বিপন্নতাকে কৃষ্ণচূড়ায় পাল্টে ফেলার দশক
১
বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গত শতাব্দীর ষাটের দশক এক অবিস্মরণীয় গণজাগরণের দশক। মূলত এই দশকের আলোতেই রচিত হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর অলোকসামান্য ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পৃথিবীব্যাপী মুক্তিকামী মানুষের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সর্বকালের এক অখণ্ড অনুপ্রেরণা। বাংলার মানুষের মুক্তিসংগ্রামের যে বীজ সাংস্কৃতিক ভূমিতে রোপিত হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্বে, তার রাজনৈতিক বিকাশ প্রাপ্তির সময় হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে ষাটের দশককে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতির জাতীয় জাগরণ বা রেনেসাঁর পূর্ণতা পায় এই দশকে, আর তারই শক্তিতে রচিত হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকের সূচনা ঘটেছিল কতগুলো উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক বিন্দুতে। সামরিক স্বৈরাচারী শাসন বিরোধী গণতন্ত্র ও স্বাধিকার এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অধিকারের দাবির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই দশকের প্রান্ত বিন্দু হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ। পঞ্চাশের দশক যেমন শুরু হয়েছিল ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এবং এই সংগ্রামের নথিভুক্ত প্রশ্নাবলীর গুরুত্বপূর্ণ সমাধান এসেছিল ষাটের দশকে। ভাষা আন্দোলন কালীন খবরের কাগজগুলো দেখলে বোঝা যায়, এই আন্দোলনের বিপরীতে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসন ছিল পূর্ব-বাংলাকে ‘পূর্ব-পাকিস্তান’ নামে পরিচিত করে তোলার সামরিক প্রয়াস। ষাটের দশকে বাংলার মানুষ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এই সমস্যার মোকাবেলা করে। এই দশকেই স্থির নিশ্চিত হয়ে যায়, বিশ্বের বুকে এই মানচিত্রের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’।
চল্লিশের দশক শুরু হয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে, পঞ্চাশের দশকের শুরু ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, ষাটের দশকে মানুষ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার মোকাবেলা করে, সত্তরের দশকের শুরু বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে, সামরিক স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের লেজুড়েই শুরু হয় আশির দশক।
যদি দশকের ধারাবাহিকতায় ষাটের দশককে বিচার করি, তবে তার পূর্ব ও পরবর্তী দশকগুলোর একটি তুলনামূলক আলোচনা প্রয়োজন। ষাটের দশককে প্রেক্ষণে রেখে একটু পেছনে গেলে আমরা দেখি, চল্লিশের দশক শুরু হয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশের বিভক্তি ঘটানোর লক্ষ্যে মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রস্তাব পাস করার ভেতর দিয়ে আর পরিসমাপ্তি ঘটে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির মধ্য দিয়ে। পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে জাতীয় চেতনার ভ্রূণ সৃষ্টি হলেও, দশকটি শেষ হয় সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের ট্র্যাজিক যবনিকা টেনে। আবার ষাটের দশকের সামনে যদি যায়; তবে দেখি, সত্তরের দশক শুরু হয়েছিল বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্যদিয়ে, কিন্তু এই দশকের শেষ হয় পাকিস্তান আমলের মতো হত্যা-ক্যু এবং সামরিক স্বৈরাচারী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বত্র প্রতিষ্ঠার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। একই ধারাবাহিকতায় সামরিক শাসনের লেজুড়েই শুরু হয় আশির দশক, তবে এই দশকের সমাপ্তি ঘটে গণতন্ত্র পুনরুত্থানের সর্বাত্মক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এভাবে ষাটের আগের ও পরের দশকগুলোর তুলনামূলক আলোচনা করলে আমরা বুঝতে পারি, কেন বৈশিষ্ট্যে, ধরনে, বিকাশ ও ব্যাপ্তিতে ষাটের দশকই গত শতাব্দীর গণজাগরণের দশক হিসেবে অনন্য।
২
সামরিক শাসনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান প্রবর্তিত বুনিয়াদি গণতন্ত্রের নির্বাচনকে সামনে রেখে শুরু হয় ষাটের দশক। এ সময় আইয়ুব খান কিছু লোক দেখানো নীতি গ্রহণ করেছিল। দমন-পীড়ন কিছুটা শিথিল করে গণতান্ত্রিক অধিকার সম্প্রসারিত করা হয়। সামরিক আইন জারির পর যেসব রাজনৈতিক নেতাকে জেলে নেওয়া হয়েছিল, তাদের অনেককেই এই দশকের শুরুতে মুক্তি দেয়া হয় কেবল এইটা প্রমাণের জন্য যে, দেশে ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে’। বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্সের আওতায় নিরাপত্তা বন্দী আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান ১৯৫৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। জেল থেকে মুক্তি দেয়া হলেও বাস্তবে ১৯৬০ সাল জুড়ে তাকে নানাভাবে হেনস্তা করে পাকিস্তান সরকার, ফলে কার্যত তিনি নজরবন্দীই থাকেন। এ কারণেই ১৯৬০ সালের ১১ জানুয়ারি যে নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানে ইউনিয়ন স্তরে আইয়ুবের ‘বুনিয়াদী গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতে বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা রাখা শক্ত হয়ে পড়ে। ফলে একতরফা ও লোক দেখানোর এই নির্বাচনের ফলাফলের ধারাবাহিকতাতেই আইয়ুব খান পরবর্তী চার বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কয়েকজন আমেরিকান অধ্যাপক ঠাণ্ডা যুদ্ধ যুগের বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার সহযোগী দেশ পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করানোর জন্য ‘বুনিয়াদী গণতন্ত্র’- এর রূপরেখা প্রবর্তন করে দিয়েছিলেন। আমাদের মনে রাখা দরকার, যে ষাটের দশকের আলোচনা আমরা করছি, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও এই দশক তখন পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক দুই শিবিরে বিভক্ত। ফলে স্পষ্টতই আইয়ুব খান তথা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ সময় বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব বাংলা) চলমান আন্দোলনের রূপরেখাটি ছিল সাম্যের ও মানবিক মর্যাদার। ফলে এই দশকের অবিস্মরণীয় আন্দোলনের দূরতম সংযোগ ছিল সোভিয়েত বিপ্লব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্টিন লুথার কিং বা নেলসন ম্যান্ডেলার বর্ণ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে।
এই দশকে বাঙালি মধ্যবিত্তের একটি অনুচ্চারিত সংঘাত আমরা দেখতে পাই। এই সংঘাতটি নিয়ে ইতিহাসে খুব একটা আলোচনা না হলেও আমরা বলতে পারি, এই সংঘাত থেকেই ষাটের দশকে পূর্ব-বাংলার নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আমরা খুঁজে নিতে পারি। সে হিসেবে এই দশক বাঙালির এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি কাঠামোর দশক, যারা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে।
১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় দুটো সংগঠন; একটি সরকারি অন্যটি বেসরকারি। সরকারি সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তথ্য ও প্রচার মন্ত্রণালয়ের একটি গবেষণা শাখা হিসেবে। এর নেতৃত্বে ছিলেন আইয়ুব খানের অনুগত ব্রিগেডিয়ার এফ আর খান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি ছিল আইয়ুবের অনুগত শিক্ষা সচিব কুদরতউল্লা সাহেবের নেতৃত্বে। এই সংগঠনে আরও যারা ছিলেন, তাদের প্রত্যেককেই বাঙালি নবজাগরণের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তারা হলেন: ইবরাহীম খাঁ, গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন, আবদুল কাদির, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, মুহাম্মদ আবদুল হাই প্রমুখ। এই দুই সংগঠন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর জোরেশোরে বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের আইয়ুব খান ও পাকিস্তানের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ শুরু করে। এ সময়ই প্রবর্তিত হয় ‘আদমজী পুরস্কার’ এবং বিচারপতি শরিফের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশন একটি শিক্ষানীতি প্রকাশ করে।
স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্বে দেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই সংগ্রামের সঙ্গে পঞ্চাশের দশকের অনেক বুদ্ধিজীবীরই সায় ছিল না...
এরপরই শিক্ষার্থী সমাজে শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। এই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাই কিন্তু পূর্ব-বাংলার নব্য বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ, যাদের হাত ধরে জন্ম নেয় স্বাধীনতার নতুন রাজনৈতিক ভাষ্য। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফার প্রেক্ষিতে বাংলার মানুষ যে পারাবার প্রতিম আন্দোলন রচনা করে, তার প্রেক্ষণে ছিল ষাটের দশকের শুরুতেই উদ্বোধিত এই বুদ্ধিজীবী তরুণরা। এই তরুণদের নেতৃত্বে উঠে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান, কেননা ষাটের দশকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি গ্রহণ করেন তিনি আর তা হলও: স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এই সংগ্রামের সঙ্গে কিন্তু পঞ্চাশের দশকের অনেক বুদ্ধিজীবীরই সায় ছিল না। পরবর্তীতে তাদের অনেকেই এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলেও, শুরুতে বঙ্গবন্ধু ছাত্রসমাজের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা বুদ্ধিবৃত্তিক তরুণদের নিয়েই আন্দোলন রচনা করেছেন।
১৯৬১ সালের প্রতিবাদী রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষ উদযাপন ছিল এ দশকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ১৯৬১ সালের এপ্রিল ও মে মাসের দৈনিক আজাদ পত্রিকাতে প্রায় প্রতিদিন রবীন্দ্র বিরোধী প্রবন্ধ ও অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আইয়ুব সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরা এই প্রবন্ধগুলো লিখতেন। সে সময়ে এর প্রতিবাদে বাংলায় উদযাপিত হয় প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ। হাইকোর্টের বিচারপতি এস এম মুর্শেদকে সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. খান সারোয়ার মুরশিদকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় কেন্দ্রীয় জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন পরিষদ।
এখানে লক্ষণীয় যে, রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদযাপনে তখন যারা বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের বয়স ছিল ৫০-৬৫ এর মধ্যে। বিপরীতে এই অমোঘে আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা সামিল হয়েছিলেন, তাদের বয়স ছিল ২৪-৩৫ এর মধ্যে। অর্থাৎ এই স্রোতই পরবর্তীতে বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজে নির্মাণ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন ১৯৭১ সালে।
৩
ষাটের দশকের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙালির চৈতন্যের পাণ্ডুলিপি নির্মিত হয়েছিল অমোঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। সেই সংগ্রামের মূল পাটাতন ছিলও তৎকালীন তারুণ্যের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল বিকাশ। এই তারুণ্যের স্রোতেই বাঁক নিয়েছিল আমাদের রাজনৈতিক গতি প্রবাহ এবং নির্মাণ করেছিল স্বাধীনতার বিজয় ভাষ্য। সুতরাং ষাটের দশক যুগে যুগেই আমাদের প্রেরণার দশক। এখনও যে কোনও বিচারেই ষাটের দশকই আমাদের চোখে ও মননে লেগে থাকা সেই অবিনশ্বর সময়, যাকে আত্মস্থ করে উঠতে পারিনি বলেই একটি হাবা প্রজন্ম হিসেবে আমরা বড়ো হচ্ছি প্রতিদিন।
মারুফ রসূল ।। লেখক ও ব্লগার