বাকস্বাধীনতা একটি সংস্কৃতি
জীবনের এ প্রান্তে এসে এমনটিই মনে হয়, সত্যি অর্থে বাকস্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা কখনোই ভোগ করিনি। আবার এ সত্যও মনে আসে, সত্যি অর্থে বাকস্বাধীনতা যা তা কি নিজের জীবনাচরণে আছে? বাকস্বাধীনতার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। মোটাদাগে ধরতে গেলে রাষ্ট্র, সমাজ, পারলৌকিক ধর্ম, ইহ জাগতিক ধর্ম, শিক্ষা ব্যবস্থা, পারিবারিক পরিবেশ, সমাজের সংস্কৃতির বিবর্তন, লালন ও মানসিকভাবে তাকে গ্রহণ- এইরকম আরও অনেক কিছু।
রাষ্ট্রের আগে একটু ভেবে দেখা যেতে পারে নিজস্ব জীবনাচরণ নিয়ে। জন্ম হয়েছে একটি সামরিক শাসনে শাসিত ধর্মীয় রাষ্ট্রে। ধর্ম যখন রাজনীতির হাতিয়ার হয় ওই ধর্ম তখন মানবিকতা শেখায় না। সে রাষ্ট্রের বা রাজার নিপীড়কের একটি অংশ হয়। রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি নাটকে দেখেছি, রাজার প্রয়োজনে দেবীর নামে রাজ রক্ত চেয়ে ভাই হত্যার পথ খুলে দিচ্ছে পুরোহিত। বাস্তবে এই হচ্ছে ধর্ম, যখন রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, রাজনীতির প্রয়োজনে ব্যবহার হয়- তখন ওই ধর্মের চরিত্র। রাজনীতি ও রাষ্ট্র যখন ধর্মকে ব্যবহার করে তখন রাজনীতি ও রাষ্ট্র তার নিজের প্রয়োজনে ধর্মের মানবিক ও সুন্দর দিকগুলোকে পরিবর্তন করে ফেলে সুকৌশলে এবং নানা ছলনায় ও নানান ধর্ম ব্যবসায়ী ধর্মীয় গুরু’র মাধ্যমে তখন ধর্মের ভেতর অনেক নিপীড়ক নীতি ঢুকিয়ে দেয়। তার ফলে ওই রাষ্ট্র ও সমাজের মানুষ ধীরে ধীরে যে ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হয়, ওই ধর্ম সম্পূর্ণ নিপীড়নমূলক একটি অস্ত্র। তা নানান ভাবে মানুষকে বিকল করে দেয়। বিশেষ করে মানুষের মানসিক বৈকল্য এনে দেয় অনেক বেশি।
আর যেহেতু ধর্ম হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতার ও মানবিকতার একটি বড় বাহন তাই এর প্রভাব রাষ্ট্র ও সমাজে অনেক বেশি থাকে। যখনই ধর্মের চরিত্র এভাবে সুকৌশলে বদলে দেয়া হয় তখন থেকেই সমাজের, রাষ্ট্রের সভ্যতা বাধাগ্রস্ত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্র অনেকটা পঙ্গু অবস্থায় এগোতে থাকে। ওই পঙ্গু রাষ্ট্রের মানুষও তাই বেড়ে ওঠে মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে। সে হিসেবে আমাদের বেড়ে ওঠাও পঙ্গু নাগরিক হিসেবে। অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, তা কী করে হবে? আমরা তো স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করেছি, বিজয়ী হয়েছি। আমারা কেন মানসিকভাবে একটি পঙ্গু জাতি হব! বাস্তবে স্বাধীনতার সংগ্রাম বা বিপ্লব একটি সংগঠন কেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ আন্দোলন। এ আন্দোলন ও যুদ্ধে সফল হলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা আসে। কিন্তু মানসিকভাবে পঙ্গুত্ব থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন হয় ‘মুক্তির সংগ্রাম’। যে কথা বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম ‘মুক্তির সংগ্রাম’, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো সেই মুক্তির সংগ্রাম শুরু হওয়ার সুযোগ হয়নি।
বুদ্ধি দ্বারা, জ্ঞান দ্বারা সমাজ নিয়ন্ত্রিত নয়। সমাজ নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা দ্বারা, অর্থ দ্বারা। যে সমাজ ক্ষমতা ও অর্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ওই সমাজের মানুষের উপলব্ধিতে বাকস্বাধীনতা থাকে না।
এই সংগ্রাম শুরু করতে হলে বা সমাজকে সব ধরনের পঙ্গুত্ব থেকে মুক্ত করতে হলে প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রীয় কাঠামোটি এমন ভাবে গড়ে তোলা যাতে মানুষ মুক্ত ভাবে বেড়ে ওঠতে পারে। কিন্তু তার পরিবর্তে স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্র কাঠামোটি তিন বছর রাখা হয়েছিল অবিকল পাকিস্তানি ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাঠামোতে। যার ফলে স্বাধীনতার পর পরই মানুষের (অন্তত একটি বড় সংখ্যক মানুষের) মনে যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এসেছিল তার অনেকখানি স্বাভাবিক গতিতেই মারা যায়। এরপরে যখনই রাষ্ট্রীয় কাঠামো বদলে বঙ্গবন্ধু হাত দিলেন তখনই তাকে হত্যা করা হয়। তারপরে ফিরে আসে সেই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো। যে রাষ্ট্র সব সময়ই সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের কঠোর বিধিনিষেধের দ্বারা পরিচালিত হয়। অন্যদিকে সেখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেই রাজতন্ত্রের ধর্মকে ব্যবহার করা হয়, যা মানসিকতাকে পঙ্গুত্বের দিকে নিয়ে যায়। সব থেকে বড় বাধা হয় একটি উদার সংস্কৃতি বিকাশে।
আমাদের একটি ধারণা আছে, সংস্কৃতি বলতে বোঝায় শুধু আনন্দদায়ক বিষয়গুলো। বাস্তবে তা কখনই নয়। সংস্কৃতি রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের সকল আচরণেরই সম্মিলিত প্রকাশ। রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের জীবনের সকল কাজই ওই রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিই মূলত একটি মানুষের বিকাশ ও তার কাজের চরিত্র নির্ধারণ করে। পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া ও বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া কোনো প্রজন্মই তাই সত্যি অর্থে জীবনের সবকিছুকে স্বাধীনভাবে বিকশিত করার, প্রকাশ করার কোনো পরিবেশ পায়নি। আর এ কারণে কোনটা স্বাধীনতা আর কোনটা স্বাধীনতা নয় এ সম্পর্কে এ ধরনের সমাজে ও রাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা মানুষের কোনো সঠিক ধারণা থাকে না। বরং অনেক সময় ভুল করে যেকোনো সুযোগকে স্বাধীনতা বলেই মনে করে। বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে তাই দেখা যায়, আমাদের রাষ্ট্রে ও সমাজে বারবার সুযোগ চাওয়া হয়। স্বাভাবিক বিকাশের পথ খোঁজা হয় না। অথচ বাকস্বাধীনতা মানুষের জীবনের স্বাভাবিক বিকাশের একটি অংশ। কোনো রাষ্ট্র ও সমাজ যখন শতভাগ মানুষের স্বাভাবিক বিকাশের লক্ষ্যে এগোয় তখনই বাকস্বাধীনতা স্বাভাবিকভাবে ওই সমাজে, রাষ্ট্রে ও মানুষের জীবনাচরণে প্রকাশ পেতে থাকে।
আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র যে ওই লক্ষ্যে কখনই এগোয়নি তার প্রমাণ আমাদের সমাজ বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ নয়। বুদ্ধি দ্বারা, জ্ঞান দ্বারা সমাজ নিয়ন্ত্রিত নয়। সমাজ নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা দ্বারা, অর্থ দ্বারা। যে সমাজ ক্ষমতা ও অর্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ওই সমাজের মানুষের উপলব্ধিতে বাকস্বাধীনতা থাকে না।
প্রায় তিনশ বছরের ইতিহাস যদি পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে এখানে রাষ্ট্র ও সমাজে এমন কোনো সময় আসেনি, এমন কোনো রেনেসাঁ হয়নি যার ফলে আজ পশ্চিমা বিশ্ব যে বাকস্বাধীনতা ভোগ করছে, বাকস্বাধীনতার ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠছে, তা আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে আসবে।
এ কারণে সত্যি অর্থে উনবিংশ শতাব্দী থেকে ইউরোপ ও আমেরিকা বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বলে সেখানে ধীরে ধীরে বাকস্বাধীনতার বিকাশ ঘটিয়ে আজ তারা এ পর্যায়ে এসেছে। শতভাগ পৌঁছাতে পারেনি ঠিকই, তারপরেও তারা অনেক দূর এগিয়েছে। ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকার ফলে ১৯৪৭ এর আগ অবধি এই উপমহাদেশের কিছু মানুষ পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাই কিছু মানুষ নিজেকে জ্ঞান দ্বারা ও উপলব্ধি দ্বারা পরিচালিত করতেন। তবে সেটা ছিল রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু মানুষ। গোটা সমাজে তাদের প্রভাব ছিল খুবই কম। তারপরেও তাদের একটা প্রভাব অন্তত সমাজের একটি স্তর দিয়ে ক্ষীণ ধারায় হলে প্রবাহিত হয়েছিল। তাদেরই শেষ ধারা ছিলেন আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বদানকারী বুদ্ধিজীবীগণ। তবে তারা ওই অর্থে সমাজকে কোনো পরিবর্তন করতে পারেননি। সম্ভবও হয় না।
এইসব মিলে আমাদের প্রায় তিনশ বছরের ইতিহাস যদি পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে এখানে রাষ্ট্র ও সমাজে এমন কোনো সময় আসেনি, এমন কোনো রেনেসাঁ হয়নি যার ফলে আজ পশ্চিমা বিশ্ব যে বাকস্বাধীনতা ভোগ করছে, বাকস্বাধীনতার ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠছে, তা আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে আসবে এবং এটাও সত্য, আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিচিন্তার ভেতরও ওই বাকস্বাধীনতার রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার কোনো তাগিদ বর্তমানেও নেই।
আমাদের মূল তাগিদ, বলা যেতে পারে একমাত্র তাগিদ অর্থনৈতিক উন্নয়ন। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ দেয় না, বাকস্বাধীনতার সমাজ দেয় না তার প্রমাণ খুঁজতে এখন আর খুব বেশি দূরে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। নিকট প্রতিবেশী চীন ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো দেখলেই দেখতে পাচ্ছি, তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে ঠিকই, তাদের সমাজ প্রযুক্তিতে উন্নত। এমনকি প্রযুক্তি জ্ঞানেও উন্নত। কিন্তু মনোজাগতিক বিকাশের স্বাধীন সমাজ তাদের নয়। আর মনোজাগতিক বিকাশের স্বাধীন সমাজ না হলে সেখানে বাকস্বাধীনতার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি তারা বোঝেও না কোনটা বাকস্বাধীনতা। তাদের উপলব্ধি সেখানে পৌঁছায় না।
তাই এ উপলব্ধি এবং বাস্তবতা থেকে এ সত্য বলা যায়, পশ্চিমা বিশ্ব যে বাকস্বাধীনতা ভোগ করছে বা তারা তাদের জীবনাচরণে যে বাকস্বাধীনতাকে স্থান দিয়েছে, আমরা তার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে আছি। তাই আমাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রকৃত বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে, মনোজগতে স্থাপন করতে হলে-আগামী প্রজন্মকে মুক্তির সংগ্রাম শুরু করতে হবে। তারপরে কোনো প্রজন্ম যদি সে সংগ্রামে সফল হয়, তাহলে একটি মুক্ত সংস্কৃতির সমাজের যাত্রা হবে। ওই যাত্রা পথে একদিন বাকস্বাধীনতার রাষ্ট্র ও সমাজে পৌঁছানো সম্ভব হবে। যেখানে বাকস্বাধীনতা একটি সংস্কৃতি হিসেবেই চিহ্নিত হবে।
স্বদেশ রায় ।। সিইও এবং সম্পাদক, সারাক্ষণ মিডিয়া লিমিটেড