জলদস্যুতার সংবাদ : কিছু কথা, কিছু অভিজ্ঞতা
সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া। গত ১৬ নভেম্বর সন্ধ্যার পর একটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেখানে। মুসা নামের ত্রিশ বছরের এক জেলেকে হত্যা করা হয়েছে গুলি করে। ঘটনাটি ঘটেছে আনুমানিক রাত নয়টার দিকে। এফবি বাবুল নামের মাছ ধরার ট্রলারের জেলেরা মান্দারবাড়িয়াতে মাছ ধরছিলেন। সেখান থেকে সরাসরি পাথরঘাটায় ফিরে আসে ট্রলারটি। মৃতদেহটি বইতে নিশ্চয়ই সহকর্মীদের খুব কষ্ট হয়েছে। স্বজনের মৃত্যু, স্বজনের কষ্টের কথা বলাই বাহুল্য।
১৭ নভেম্বর পাথরঘাটার সাংবাদিকদের কাছে আগের রাতের সেই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন ট্রলার মাঝিসহ প্রত্যক্ষদর্শীরা। বিভিন্ন অনলাইন ও ফেসবুক পেইজে সরাসরি সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনাও করেছেন তারা। বলা হয়েছে, মান্দারবাড়িয়া মাছ ধরছিলেন। রাতের বেলা হঠাৎ একটি ট্রলার এসে আক্রমণ করে। গুলি করে হত্যা করে মুসাকে। অন্যদেরও নির্যাতন করা হয়, লুটপাট করা হয় ট্রলারের মাছ ও মালামাল। ঘটনার বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ঘটনা যা জানা গেছে, তার পুরোটাই প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি ঘটনাটি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। প্রথমত, যেই জায়গায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে বলা হচ্ছে, সেখানে মাছ ধরা নিষেধ। অভয়াশ্রম হওয়ায় সেই অঞ্চলে মাছ ধরা দূরের কথা, প্রবেশ ও অবস্থান করারও নিয়ম নেই। আর সেই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আমরা না জানলেও জেলেরা জানেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই নিষিদ্ধ এলাকায় তারা কেন গিয়েছেন? তারা কি জেনেশুনেই গিয়েছেন? ১৬ তারিখের রাতের কথিত ডাকাতি ঘটনার বিষয়ে কি আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ হয়েছে?
একটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে? কোনো মামলা কি হয়েছে? মামলা হোক বা না হোক নিহত মুসার সহযাত্রী আর ট্রলার মালিক সমিতির নেতাদের বক্তব্য নিয়ে সংবাদ হয়েছে দেশের সব গণমাধ্যমে। সুন্দরবনের আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের সংশ্লিষ্টতাও খুঁজেছেন কেউ কেউ। কিন্তু দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে আবারও দস্যুতা কারা ঘটালো সেই প্রশ্নের উত্তর কোথাও নেই।
দস্যুমুক্ত সুন্দরবন নিয়ে কেউ কেউ অখুশি। বিশেষ করে দস্যুদের পৃষ্ঠপোষক ও সুবিধাভোগীরা চান, যেন সেই অস্থির সুন্দরবন আবারও ফিরে আসুক। পুরনো দস্যুদের টার্গেট করে আবারও সুন্দরবনে ফেরানোর অপচেষ্টা চলছে সবসময়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সর্বশেষ দস্যুতায় ব্যবহৃত ট্রলারটি ভারতের। তাই যদি হয়, তবে তার সঙ্গে সুন্দরবনের সাবেক দস্যুদের সম্পর্ক কীভাবে থাকে? আইনশৃঙ্খলা সংস্থার কোনো পক্ষ থেকেও আমরা পরিষ্কারভাবে জানতে পারিনি আসলে কী হয়েছিল সেই রাতে। তবে সেই খবর দ্রুত ছড়িয়েছে উপকূল জুড়ে। আতঙ্ক ছড়িয়েছে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের মাঝে।
এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু পরের কয়েক দিনে পাথরঘাটা ও মহিপুর সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে পরপর কয়েকটি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে দস্যুরা। নড়ে চড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলো। অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে গ্রেফতার করে র্যাব।
দস্যুতার টাকা আদানপ্রদান করার দায়ে গ্রেফতার করা হয় নারায়ণগঞ্জের একজন বিকাশ ব্যবসায়ীকে। এরপর আরেক দফা অভিযান চলে। বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয় একজন। এরপর পাথরঘাটায় যান র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। মাছ ব্যবসায়ী ও ট্রলার মালিকদের আশ্বস্ত করেন তিনি। বলেন, কোনোভাবেই উপকূলে কাউকে দস্যুতা করতে দেওয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা সংস্থার এই তৎপরতা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
এবার পশ্চিম সাগরে জলদস্যুতা আর এই ঘটনায় প্রচারিত সংবাদ নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ।
সাম্প্রতিক দস্যুতার ঘটনাগুলো নিয়ে প্রচারিত সংবাদগুলো নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন ছিল। গেল কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের হেডলাইন দেখছি।
বলা হচ্ছে, ‘সুন্দরবনের আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুরা তৎপর হয়ে উঠেছে গভীর সমুদ্রে’। প্রায় একই ধরনের হেডলাইন দিয়ে সংবাদ দেখছি বিভিন্ন গণমাধ্যমে। দীর্ঘদিন মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা, আমার সোর্সদের তথ্য থেকে আমি সেই বাস্তবতা দেখছি না। সাগরে সাম্প্রতিক দস্যুতার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়াদের মধ্যে কি একজনও আত্মসমর্পণ করা দস্যু ছিলেন? সংঘটিত দস্যুতায় সুন্দরবনের সাবেক জলদস্যুদের নামও কি এসেছে কোনো তথ্যে? তাহলে প্রতিটি সংবাদের শিরোনাম এমন হচ্ছে কেন? একজন নাগরিক হিসেবে এই প্রশ্নগুলো রাখছি।
দস্যুমুক্ত সুন্দরবন নিয়ে কেউ কেউ অখুশি। বিশেষ করে দস্যুদের পৃষ্ঠপোষক ও সুবিধাভোগীরা চান, যেন সেই অস্থির সুন্দরবন আবারও ফিরে আসুক। পুরনো দস্যুদের টার্গেট করে আবারও সুন্দরবনে ফেরানোর অপচেষ্টা চলছে সবসময়। এতে করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। সেই আতঙ্ক পুঁজি করে পুরনো সেই চক্রের নড়াচড়া শুরু হয়েছে।
বন উপকূলে দস্যুতা প্রচলিত অপরাধ। সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে বলে যে আর এই উপকূলে দস্যুতা ফিরবে না তা বলা যাবে না। তবে এ নিয়ে অমূলক ভীতি ছড়ানোরও সুযোগ নেই। ব্যাকরণ আর মাঠের বাস্তবতা মিলিয়েই জলদস্যুতার সংবাদগুলো হওয়া উচিৎ। তা না হলে যে ভীতি ছড়াবে তার সুবিধা নিবে একটি পক্ষ। আমাদের মনে রাখা উচিত, উপকূলে ভয় বাড়লে মহাজনদের ব্যবসা বাড়ে। ভয় বাড়লে বিপদ বাড়ে জেলেদের।
আত্মসমর্পণ করা বনদস্যুদের নিয়ে অনেকেই দুশ্চিন্তায় থাকেন। কেউ কেউ মনে করেন যে, পুরনো অপরাধীরাই আবারও ফিরবে আগের অপরাধ জীবনে। কিন্তু আমি দেখছি ভিন্ন চিত্র। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা এই মানুষগুলো নতুন জীবন পেয়েছেন। তাই শত কষ্টের মধ্যেও তারা আবার দস্যুতায় ফিরে যাওয়ার চিন্তা করেন না।
বন উপকূলে দস্যুতা প্রচলিত অপরাধ। সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে বলে যে আর এই উপকূলে দস্যুতা ফিরবে না তা বলা যাবে না। তবে এ নিয়ে অমূলক ভীতি ছড়ানোরও সুযোগ নেই।
তবে অভাবে স্বভাব নষ্ট বলে একটি কথা আছে। সেক্ষেত্রে তাদের সঠিকভাবে পুনর্বাসন করা না গেলে হয়তো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে তারা। তবে সেই অপরাধ জীবন যে বনদস্যু জীবন হবে তা বলা যাবে না।
দুই জীবনের পার্থক্য বুঝে তারা সেই দুঃসহ জঙ্গল জীবনে ফিরে যেতে চায় না কিছুতেই। এক্ষেত্রে লোকালয়ের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। কয়েকজন সাবেক দস্যু নানা অপরাধে জড়িয়েছেও। অন্যদিকে তিনজন সাবেক দস্যু আবারও বনদস্যুতায় ফিরেছিল। তাদের মধ্যে দুই জনের মৃত্যু হয়েছে বন্দুক যুদ্ধে। একজন পলাতক।
সম্প্রতি ফজলু নামের আরেকজন আত্মসমর্পণ করা বনদস্যু আবারও বনদস্যুতায় নেমেছে বলে জানতে পারছি। তবে সেই খবর শতভাগ নিশ্চিত নয়। এই চারজন সাবেক বনদস্যুর বিপথে যাওয়ায় পুরো আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় কি?
সুন্দরবনের আত্মসমর্পণ করা বনদস্যুদের দেখভাল করছে সরকার। প্রত্যেকের খবর রাখছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন। তাদের পুনর্বাসনের কাজও চলছে। সেই উদাহরণ ছড়িয়েছে অন্য উপকূলেও। এক সময়ের সন্ত্রস্ত উপকূল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের অনেকেই আত্মসমর্পণ করেছে। এখনো কিছু অপচেষ্টা আছে, থাকবেও। তবে সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত নজরদারি থাকলে সেই অপচেষ্টাগুলো ব্যর্থ হবে।
মোহসীন-উল হাকিম ।। সাংবাদিক