সম্প্রীতি : মানবিক ও সামাজিক সংগঠনের ব্যর্থতা!
শারদীয় দুর্গাপূজার সময় আমি অসুস্থ ছিলাম, তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় তেমন আসতে পারিনি। ইনবক্সে আসা মেসেজও চেক করা হয়নি, শুধু ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলা নিয়ে মুখে মুখে বলার পর আমার মেয়ে আমার পক্ষে একটি ছোট্ট লেখা ফেসবুকে পোস্ট করেছিল। সুস্থ হওয়ার পর মেসেজ চেক করতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। একজন একটি প্রশ্ন করেছেন, কঠিন প্রশ্ন- ‘এই যে সংখ্যালঘুদের উপরে নির্বিচারে হামলা হলো, আপনারা যারা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন চলান তারা এসব প্রতিরোধে কী ভূমিকা পালন করেছেন?’
ধাক্কাটি একদম বুকে এসে লাগল। আসলেই তো আমরা কী করেছি? আমাদের প্লাটফর্মে প্রায় সাড়ে তিনলাখ সদস্য আছেন, যাদের প্রতিনিয়তই ধর্মীয় সহনশীলতা শেখানো হয় এবং আমাদের ধারণা এদের অধিকাংশ তাতে বিশ্বাস করেন। আমরা কি পারতাম না এ লাখ লাখ সদস্যকে এই অনাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির কাজে লাগাতে? আমরা কি আমাদের শিক্ষার্থীদের বলতে পারতাম না তোমরা পাড়ায় পাড়ায় কিংবা গ্রামে গ্রামে, যে যেখানে আছো সেখানে স্থানীয় শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের নিয়ে সংখ্যালঘুদের জানমাল রক্ষায় কাজ করো।
শুধু আমরা না, আমাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী সংগঠন দেশে আছে, যারা বিভিন্ন মানবিক বিপর্যয়ে মানুষের সেবায় এগিয়ে এসে অসীম শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন-তারাও কিন্তু সংখ্যালঘুদের এ বিপর্যয়ে তেমনভাবে এগিয়ে এসেছেন বলে আমার চোখে পড়েনি। তাহলে কি সংখ্যালঘুদের বিপদ, মানবিক বিপর্যয় নয়?
এ প্রশ্ন আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে- একই সাথে ব্যর্থতার প্লানি আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে। আমি কিছুতেই এ গ্লানি হতে মুক্ত হতে পারছি না।
বন্যা দুর্গতদের সাহায্যে যদি আমরা রাস্তায় নামতে পারি, করোনার সময় যদি বিপন্ন মানুষের সেবায় আমরা জীবন বাজি রেখে কাজ করতে পারি, তাহলে আমার পাশেই যখন হিন্দু প্রতিবেশীর বাড়িঘর জ্বালানো হলো, পূজামণ্ডপ ভেঙে দেওয়া হলো, তাদের হতাহত করা হলো তখন কেন আমরা চুপ রইলাম?
বন্যা দুর্গতদের সাহায্যে যদি আমরা রাস্তায় নামতে পারি, করোনার সময় যদি বিপন্ন মানুষের সেবায় আমরা জীবন বাজি রেখে কাজ করতে পারি, তাহলে আমার পাশেই যখন হিন্দু প্রতিবেশীর বাড়িঘর জ্বালানো হলো, পূজামণ্ডপ ভেঙে দেওয়া হলো, তাদের হতাহত করা হলো তখন কেন আমরা চুপ রইলাম? কেন আমাদের সাংগঠনিক শক্তি এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলাম না?
আমার মনে হয়, এ প্রশ্নের জবাব আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এটি বিরাট একটি আত্মজিজ্ঞাসার ব্যাপার। মানবিক সংগঠনগুলো এ জিজ্ঞাসায় যদি উত্তর খুঁজে না পান তবে বুঝতে হবে কোথাও গলদ আছে, যা এ মানবিক বিপর্যয়ে আমাদের মানবিক বোধকে নাড়া দেয়নি। সেক্ষেত্রে আমাদের বোধকে নতুন করে জাগ্রত করতে হবে। ইট নিডস টোটাল ওভারহলিং। আমার বিশ্বাস যে মহৎপ্রাণ মানুষেরা এসব সংগঠন চালান তারা এর গুরুত্ব বুঝবেন এবং এ ভুল আর করবেন না। এটি এমন একটি ভুল যা শুধু সংখ্যালঘু নয় যেকোনো বিবেকবান মানুষের কাছেই আমাদের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
আমরা সবসময় লক্ষ্য করেছি, কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ সবসময় সুযোগ পেলে এধরনের অন্যায় কাজ করে—তারা অপেক্ষাই করে কখন সংখ্যালঘুদের জানমালে হামলা করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করবে। এটা রোখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানবিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে কাজ করতে হবে।
এধরনের বিপর্যয়ে সংগঠনগুলোকে যেকোনো মত-পার্থক্য ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। কারণ দিনের শেষে সবার লক্ষ্য কিন্তু এক—তা হলো মানবসেবা এবং বিপন্ন মানুষের জানমাল রক্ষার চাইতে বড় আর কোনো সেবা নেই।
এদেশের অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মানুষ এসব জঘন্য কাজের বিরুদ্ধে, কিন্তু তারা সংঘবদ্ধ নন বলে এসব প্রতিরোধ করতে পারেন না। আমি নিশ্চিত সামাজিক সংগঠনগুলো এগিয়ে এলে এরা সাথে থাকবেন। সবশেষে ভবিষ্যতে এধরনের পরিস্থিতিতে সামাজিক সংগঠনগুলোর কিছু করণীয় সুপারিশ করছি—
১। যখনই এধরনের ঘটনা ঘটবে তখনই এসব সংগঠন প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে তাদের সদস্যদের স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা সংস্থার সাহায্য নিয়ে বিপন্নদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দেবেন। (দুষ্কৃতিকারীদের সাথে এসব স্বেচ্ছাসেবীরা পেরে উঠবে না, তাই আইনশৃঙ্খলা সংস্থার সাহায্য নিয়েই তাদের কাজ করতে হবে।)
২। এসব স্বেচ্ছাসেবী নিজ নিজ এলাকায় সচেতন এলাকাবাসীকে নিয়ে তাদের সংখ্যালঘু প্রতিবেশীদের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য কাজ করবেন। সচেতন মানুষের চেয়ে বড় অস্ত্র আর কিছু নেই।
৩। এধরনের বিপর্যয়ে সংগঠনগুলোকে যেকোনো মত-পার্থক্য ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। কারণ দিনের শেষে সবার লক্ষ্য কিন্তু এক—তা হলো মানবসেবা এবং বিপন্ন মানুষের জানমাল রক্ষার চাইতে বড় আর কোনো সেবা নেই।
৪। এরা সম্মিলিতভাবে প্রশাসনের উপর তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ‘প্রেসার গ্রুপ’ হিসেবে কাজ করতে পারেন।
৫। এরা স্থানীয় আলেম-উলেমাদের সাথে নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রচারণা চালাতে পারেন। আলেমদের কথা কিন্তু সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি শোনেন।
৬। শুধু বিপদের সময় নয়। এসব সংগঠন সারা বছর তাদের সদস্যদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রচারের কাজে লাগাতে পারেন। এসব স্বেচ্ছাসেবীরা যেহেতু মানুষের বিপদ-আপদে কাছে থাকেন তাই সমাজের মানসিক পরিবর্তনে এরা বিশাল ভূমিকা রাখতে পারেন।
এবার রক্তাক্ত শারদে মানবিক সংগঠনগুলো যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন ভবিষ্যতে যাতে তার পুনরাবৃত্তি না হয় তা কামনা করছি।
বাদল সৈয়দ ।। সমাজকর্মী ও কথাসাহিত্যিক