কক্সবাজারে পর্যটকদের নিরাপত্তা কেন জরুরি
সম্প্রতি কক্সবাজারে এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, চুরি-ছিনতাই, প্রতারক চক্রের উৎপাত এবং নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। ধর্ষকদের সকলকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় নিরাপত্তার ইস্যুতে অনেকেই এখন কক্সবাজার বর্জনের ঘোষণা দিচ্ছেন। তবে কক্সবাজার বর্জন না করে কীভাবে নারী পর্যটকসহ অন্যান্য পর্যটকদের জন্য অধিক নিরাপদ ও সুরক্ষিত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যায় তার উপর গুরুত্ব আরোপ করা দরকার।
অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশে পর্যটনের অন্যতম শহর কক্সবাজার। যার দিগন্ত জুড়ে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। সমুদ্রের সৌন্দর্য ও সূর্যাস্ত অবলোকন করার জন্য প্রতি বছর লাখ লাখ দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের ঢল নামে শীতকালে (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত)।
পর্যটকরা দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, মেরিন ড্রাইভ, পাহাড়-ঝর্ণা, নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার পর নিয়ে যান কিছু স্মৃতি আর রেখে যান কিছু ভালোলাগার মুহূর্ত। অফুরন্ত পর্যটন সম্ভাবনার এই কক্সবাজারে বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যা। বিমানবন্দর থেকে শহরের রাস্তার দৈন্যদশা, অপরিকল্পিত পর্যটন স্থাপনা, নিরাপত্তার শঙ্কা যা পর্যটন বিকাশের জন্য অশনিসংকেত। দেশি ও বিদেশি পর্যটকরা ভ্রমণ করার ক্ষেত্রে তারা নিরাপত্তাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে ভ্রমণ করেন যেন বিরূপ পরিস্থিতির শিকার না হন।
অফুরন্ত পর্যটন সম্ভাবনার এই কক্সবাজারে বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যা। বিমানবন্দর থেকে শহরের রাস্তার দৈন্যদশা, অপরিকল্পিত পর্যটন স্থাপনা, নিরাপত্তার শঙ্কা যা পর্যটন বিকাশের জন্য অশনিসংকেত।
পর্যটন মৌসুমে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে সক্ষমতার চেয়ে পর্যটক সংখ্যা বেশি হওয়ায় স্থানীয় হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম তিনগুণ বেশি, আবাসন খরচ দুইগুণ বেশি রাখার ফলে অনেক পর্যটক তিনদিন থাকার পরিকল্পনা করে গিয়েছিলেন কিন্তু দুইদিন পর তারা ফেরত এসেছেন।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ অর্জন ও করোনা পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সমগ্র বিশ্বজুড়ে যে পাঁচটি সেক্টরকে চিহ্নিত করা হয়েছে তন্মধ্যে অভ্যন্তরীণ পর্যটন উল্লেখযোগ্য। কক্সবাজারে প্রায় ৭০০ হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউজ, কটেজ ও রেস্তোরাঁয় কর্মরত আছেন প্রায় ৪০ হাজার কর্মচারী যার আয় দিয়ে চলে তাদের পরিবার।
করোনার প্রভাবে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে টানা পাঁচ মাস হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ ছিল। ১৭ আগস্টের পর হোটেল ও রেস্তোরাঁ সীমিত আকারে খুলে দেওয়ার পরে ২০২১ সালের মার্চ মাসে লকডাউনের ফলে বন্ধ হয় দেশের সকল পর্যটন কেন্দ্র। এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে আবার সীমিত পরিসরে পুনরায় শুরু হয় পর্যটন কেন্দ্র।
ইতিমধ্যে অভ্যন্তরীণ পর্যটন বেশ জমজমাট, যার ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। যখনই কক্সবাজার জমতে শুরু করেছে পর্যটন তখনই বাধ সেজেছে নানাবিধ সমস্যায়, যার ফলশ্রুতিতে পর্যটক সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং এর প্রভাব পড়বে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আয়, কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রার মানে।
পর্যটক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে হবে। পর্যটকদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য হোটেল, মোটেল, রির্সোট, রেস্তোরাঁ মালিকদের পর্যটক নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব জনবল থাকতে হবে। খাবারে গুণগত মান বজায় রাখতে হবে। সেই খাবারের মান ও দামের মধ্যে সামঞ্জস্যতা থাকতে হবে।
আবাসন খরচ পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের তুলনা কম হতে হবে। তা হলে দেশি ও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করা সহজ হবে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তদারকি ও নজরদারী আরও বাড়ানো দরকার। প্রতারক চক্রের উৎপাত বন্ধ করার জন্য কক্সবাজার এলাকার আকর্ষণীয় স্থানগুলোকে সিসি টিভির আওতাভুক্ত করা জরুরি।
নিরাপত্তাকে ইস্যু করে নিরুৎসাহিত না করে পর্যটন কেন্দ্রে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলে পর্যটকদের মনে আস্থা বজায় থাকবে।
হোটেলগুলোতে রুম বরাদ্দের ক্ষেত্রে অতিথির এনআইডি ফটোকপি, মোবাইল নাম্বর, গেস্ট ইনফরমেশন ফরম পূরণ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে পর্যটকবান্ধব হতে হবে অন্যথায় পর্যটকরা কক্সবাজার না ভ্রমণ করে ভ্রমণ করার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাবে।
নিরাপত্তার জন্য টুরিস্ট পুলিশ ও জেলা পুলিশকে আরও বেশি পর্যটকবান্ধব সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। নিরাপত্তাকে ইস্যু করে নিরুৎসাহিত না করে পর্যটন কেন্দ্রে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলে পর্যটকদের মনে আস্থা বজায় থাকবে।
কক্সবাজার পর্যটন শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার চার লেন মহাসড়ক, সোনাদিয়া ইকো পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক, সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক বাস্তবায়িত হলে অনেকদূর এগিয়ে যাবে পর্যটন।
কক্সবাজার সৈকত, পাথুরে বিচ ইনানী, হিমছড়ির পাহাড়ি ঝর্ণা, প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, সোনাদিয়া দ্বীপ, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, শহরের বৌদ্ধমন্দিরসহ জেলার পর্যটন স্পটগুলোর সৌন্দর্যবর্ধন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হলে কক্সবাজার পরিণত হবে পর্যটনবান্ধব নগরীতে এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন বাড়বে, সেই সাথে বৃদ্ধি পাবে সরকারি রাজস্ব আয় কোটি কোটি টাকা।
ড. সন্তোষ কুমার দেব ।। চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়