মুরাদ হাসান কি আইনের ঊর্ধ্বে?
বেলা শেষে শেখ হাসিনাই জনতার ভাষা বুঝেন। আওয়ামী লীগকে রক্ষায় সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শেখ হাসিনা মোটেও কুণ্ঠাবোধ করেন না, দেশবাসীর কাছে আবারও সেই প্রমাণটিই রাখলেন। মান বাঁচালেন আওয়ামী লীগের, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের দৃঢ়তাকে আবারও প্রতিষ্ঠিত করলেন। মুরাদ হাসানকে পদত্যাগের নির্দেশনা দিয়ে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের অনুভূতিকেই তিনি বাস্তবায়ন করলেন।
আমলা নির্ভর সরকারে আগাছা কত শক্তিশালী হতে পারে, মুরাদ হাসানের উত্থানই তার বড় প্রমাণ। শুধুমাত্র উত্তরাধিকারের যোগ্যতায় এমপি থেকে মন্ত্রী হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে তিনি শুধু ক্ষমতার অপব্যবহারই করেননি, শেখ হাসিনাকে মা সম্বোধন করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু কন্যার ভাবমূর্তিকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। তার পদত্যাগের এই নির্দেশনায় সংকটের আপাত সমাধান মিলেছে। সেই সাথে নানা প্রশ্নও আজ জাতির সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে।
মুরাদ হাসানের সাম্প্রতিক কালের যে সমস্ত কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ও আলাপচারিতার দলিল দস্তাবেজ বিভিন্ন সামাজিক ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে তাতে এটি অত্যন্ত স্পষ্ট, তিনি যাচ্ছে তাই উপায়ে ক্ষমতাকে অপব্যবহার করেছেন। নারী অধিকার আর নারীর সম্ভ্রম কোনোভাবেই তার মতো বিকৃত মানুষের কাছে নিরাপদ ছিল না।
মাহিয়া মাহির সাথে তার কথোপকথনে এটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার, ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি নারীকে জিম্মি করার প্রয়াস চালিয়ে ছিলেন। তার এই ধরনের প্রচেষ্টা যে অভ্যাসগত ছিল, সেটিও আজ জাতির বুঝতে বাকি নেই। তার এসব অপকর্মের কোনো দায় যে সরকার নিবে না, পদত্যাগের নির্দেশনা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা সে বার্তাটিই জাতিকে পৌঁছে দিয়েছেন। শুধুমাত্র প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগই কি এমন বিকৃত রুচির আইন অমান্যকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি, নাকি নৈতিক স্খলন আর ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগেও তিনি ফৌজদারি আইনের মুখোমুখি হবেন?
কয়েক মাস আগে ঢাকার এক প্রভাবশালী এমপির ছেলে রাজপথে আইনকে হাতে তুলে নিয়েছিলেন, যে কি না আবার আর এক প্রভাবশালী এমপির মেয়ে জামাইও বটে। প্রিয় পাঠক, আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, ওয়াকিটকি ও আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য থেকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই এমপি পুত্র গ্রেফতার হয়েছিলেন। আওয়ামী প্রভাবশালীদের বলয়ে গড়ে উঠা ক্যাসিনো সাম্রাজ্যকে গুড়িয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা দুঃসময়ে রাজপথের সংগ্রামী সহযোদ্ধাদেরও চার শিকলে আটকে দিয়েছেন। শেখ হাসিনার সদিচ্ছা আর দেশপ্রেমের এমন অসংখ্য উদাহরণ জাতির সামনে আছে। তবুও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শের ধার করা আজ নানা সংশয়ে সন্দিহান।
একজন মানুষ এমপি, মন্ত্রী হওয়ার আগে তার ব্যক্তিগত জীবনের চুলচেরা বিশ্লেষণ হয় বলেই দেশবাসী জানেন। আমাদের দেশের গোয়েন্দারা চৌকস, তারও অনেক প্রমাণ জাতির কাছে আছে। এতসব গোয়েন্দা নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে কোন ঐশী ক্ষমতাবলে মুরাদের মতো মানুষেরা মন্ত্রী হয়ে ওঠেন, ভাবমূর্তি রক্ষায় এটির অনুসন্ধানও আজ জরুরি হয়ে উঠছে।
গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বেফাঁস বলে বিপাকে পড়েছেন। মেয়র পদ হারিয়েছেন, দল থেকে চিরতরে বহিষ্কৃত হয়েছেন। আজকাল তার নানা দুষ্কর্মের ফর্দ বেরিয়ে আসছে। সরকারি-বেসরকারি নানারকম জরিপ আর অনুসন্ধানের পর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকেই দলীয় নমিনেশন দেওয়া হয় বলেই দেশবাসী জানে। মেয়র নির্বাচনের পূর্বে কোন যোগ্যতায় তিনি সর্ব উৎকৃষ্ট প্রার্থী বলে বিবেচিত হয়েছিলেন? মনোনয়নের আগে তার দুর্নীতি আর অপকর্মকে ডেকে রেখে কে বা কারা শেখ হাসিনাকে বিভ্রান্ত করেছিলেন? শেখ হাসিনা যদি গোয়েন্দা প্রতিবেদন আর নানামুখী গোপন জরিপের ভিত্তিতেই নমিনেশন দেন, তাহলে কি সরিষার ভেতরে কোনো গোপন ভূত লুকিয়ে আছে? যারা মন্দকে ভালো বলে শেখ হাসিনাকে বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন!
শেখ হাসিনার দৃঢ়তা কিংবদন্তিতুল্য। যদি তাই না হতো, তবে মুক্তিযুদ্ধের অহংকার টাঙ্গাইলের সিদ্দিকী পরিবার আজ দিশেহারা হতো না। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর অবদান, বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভক্তি, ভালোবাসা আর আনুগত্যের কথা তো আজও ইতিহাস।
আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে অসামান্য অবদান রেখেছেন। আজীবন দেশ আর দলের প্রয়োজনে জীবন বাজি রেখেই কাজ করেছেন। শেখ হাসিনাও তাকে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামে স্থান দিয়েছিলেন। বারবার এমপি, মন্ত্রী বানিয়ে পুরস্কৃতও করেছিলেন। দেশ আর দলকে ভাবমূর্তি সংকটে ফেলে দেওয়ার অপরাধে এরা সবাই আজ রাজনৈতিক নির্বাসনে।
প্রয়াত জাতীয় নেতা, বর্ষীয়ান রাজনৈতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, ‘বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না।’ তাই তো ওয়ান ইলিভেনের স্বপ্নদ্রষ্টারা আজও ধুঁকে ধুঁকে দগ্ধ হয়। শেখ হাসিনার এমন সুদৃঢ় পদক্ষেপে জাতি হতাশার সাগর থেকে জেগে ওঠে, আদর্শবান মুজিব সৈনিকরা আশার আলো খুঁজে পায়। মুরাদের মন্ত্রিত্ব গেছে, দেশবাসীর সাথে সাথে দলের আদর্শবান নেতা কর্মীরাও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। মুরাদের মতো উম্মাদ আর হীন নৈতিকতার মানুষেরা আওয়ামী লীগ করলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অপমানিত হয়, পার্লামেন্টে থাকলে মহান জাতীয় সংসদ কলুষিত হয়, আর কেবিনেটে থাকলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ঔজ্জ্বল্য ম্রিয়মাণ হয়। মন্ত্রিত্বের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি মুরাদের দলীয় অবস্থানকে পরিষ্কার করে দ্রুতই আইনি পথে এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।
মুরাদরা আজ একা নয়। মুরাদ, জাহাঙ্গীরদের মতো মানসিকতার অগণিত লেবাসধারী আওয়ামীলীগার আজ চারিদিকেই খুঁজে পাওয়া যাবে। শুধু মুরাদ, জাহাঙ্গীরদের পদ-পদবী কেড়ে নিয়ে নয়, নৈতিক স্খলনের অভিযোগে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তাদের গুণগানে মত্ত, দল আর সরকারে ঘাপটি মেরে থাকা নেকড়েদেরও খুঁজে বের করতে হবে। এরা শুধু দেশ আর সরকারের বোঝা নয়; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকেই এরা প্রশ্নবিদ্ধ করছে, ভূলুণ্ঠিত করছে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তিকেও।
শেখ হাসিনার শত্রুরা আজ দেশে বিদেশে সক্রিয়। যেকোনো মূল্যে বঙ্গবন্ধুর বেঁচে থাকা প্রজন্মকে এরা নির্বংশ করতে চায়। এর বিপরীতে প্রয়োজন একটি দৃঢ় নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী সত্যিকারের দেশপ্রেমিক শক্তিশালী প্রজন্ম। আর এমন দেশপ্রেমিক আদর্শবান আওয়ামীলীগারের সংখ্যাও নিতান্তই কম নয়, কিন্তু সুবিধাবাদীদের দাপটে এরা আজ অসহায়। কথায় কথায় এই সুবিধাবাদীরা যখন মা বলে চিৎকার করেন, আদর্শবাদীরা তখন সন্ত্রস্ত হয়।
কোনো কোনো রাজনীতিক, আমলা, আর কূটনীতিকরা যখন গলা ফাটিয়ে বলেন, ‘আমার আর শেখ হাসিনার মাঝে কেউ নেই’ নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিকরা তখন পিছু হটে। মুরাদকাণ্ডে শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক প্রজন্মকে সাহস জোগাবে বটে; তবে একে টেকসই করার জন্য মুরাদ, জাহাঙ্গীরদের মতো একই পথের অনুসারী সকলকেই দ্রুত খুঁজে বের করে আইনের মুখোমুখি করার অন্য কোনো বিকল্প নেই।
মো. মাহমুদ হাসান ।। কলামিস্ট