দুর্ঘটনা নাকি খুন?
এ লেখা শুরু করব ভেবেছিলাম সম্প্রতি ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের আগুন নিয়ে। লিখতে বসার সময়ই জানলাম নারায়ণগঞ্জ উপজেলায় বুধবার সকালে লঞ্চের ধাক্কায় ধলেশ্বরী নদীতে যাত্রীবাহী একটি ট্রলার ডুবে অন্তত ১২জন যাত্রী নিখোঁজ হয়ে গেছেন।
নৌযান, লঞ্চ বা নৌকা ডুবে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ প্রতিবছর নাই হয়ে যায়। এর সাথে সম্প্রতি যুক্ত হলো মাঝ নদীতে লঞ্চে আগুন। সম্প্রতি ঢাকার সদরঘাট থেকে শত শত যাত্রী নিয়ে বরগুনার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অভিযান-১০ নামের লঞ্চটি। লঞ্চটি বরিশাল ঘাট ধরে বরগুনা যাওয়ার পথে রাত দু’টার দিকে আগুন ধরে যায়। মারা যায় ৪০ জনের মতো মানুষ।
প্রতিটি ঘটনায় মানুষের আর্তনাদ, হৈ-চৈ আর চিৎকারে অবর্ণনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কিন্তু মানুষের বিলাপ যেখানে আঘাত করার কথা সেরকম হৃদয় নেই এদেশে। কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে সংবাদমাধ্যমে নানা বিবৃতি, সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষী রেখে ক্ষতিগ্রস্তদের কিছু আর্থিক সাহায্য এবং প্রশাসনের কিছু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ ছাড়া কাজের কাজ কিছু হয় না। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রশাসন যেটা করে তা হলো, একজন দুর্বল লোক খুঁজে তাকে বদলি করা, দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ খোঁজার চেষ্টা কখনো আর হয় না।
আমাদের দেশে নদীকে কেন্দ্র করেই হাজার হাজার মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া দেশের বড় একটি অংশের মানুষের যাতায়াতের একটি অন্যতম মাধ্যম নৌপথ। তুলনামূলকভাবে খরচ কম এবং আরামদায়ক হওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বহু মানুষ যাতায়াতের জন্য নৌপথকে বেছে নেয়।
তুলনামূলকভাবে খরচ কম এবং আরামদায়ক হওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বহু মানুষ যাতায়াতের জন্য নৌপথকে বেছে নেয়। যাতায়াতের সবচেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক এ পথটি এখন সড়কের মতো অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা।
যাতায়াতের সবচেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক এ পথটি এখন সড়কের মতো অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় শতশত মানুষের আহত হওয়ার পাশাপাশি প্রাণহানিও ঘটছে। তবে নদীর মাঝে আগুন লাগার ঘটনা এটাই হয়তো প্রথম।
নদীবক্ষে যাত্রীদের নিরাপত্তার বালাই নেই বাংলাদেশে। বিভিন্ন সময় বড় বড় সব নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে, অসংখ্য মানুষ মারা যায়, তদন্ত কমিটি হয় এবং অনেক কারণও শনাক্ত হয়। লঞ্চ চালকের অদক্ষতা, লঞ্চের কারিগরি ত্রুটি, ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ-তিনগুণ যাত্রী বহন, চলার পথে লঞ্চগুলোর মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা, ফিটনেসের অভাব, বেপরোয়াভাবে লঞ্চ চালানো, পর্যাপ্ত লাইফবয়া না থাকা ইত্যাদি কারণ সবারই জানা। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত চালকের অদক্ষতা ও ত্রুটিপূর্ণ যানের কারণে।
বাংলাদেশের অনেক বদনামের একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু মানুষের সৃষ্ট সবচেয়ে বড় শাস্তির একটি হলো নৌ-দুঘটনা। বড় বড় দুর্ঘটনা ছাড়া ছোটখাটো দুর্ঘটনা নৌপথে লেগেই থাকে। নৌপথে দুর্ঘটনা না কমার অন্যতম কারণ প্রশাসনের গাফিলতি। একটা করে ঘটনা ঘটে, নানা রকম সতর্কতামূলক কথাবার্তা হয়, তারপর সব ভুলে যাওয়া হয়।
দুর্ঘটনা ঘটে, প্রশাসন বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করে, কিছুদিন পর আবার সব থেমে যায়। দেশের একমাত্র নৌ আদালতে মামলা ঝুলছে প্রায় ২০০০। মামলা হলেও বিচার না হওয়ার কারণের মধ্যে আছে রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতা কিংবা সাক্ষী হাজির করতে না পারা।
সবচেয়ে বড় দুর্বলতা নজরদারির অভাব। ঈদে বা অন্য যেকোনো উৎসবে ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী নিয়ে নৌকা বা লঞ্চ চলা, লাইফ জ্যাকেট না থাকা, পুরনো লঞ্চ রং করে চলা, সবই হয় চোখের সমানে। যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি কখনো দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা বা প্রশাসন এবং লঞ্চ ব্যবসায়ীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটি একটি জাতীয় উদাসীনতা।
দেশের একমাত্র নৌ আদালতে মামলা ঝুলছে প্রায় ২০০০। মামলা হলেও বিচার না হওয়ার কারণের মধ্যে আছে রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতা কিংবা সাক্ষী হাজির করতে না পারা।
মত্ত মালিক বা চালকের উন্মাদনায় কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, কত পরিবার শেষ হয়ে গেছে তার জন্য কোথাও কোনো ভাবনা নেই। নেই এ কারণে যে, এসব পথে চলাচল করে অতি সাধারণ মানুষ যাদের সামান্য নাগরিক অধিকার এই রাষ্ট্রে নেই।
নৌ-দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যেমন, চালককে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে তারপর তা প্রদান করতে হবে। সেই সঙ্গে সব অনুমোদনহীন যান অপসারণ করতে হবে। নৌযান দুর্ঘটনার কবলে পড়লে যাত্রীদের কী করণীয়-এ বিষয়ে যাত্রার আগেই অবহিত করতে হবে। জীবন রক্ষাকারী সব উপকরণ সংরক্ষিত আছে কি না, যাত্রার আগে তা ভালোভাবে দেখে নিতে হবে।
ছোট দেশে অসংখ্য মানুষ। তাই যাত্রীর অভাব নেই। বি পুল যাত্রী সমাগম। লঞ্চ টার্মিনালে, নদীবন্দরে অস্বাভাবিক ভিড়। তুমুল বিশৃঙ্খলা। এরপর কোথাও না কোথাও লঞ্চ ডুবে যাওয়া। নৌকা তলিয়ে যাওয়া। অনেক হতাহত—এই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। এবং এর সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে চলছে মন্ত্রী-এমপি আর কর্মকর্তাদের বাক্যবিন্যাস—‘অত্যন্ত দুঃখজনক’, ‘দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা’, ‘আমরা সব বিষয় পর্যালোচনা করে দেখছি, খতিয়ে দেখছি, কীভাবে এই ধরনের দুর্ঘটনা ভবিষ্যতে প্রতিরোধ করা যায় তার ব্যবস্থা করছি’ ইত্যাদি। এবারের লঞ্চ আগুনের ঘটনায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু ভুক্তভোগী মানুষ জানে, ভবিষ্যতে যদি এমন ঘটনা আবার ঘটে, আবারও একই গান বাজবে।
কার্যত প্রতি বছর দেশের নানা স্থানে এমন দুর্ঘটনার কাহিনি রচিত হয়। প্রশাসনের চেতনা উদ্রেকের জন্য আরও কত হাজার মৃত্যু দরকার সেটা আমরা জানি না। এই ঘটনাগুলোকে দুর্ঘটনা বলার কোনো অর্থই হয় না। স্রেফ খুন এগুলো।
এদেশের লঞ্চ ব্যবসায়ীরা যে নিয়ম মেনে চলে না এবং এসব নিয়ন্ত্রণের আয়োজনে যে ধরনের শিথিলতা থাকে, তাতে এমন প্রাণঘাতী ঘটনা যে আরও অনেক হয় না, বলা যায় সেটাই বরং অতি বিস্ময়কর দুর্ঘটনা।
প্রশাসনকে যদি ভাবতে হয়, সমস্যার মূলে গিয়ে ভাবতে হবে। সব ঘটনা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে হবে। তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন যথার্থ প্রশাসন। সেখানেই সংকট আমাদের।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি