আবরার হত্যাকাণ্ড : কাঠগড়ায় ছাত্ররাজনীতি
এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ডের রায়। এই রায় নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে যার বেশিরভাগই ইতিবাচক। রায়ে কতজনের ফাঁসি হলো বা এই রায় কতটা ন্যায্য বা অন্যায্য হলো এই দিকটার চেয়েও আমার কাছে অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বুয়েটের মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এতগুলো মেধাবী মুখ আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
বুয়েটে যারা ভর্তি হয় তাদের কেউই মেধার দিক থেকে পিছিয়ে পড়া নয়। আর সেজন্যই জনমনে হা-হুতাশ একটু বেশিই। আবরার হত্যাকাণ্ড কি পুরোটাই বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বা এটা কি নিছকই একটি ব্যক্তি কেন্দ্রিক রেষারেষির ফল? তাহলে একটু চেষ্টা করি ঘটনার পেছনের ঘটনাগুলো কী ছিল সেটি বুঝতে।
আবরারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছিল সে মৌলবাদী রাজনীতির একজন ধারক-বাহক ছিল। সরাসরি বললে সে শিবিরের মতাদর্শে বিশ্বাসী একজন মানুষ ছিল বলেই অভিযোগ উঠেছিল। কেন উঠেছিল? এই জায়গাটি আমাদেরকে প্রশ্ন করতেই হবে।
আবরারের মৃত্যুর পর তার ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো আমরা দেখেছিলাম। সেখানে স্পষ্টতই ভারত বিদ্বেষী মনোভাবের প্রকাশ ছিল। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নৈতিক জায়গাকে সে প্রশ্নবিদ্ধ মনে করত। মূলত সেই সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের কিছু চুক্তির বিষয়ে সে তার মতামত প্রকাশ করেছিল এবং যে ভাষায় প্রকাশ করেছিল সেটি কোনো সাধারণ মতাদর্শের মানুষের মতো ছিল না। সন্দেহের জায়গাটা এখানেই। যদিও কারো হাতেই প্রমাণ ছিল না।
বাস্তবে ছাত্ররাজনীতির সেই সুসময় এখন আর নেই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ছিলাম। আমাদের সময়েও ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ আরও অনেক রাজনৈতিক দলের অবস্থান ছিল। চিরশত্রু ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ছিল...
এখন সবাই প্রশ্ন করতেই পারেন যে, শিবির করলেই কি একজন মানুষকে এমন পাশবিকভাবে মেরে ফেলতে হবে? অবশ্যই না। মেরে ফেলা যায় না। এটা অন্যায়। তাহলে কেউ শিবির করলে তাকে মোকাবিলা করতে হবে কী দিয়ে?
ধরা যাক, আবরারই কি প্রথম ব্যক্তি যে এমন মৌলবাদী ধারণায় বিশ্বাসী ছিল? বুয়েটে শিবিরের রাজনৈতিক অবস্থানের সংবাদ আমাদের কাছে কি নেই? তাহলে সেখানে শিবিরকে ঠেকানোর জন্য যে রাজনীতি, সেটা কোথায়? বা সেই রাজনৈতিক বিশ্বাসী মানুষগুলো কোথায়? কেন আবরারকে মেরে ফেলে শিবিরের রাজনীতিকে মোকাবিলা করতে হবে?
বাস্তবে ছাত্ররাজনীতির সেই সুসময় এখন আর নেই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ছিলাম। আমাদের সময়েও ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ আরও অনেক রাজনৈতিক দলের অবস্থান ছিল। চিরশত্রু ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ছিল। গোলাগুলি, মারামারি ছিল নিত্য ঘটনা। মূলত সেগুলো চলত হল দখল বা ক্যাম্পাসকে নিজেদের আয়ত্তে রাখার জন্য। এতসব ঘটনার পরেও যে যার দলের রাজনীতি নিজ বিশ্বাসে করত এবং সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে সেই আদর্শকে পৌঁছে দেওয়ার একটা চেষ্টা ছিল। ছিল রাজনৈতিক কর্মসূচি, যেখানে ছাত্রদের নিত্যদিনের সমস্যা কেন্দ্রিক আন্দোলনও ছিল। তবে উল্লেখযোগ্য হলো, ছাত্রদল, ছাত্রলীগ বা বাম ছাত্র সংগঠন করলেও প্রত্যেকের একটা জায়গায় কোনো বিরোধ ছিল না, সেটি হচ্ছে ক্যাম্পাসকে শিবিরমুক্ত রাখা। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, সেসময়কার প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই যখন শিবিরের সাথে লড়াই হতো তখন শিবির বিরোধী দলগুলো সবাই একজোট হয়ে মাঠে থাকত।
তাহলে আজকে কেন আবরারকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করা যাচ্ছে না? এর পেছনের কারণটি খুঁজে বের করা জরুরি। আসলে সবকিছুই আছে, নেই কেবল রাজনীতির চর্চা। ছাত্ররাও আছে, ছাত্রদের সমস্যাও আছে। জাতীয় ইস্যুরও কমতি নেই। কিন্তু দলগুলোর সেইসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মধ্যে এখন রাজনৈতিক পরিচয় কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি চর্চার জায়গা প্রধান হয়ে গেছে। আমরা জানি, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু গোপন কার্যক্রম চলতো অনেকের। হল কেন্দ্রিক কার্যক্রম ছিল শিবির ও লীগের। তারপরেও লীগের নেতারা কেন শিবিরকে প্রতিহত করতে পারল না? কাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সেখানে মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সাংগঠনিক কর্মসূচি বা কার্যক্রম চালাচ্ছে? রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই হোক না কেন, সবাই এখন সরকারি সংগঠনের কর্মীর পরিচয় ধারণ করে চলে।
সবকিছুই আছে, নেই কেবল রাজনীতির চর্চা। ছাত্ররাও আছে, ছাত্রদের সমস্যাও আছে। জাতীয় ইস্যুরও কমতি নেই। কিন্তু দলগুলোর সেইসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
মুখেমুখে মৌলবাদ রুখে দেওয়ার কথা বললেই চলে না। মাঠের কাজটি করতে হয়। আমাদের বর্তমান প্রজন্ম আজকে মারাত্মকভাবে আদর্শহীন পথের যাত্রী বা তারা দ্বিধাগ্রস্ত। তাদের সামনে নেই কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা, নেই কোনো আদর্শিক পথ। তাদের চিন্তার জগতে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো উপাদান নেই। এই সুযোগটা নিচ্ছে শিবিরের মতো মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠন। তারা রাজনীতি করে না কিন্তু তরুণদের মগজের মধ্যে ধর্মের আড়ালে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণাকে গেঁথে দিচ্ছে।
আবরারকে রাজনৈতিভাবে মোকাবিলা করা দরকার ছিল। আবরার যে বিশ্বাসের মানুষ ছিল সেটি যে আমাদের রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে সেই জায়গাটি প্রমাণ করার সুযোগ ছিল। আবরারের আদর্শিক জায়গা যে ভুল সেটি মোকাবিলা করা যেত সাধারণ ছাত্রদের মাঝে সঠিক ব্যাখ্যাটি প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু পারল না আমাদের ছাত্ররা। তারা কেন পারল না? এই প্রশ্নের উত্তরও জানতে হবে আজকের ও আগামীর বাংলাদেশের তারুণ্য নিয়ে চিন্তা করতে গেলে। পারেনি কারণ সেইসব ছাত্ররা নিজেরাও রাজনৈতিক শিক্ষাটুকু পায়নি। তাদের কাছে আদর্শিক লড়াইয়ের চেয়ে পেশির লড়াইয়ের কারিশমাটুকু আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।
মৌলবাদ আজকে আমাদের জাতীয় সমস্যা। এই সমস্যাকে মোকাবিলায় দরকার সামগ্রিক লড়াইয়ের কৌশল। মৌলবাদ একটি রাজনৈতিক বিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে ঠেকাতে দরকার পাল্টা বিশ্বাসী মানুষের সমাবেশ। সেই কাজটি করছি কি আমরা? না। ছাত্র রাজনীতি থেকে আদর্শের জায়গাটি হারিয়ে ফেলেছি আমরা।
আগে দল বা লীগের বাইরেও বাম দলগুলোর রাজনীতিও ছিল আদর্শিক। তারা সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী হলেও মৌলবাদের প্রশ্নে ছিল আপোষহীন। বর্তমানে তারাও দ্বিধা বা দ্বন্দ্বের মাঝে আটকে আছে। তারা সরকার বিরোধিতা করতে গিয়ে কখনো কখনো হয়ে পড়ছে মৌলবাদের সমর্থক।
আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কেন্দ্রিক সব ধরনের মত ও আদর্শের দুয়ার খুলে দিতে হবে। মুক্ত বাতাসের চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্ররা যুক্তি করবে, তর্ক করবে। নিজেদের বিশ্বাসকে যুক্তিতর্কের মাঝে জাস্টিফাই করতে শিখবে।
ধর্ম একটি জীবনাচরণ, একটি রাষ্ট্র কখনো ধর্মীয় বিশ্বাসের ধারক-বাহক হতে পারে না। ছাত্র রাজনীতির পুরনো প্যাটার্ন হয়তো ফিরে আসবে না। আসবে না সেটি একদম বাস্তব কারণেই কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চাকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।
আবরার হত্যার ঘটনায় আমরা সবাই আহত কারণ এতগুলো মেধাবী মুখ আজকে খুনি হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। অথচ এদেরই হওয়ার কথা ছিল আগামীর বাংলাদেশের কাণ্ডারি। তাই আমাদের নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। বুঝতে হবে কেন আবরারদের জন্ম হয় আর কেন আমাদের সন্তানেরা জীবনের মায়া না করে এমন ঘৃণ্য রাস্তায় পা বাড়ায়। এর দায় রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তি পর্যায়ের কেউই এড়াতে পারে না।
লীনা পারভীন ।। কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট