রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ : অগ্রজ সহযোদ্ধার প্রয়াণে
মহামারি করোনা তার অকরুণ হাতে আমাদের অনেক প্রিয়জনকে ছিনিয়ে নিয়েছে। পঁচিশ ডিসেম্বর দুপুরে আমাদের ব্যথিত করে চলে গেলেন প্রিয় রিয়াজ ভাই। আমার একান্ত সুহৃদ, স্বজন অভিভাবকতুল্য বড় ভাই। ভাই হারানোর বেদনা অনুভব করছি তার এ মৃত্যুতে।
আমার করোনাক্রান্ত দিনগুলোয় যিনি আমাকে অভয় দিয়েছেন, খবর নিয়েছেন আজ তিনিই চলে গেলেন। করোনা তাকেও ছিনিয়ে নিল। তার বর্ণাঢ্য জীবনের কথা, নিভৃত কর্মবীর সংগঠকের কৃতিত্বপূর্ণ জীবনের কথা দলমত নির্বিশেষে সাংবাদিকতা অঙ্গনের সবারই জানা। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ এ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এ দেশের সাংবাদিকতাকে যারা ‘ব্রত’ থেকে ‘পেশাদারি’তে উন্নীত করেছেন, তাদের অন্যতম একজন।
ব্যক্তিজীবনে তিনি যেমন পেশাদারি সাংবাদিকতার শীর্ষে অবস্থান করেছেন, তেমনই সাংবাদিকতার সেই ‘ব্রত আদর্শের’ও ‘ব্রতী’ই ছিলেন-অনেকের জন্যই এ দুই অবস্থান দুই বৈপরীত্যকে মেলানো বোধকরি কঠিন; কিন্তু আমার মনে হয় তিনি সেটা পেরেছিলেন বলেই অবিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা অবিভক্তই ছিলেন বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের পেশাগত সহযোদ্ধাদের কাছে। এর প্রমাণ তার প্রয়াণে অকুণ্ঠচিত্তে সবার শোকজ্ঞাপন, শোক প্রকাশ-এটাই তার ‘অজাতশত্রু’ ব্যক্তিত্বের সার্থকতা।
সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তির দীর্ঘ কর্মজীবনের শুরু ১৯৬৮ সালে ‘দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার’-এ। ১৯৭১-এ চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। যুদ্ধ শেষে আবারও ফিরেছেন ‘বাংলাদেশ অবজারভার’-এ।
আমার করোনাক্রান্ত দিনগুলোয় যিনি আমাকে অভয় দিয়েছেন, খবর নিয়েছেন আজ তিনিই চলে গেলেন। করোনা তাকেও ছিনিয়ে নিল।
তিনি ইংরেজি দৈনিক ‘ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস’-এর সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন ‘নিউজ টুডে’র প্রকাশক ও সম্পাদক। তার সঙ্গে আমার পেশাগত সম্পর্ক বেশ দীর্ঘদিনেরই। আমি ‘অবজারভার ভবন’ থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক কিশোর বাংলা’য় কর্মজীবন শুরু করি। আমাদের তারুণ্যে তারা ছিলেন আমাদের কাছে এ পেশার আইডল।
এ সুদীর্ঘ সময়ের স্মৃতি খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাকে ব্যথিত করেছে। তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি, পেশার ভেতরে, পেশার বাইরে, জাতীয় প্রেস ক্লাবের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। তাদের কাছ থেকেই তো আমরা অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছি।
রিয়াজ ভাইকে দেখেছি তিনি তরুণদের কাছ থেকেও জানতে-শিখতে চেয়েছেন-যাকে বলে পরম্পরা, সেই বোধটি অনুভব করতাম তার সাহচর্যে, তার সঙ্গে কাজে, তার উপস্থিতিতে-আজ সেই পরম্পরা বোধের জায়গাটিতে শূন্যতা অনুভব করছি।
তার সঙ্গে মতের দ্বিমত হয়েছে, নানা করণে, হয়তো ক্লাবের ঠিক বিপরীত চেয়ারে অবস্থান করেছি। কিন্তু মানবিক সম্পর্কের ঘাটতি হয়নি।
সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তির দীর্ঘ কর্মজীবনের শুরু ১৯৬৮ সালে ‘দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার’-এ। ১৯৭১-এ চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। যুদ্ধ শেষে আবারও ফিরেছেন ‘বাংলাদেশ অবজারভার’-এ।
মতানৈক্য দুজন মানুষের মধ্যে দূরত্ব বাড়ায় না-সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের জীবনে এ অনেক বড় সত্য। ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে তার সঙ্গে আমার জানাশোনা। ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয় ১৯৭৯-১৯৮০ সাল থেকে। চারবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন রিয়াজ ভাই। প্রথম দু’দফায় আমি তার সঙ্গে জাতীয় প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
জাতীয় প্রেস ক্লাবকে আমরা সাংবাদিকদের ‘সেকেন্ড হোম’ বলি-এ ‘দ্বিতীয় গৃহ’ নির্মাণের বোধটির মধ্যেও তার অবদান অনেক। তারপর যত দিন গেছে, আমাদের সম্পর্ক তত গভীর হয়েছে। তার অপার স্নেহ পেয়েছি। দৃঢ়তর হয়েছে ভালোবাসার বন্ধন। তিনি কয়েক দফা অবিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের শীর্ষপদ অলংকৃত করেছেন। সম্পূর্ণ পেশাদারি বজায় রেখেছিলেন একজন অনুকরণীয়, অনুসরণীয় সংগঠক। ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস।
অবজারভার ভবনের পর আমাদের একসঙ্গে রেখেছিল জাতীয় প্রেস ক্লাব। একত্রে থাকার একাত্মতায় আজ তার অনুপস্থিতি আমার মধ্যে শূন্যতাবোধের বেদনা জন্ম দিচ্ছে।
আমাদের দেশের মনস্বী লেখক চিন্তাবিদ ড. আহমদ শরীফ তার এক স্নেহাস্পদ এক ছাত্রকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘মন নামক পদার্থটি মিলনের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে, আর বিরোধে জেগে ওঠে।’ রিয়াজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এমনই বিরোধের স্পর্শে জেগে থাকার ছিল। আর সেই জেগে থাকা মনটি আবার আমাদের মধ্যে মিলনের সেতু গড়তে অনুপ্রাণিত করত। সেই সেতু গড়ার মধ্যেই ছিল এক অনন্য সজীবতা প্রাণবানতা।
আর একজন রিয়াজ ভাইয়ের জন্য হয়তো আমাদের অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে, আরও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।
সাইফুল আলম ।। সম্পাদক দৈনিক যুগান্তর, সাবেক সভাপতি জাতীয় প্রেস ক্লাব