এছাড়াও ক্ষতিপূরণ নিয়ে চরম দুর্নীতি আমাদের দেশে নতুন নয়। ক্ষতিপূরণের টাকা স্থানীয় প্রশাসনের হাতে আসা মাত্রই নানা ধরনের ছলচাতুরী শুরু হয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে ২০-৩০ পার্সেন্ট ঘুষ দিয়ে এলাকার মানুষকে টাকার বরাদ্দ নিতে হচ্ছে- এমন দুর্নীতি প্রকল্প এলাকাগুলোতে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও জমি অধিগ্রহণের ফলে যে বিপুলসংখ্যক কৃষক উচ্ছেদ হয় বা যে মাত্রায় স্থানীয় বেকারত্ব তৈরি হয়, সেই মাত্রায় কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার নজির নেই। একে তো হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণের ফলে স্থানীয় কৃষি অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই ভেঙে পড়ে। এছাড়াও বহুবছর ধরে চলে আসা স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্য, স্থানীয় খামার, স্থানীয় মাছের ব্যবসা, স্থানীয় ডেইরি, পোল্ট্রিসহ এলাকার অর্থনৈতিক কাঠামোটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। স্থায়ী কর্মসংস্থান বা বিদ্যমান কর্মসংস্থানগুলোও চিরতরে হারিয়ে যায়। অর্থাৎ স্থানীয় জনগণকে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এলাকার পুরো ‘ডেমোগ্রাফি’টাই লন্ডভন্ড হয়ে যায়। যেমন পায়রা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে প্রায় ৭ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, ফলে আবাদি জমি হারিয়েছেন অসংখ্য কৃষক। সব হারিয়ে এলাকার বেড়িবাঁধের উপর কোনোমতে আশ্রয় নিয়েছেন শত শত পরিবার।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের ফলে নিয়মিত ড্রেজিং, বালু উত্তোলন এবং প্রচুর পরিমাণে ট্রলার চলায় ইতিমধ্যেই নদীগুলো প্রায় মাছ শূন্য হয়ে পড়েছে। পায়রার মৎস্যজীবী সম্প্রদায় আয় উপার্জন হারিয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে। বিদ্যুৎ প্রকল্পটির কারণে কিছু অস্থায়ী নির্মাণ শ্রমিকের কাজ তৈরি হয়েছে ঠিকই। বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে কিছু নতুন শিল্পও গড়ে উঠবে, কিন্তু মাঝখান থেকে এই যে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অসংখ্য কৃষক ও জেলে তাদের স্থায়ী কর্মসংস্থানগুলো হারিয়ে চিরতরে উচ্ছেদ হয়ে যাবেন, তার দায়িত্ব নেবে কি এই উন্নয়নের রাষ্ট্র? নতুন যে চাকরিগুলো তৈরি হবে বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই চাকরিগুলো দরিদ্রতা ঘোচানোর মতো চাকরি হবে তো? নাকি গার্মেন্টসের মতো বছরের পর বছর অপমানজনক মজুরিতে দারিদ্র্য টিকিয়ে রাখা কর্মসংস্থান হবে?
তিন দশকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প বা অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত আন্দোলন হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, কৃষক জমির ক্ষতিপূরণ নিয়ে আলাপ করতেই আগ্রহী নন।
প্রচলিত ধারণা হলো, মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প মানে বেশি বেশি শিল্পায়ন, অর্থাৎ বেশি বেশি উন্নয়ন। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লে অর্থনীতি বাড়বে, ব্যবসা বাণিজ্য বাড়বে, ইপিজেড হবে, অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে, ভারী শিল্প হবে, প্রচুর কর্মসংস্থান হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইপিজেডগুলোতে বা ইকোনোমিক জোনগুলোতে ঠিক কি ধরনের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে বা হবে?
শুধুমাত্র আমাদের গার্মেন্টস খাতের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এই কাঠামোর কর্মসংস্থানগুলো কতটা নিম্নমানের। বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকদের জীবনমান নিয়ে এ পর্যন্ত যে গবেষণাগুলো হয়েছে সেখানে এই বাস্তবতা স্পষ্ট যে, ইপিজেডের শ্রমিক বা গার্মেন্টসের শ্রমিক বছরের পর বছর ধরে একটা ভয়াবহ দারিদ্র্যের সাইকেলের মধ্যে ঘুরতে থাকে।
৩
২০১৯ সালে অক্সফাম দেড় হাজার ফ্যাক্টরিতে জরিপ চালিয়ে দেখিয়েছিলও যে, গার্মেন্টস খাতের শতকরা ৯৮ জন পোশাক শ্রমিকই বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছেন না, ১০ জন গার্মেন্টস কর্মীর মধ্যে নয়জনেরই তিন বেলা খাওয়ার সামর্থ্য নেই, শতকরা ৮৭ জন গার্মেন্টস কর্মীই সারাবছর ঋণগ্রস্ত থাকেন এবং শতকরা ৫৬ জন গার্মেন্টস কর্মীই সারাবছর বাকিতে জিনিস কিনতে বাধ্য হন। তাহলে প্রশ্ন করুন, যে শিল্পায়ন বা উন্নয়নের নামে এত এত বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, সেই শিল্পায়ন কি এই দেশের শ্রমিকদের দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে পারছে? নাকি তাকে সারাবছর ধারদেনা করে চলতে বাধ্য করছে? অর্থাৎ স্থানীয় জনগণ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থানীয় অর্থনীতিকে উচ্ছেদ করে মেগা প্রকল্প-ভিত্তিক যে উন্নয়নের মডেল আমরা তৈরি করেছি, সেই মডেলের পরের ধাপেই তৈরি হচ্ছে অসংখ্য নিম্নমানের কর্মসংস্থান।
স্থানীয় কর্মসংস্থান নষ্ট করে ইপিজেড বা ইকোনোমিক জোনের ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকা কর্মসংস্থান বা অপমানজনক মজুরি এবং শ্রম আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো কর্মসংস্থান। কিন্তু এভাবে হাজার হাজার নিম্নমানের কর্মসংস্থান তৈরি করার মাধ্যমে ঠিক কোন গোষ্ঠীটি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে? এইসব মেগা প্রকল্পের আসল উপকার ভোগী কারা? এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক বা শ্রমজীবী মানুষ কি এইসব প্রকল্পের ফলভোগী?
সারা পৃথিবী জুড়ে সস্তা এবং পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের অভাবনীয় প্রসারের পরও আমরা একের পর এক পরিবেশ বিধ্বংসী মেগা কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করছি কেন? স্বাভাবিক খরচের চাইতে দ্বিগুণ তিনগুণ খরচে তৈরি হওয়া এইসব প্রকল্প কাদের পকেট ভারী করছে? এমন বহু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বেরিয়ে আসবে দুর্নীতি, অনিয়ম ও কমিশন বাণিজ্যের নানান কীর্তি। দুর্ভাগ্যবশত, মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের নামে স্থানীয় জনগণের সম্পদ জোরপূর্বক কেড়ে নিয়ে বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার এই প্রক্রিয়াটিই এই দেশে ‘উন্নয়ন’ নামে প্রচারিত হচ্ছে।
মাহা মির্জা ।। অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক