চীন যেভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হলো
ছেলেবেলায় হতদরিদ্র গ্রামে জীবনের একটা লম্বা সময় কাটিয়েছেন চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ১৯৬৯ সালের শুরুতে যখন বয়স মাত্র ১৬ বছর, তিনি ইয়ানআন অঞ্চলের সে গ্রামে পার্টির পক্ষ থেকে গ্রামবাসীর সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। রাজধানী বেইজিং থেকে হঠাৎ এমন হতদরিদ্র এলাকায় গিয়ে তিনি শুরুতে বড় ধরনের সমস্যায়ও পড়েছিলেন। গ্রামে কোনো বিজলি বাতি নেই। সন্ধ্যার পর মাত্র কয়েকটি বাড়িতে কেরোসিনের আলো মিটমিট করে জ্বলতে দেখা যায়। রাতে গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলে খানাখন্দতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এমন কঠিন অবস্থার সঙ্গে তিনি শেষ পর্যন্ত মানিয়ে নিয়েছিলেন।
কৃষিকাজে তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন না। তাকে সব শিখতে হয়েছে শূন্য থেকে। তখন মাসিক শ্রমের স্কোর হিসাব করে খাবার দেওয়া হতো। এ হিসাবের বাইরে ছিলেন না সি চিন পিং। বলা বাহুল্য, শুরুর দিকে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি দমে যাননি, হাল ছেড়ে দেননি। দুই/তিন বছরের মধ্যেই তিনি কৃষিকাজে দক্ষতা অর্জন করেন। একসময় তিনি ৫০ কেজি ওজনের বোঝা মাথায় নিয়ে ৫ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ অতিক্রম করা শিখলেন।
তখন কাজের স্কোর ১০ হলে মাত্র ৯ পয়সা পাওয়া যেত, যা দিয়ে স্থানীয় অঞ্চলের সবচেয়ে সস্তা এক প্যাকেট সিগারেট কেনা যায়। তাই, তিনি প্রায়শই ক্ষুধার্ত থাকতেন। ঠিক সেসময় তিনি দারিদ্র্য কী, ক্ষুধা কী, বুঝতে শেখেন এবং দেশকে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলকে দারিদ্র্যমুক্ত করার ব্যাপারে চিন্তা-গবেষণা শুরু করেন। ঘটনাচক্রে, ২০২০ সালে যখন চীন সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হয়, তখন সি চিন পিং দেশের প্রেসিডেন্ট। বস্তুত, তার চিন্তাভাবনা ও সেসব চিন্তাভাবনার সফল বাস্তবায়ন চীনকে দারিদ্র্যমুক্ত হতে বিপুলভাবে সাহায্য করেছে।
১৯৭৮ সালে চীনে, তৎকালীন চীনা নেতা তেং সিয়াও পিংয়ের হাত ধরে, বৈদেশিক উন্মুক্তকরণ ও সংস্কারনীতি চালু হয়। চীন নিজেকে বাকি বিশ্বের জন্য ধীরে ধীরে উন্মুক্ত করতে শুরু করে, পাশাপাশি চলতে থাকে অর্থনীতিতে সংস্কার কার্যক্রম। তখন থেকেই চীন ধাপে ধাপে দারিদ্র্য বিমোচনের পথে এগোতে থাকে। সেই থেকে বিগত চার দশকে চীনের ৮০ কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছেন, যা বিশ্বের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। এত অল্প সময়ে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের দারিদ্র্য মুক্তির ঘটনা ইতিহাসে আর ঘটেনি। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম ইয়ং একে ‘মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে মহান ঘটনাগুলোর একটি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
১৯৪৯ সালে নয়াচীন প্রতিষ্ঠার সময়, শহর ও গ্রামের দ্বৈত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে, গ্রামাঞ্চলের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করছিল। ১৯৫২ সালে চীনের মাথাপিছু জিডিপি ছিল মাত্র ১১৯ ইউয়ান (বর্তমান বিনিময় হার ধরলেও মাত্র ১৭ মার্কিন ডলার)। ১৯৭৮ সালে চীনের গ্রামাঞ্চলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। গ্রামের পরিবারগুলোকে নিজস্ব ব্যবসা চালু করতে উত্সাহিত করা হয়। কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির মূল্য কমানো হয়। গ্রামীণ শিল্পকে চাঙ্গা করতে নেওয়া হয় বিভিন্ন উদ্যোগ। এসব সংস্কার কার্যক্রম সফল প্রমাণিত হয়। ১৯৮৪ সালের মধ্যেই চীনে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২৫ কোটি থেকে সাড়ে ১২ কোটিতে নেমে আসে।
১৯৮৫ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত চীনের দরিদ্র জেলাগুলোকে উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের নীতি বাস্তবায়ন করা হয়। চীন সরকার বিশেষ কর্মবিভাগ গঠন করে দরিদ্র জেলাগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়। এ সময়কালে চীনে দারিদ্র্য বিমোচন খাতে যত অর্থ ব্যয় হয়েছে, তার ৭০ শতাংশই ব্যয় হয়েছে দরিদ্র জেলাগুলোর উন্নয়নে। এর ফলও পাওয়া যায় হাতে হাতে। ২০০০ সালের শেষ নাগাদ চীনের গ্রামাঞ্চলে হতদরিদ্র লোকের হার ১৪.৮ শতাংশ থেকে নেমে দাঁড়ায় ৩ শতাংশে।
২০০০-২০১০ সাল পর্যন্ত ছিল চীনের দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমের তৃতীয় সময়পর্ব। এ সময়কালে হতদরিদ্র গ্রামগুলোকে টার্গেট করা হয়; বাছাই করা হয় মোট ১ লাখ ৪৮ হাজার ১০০টি হতদরিদ্র গ্রাম। গ্রামগুলোকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে নেওয়া হয় বিভিন্ন ব্যবস্থা। ফলে, ১০ বছরের প্রচেষ্টায়, চীনের গ্রামাঞ্চলের হতদরিদ্র লোকের সংখ্যা ২০০০ সালের ৯ কোটি ৪২ লাখ ২০ হাজার থেকে ২০১০ সালে ২ কোটি ৬৮ লাখ ৮০ হাজারে নেমে আসে।
২০১১-২০২০। এ সময়কাল চীনের দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমের চতুর্থ বা শেষ পর্ব। এর মধ্যে সি চিন পিং ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ দেশের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। অন্যভাবে বললে, ওই সময়কালের পুরোটা জুড়েই দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ওই সময়কালে নির্দিষ্ট গ্রামীণ পরিবারগুলোকে দারিদ্র্যমুক্ত হতে বিভিন্নভাবে সহায়তা দেওয়া হয়। ২০১১ সালে বার্ষিক গড় আয় ২৩০০ ইউয়ানের চেয়ে কম—এমন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা তখন চীনে ছিল ১২ কোটি ২০ লাখ। পরিবারের সদস্যদের অসুস্থতার কারণে পুনরায় দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাওয়া লোকের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছিল। এ প্রেক্ষাপটে, ২০১৩ সালের শেষ দিকে নির্দিষ্টভাবে দরিদ্র মানুষদের সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ দেন সি চিন পিং। তখন থেকে চীনের দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম এক নতুন ও চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রবেশ করে।
চীনের সাবেক প্রেসিডেন্ট, বৈদেশিক উন্মুক্তকরণ ও সংস্কার নীতির প্রবর্তক তেং সিয়াও পিং বলেছিলেন, ‘দারিদ্র্য সমাজতন্ত্র নয়। সমাজতান্ত্রিক দেশকে আগে দারিদ্র্যমুক্ত হতে হবে।’ চীনের দ্বাদশ জাতীয় কংগ্রেস, তথা ২০১২ সালের পর, সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে নতুন কেন্দ্রীয় সরকার, দেশের দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। ঊনবিংশ জাতীয় কংগ্রেস দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইকে সার্বিকভাবে সচ্ছল সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি লড়াইয়ের একটি হিসেবে চিহ্নিত করে। পরের ৫ বছরে চীনের সরকার ও জনগণ, অতুলনীয় প্রচেষ্টা চালিয়ে, দেশের বাকি ৬ কোটি ৮০ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করে।
সি চিন পিং প্রায়ই বলেন, ‘দেশ-প্রশাসকের মূল কাজ জনগণের কল্যাণ সাধন।’ বস্তুত, দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম ছিল আগাগোড়াই চীনা জনগণের কল্যাণে নিবেদিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের সরকার ও জনগণকে অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে। সর্বশেষ বাধা ছিল মহামারি। করোনার প্রাদুর্ভাবের পর অনেকেই ভেবেছিলেন, নির্ধারিত সময়ে তথা ২০২০ সালের মধ্যে চীন সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হবে। কিন্তু বাস্তবে চীন ব্যর্থ হয়নি। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যেকোনো মূল্যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার নির্দেশ দেন। দেশজুড়ে তখন নেওয়া হয় অতিরিক্ত ব্যবস্থা। ফলে, ২০২০ সাল শেষ হওয়ার মাস দুয়েক আগেই চীন আনুষ্ঠানিকভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হয়।
জাতিসংঘের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বকে মোটাদাগে দারিদ্র্যমুক্ত করা। অথচ চীন, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের দেশ, নিজেকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে ১০ বছর কম সময় নিয়েছে! ১০ বছর আগেই জাতিসংঘের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় অবদান রেখে বসে আছে ১৪০ কোটি মানুষের এই দেশটি। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীন তার নিজস্ব পদ্ধতিতে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমে সফল হয়েছে। বিগত চার দশকে চীনের দারিদ্র্য বিমোচনের অভিজ্ঞতা থেকে অন্যান্য দেশও গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর শিক্ষা নিতে পারে।
[চীনের দারিদ্র্য বিমোচন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহীরা অপেক্ষা করতে পারেন ‘নয়াচীনের সাফল্যের মুকুটে সাতটি পালক’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশের। বইটি শিগগির বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যাবে। –লেখক]
আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)