বজ্রপাত ঝুঁকিতে বাংলাদেশ, করণীয় কী?
অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা হলো ২০২১ সালের আগস্টে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বজ্রপাতে একসাথে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। তারা সকলে বিয়ের বরযাত্রী হিসেবে যাচ্ছিলেন এবং বৃষ্টির কারণে নদীর ধারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এপ্রিলে সুনামগঞ্জের ৪ উপজেলায় ধান কাটার সময় বজ্রপাতে নিহত হন ৪ কৃষক। এর আগে ২০১৬ সালের মে মাসে মাত্র দুই দিনে বজ্রপাতে ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
বজ্রপাতের কারণে বাংলাদেশে ঠিক কত মানুষের মৃত্যু হয় তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে পত্রিকার খবর, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংগৃহীত তথ্য থেকে ধারণা করা যায় এই সংখ্যা গড়ে প্রতি বছর ১৫০-২০০। বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যার বিচারে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।
বজ্রপাত হচ্ছে অতিকায় বৈদ্যুতিক বিচ্ছুরণ যা মেঘ থেকে মেঘে অথবা মেঘ থেকে ভূ-পৃষ্ঠে আঘাত করে। বজ্রপাতে গড় চার্জের পরিমাণ ৩ থেকে ৫ মিলিয়ন ভোল্ট এবং এর মধ্যে রয়েছে প্রতি ঘণ্টায় ২২০ শত মাইল গতিসম্পন্ন ৩০ কিলো অ্যাম্পেয়ারস এর কারেন্ট।
আরও পড়ুন >>> ঢাকার বায়ু কতটা অস্বাস্থ্যকর?
বজ্রপাতের প্রাথমিক কারণ হচ্ছে, দীর্ঘ শুষ্ক সময় শেষে আর্দ্রতা বৃদ্ধি; বিশেষ করে বায়ুমণ্ডলে বাতাসের তাপমাত্রা ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগের তুলনায় কম থাকায় গরম বায়ু দ্রুত ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উপরে উঠে গেলে আর্দ্র বায়ুর সংস্পর্শ পায় তখন গরম বায়ু দ্রুত ঠাণ্ডা হতে শুরু করে যার কারণে বজ্র মেঘের সৃষ্টি হয়।
ভূ-পৃষ্ঠের জলকণা যখন বাষ্প হয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন মেঘের নিচের দিকে ভারী অংশের সাথে জলীয়বাষ্পের সংঘর্ষ হয়, যার ফলে অনেক জলকণা ইলেকট্রন ত্যাগ করে ধনাত্মক চার্জে এবং অনেক জলকণা সে ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক চার্জে পরিণত হয়। এ চার্জিত জলীয়বাষ্প মেঘে পরিণত হলে মেঘে বিপুল পরিমাণ স্থির তড়িৎ উৎপন্ন হয়। এ সময় অপেক্ষাকৃত হালকা ধনাত্মক আধান মেঘের উপরে এবং অপেক্ষাকৃত ভারী ঋণাত্মক চার্জ নিচে অবস্থান করে।
মারাকাইবোকে পৃথিবীর বজ্রপাতের রাজধানী বলা হয়। বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮৬ লক্ষ বজ্রপাত সংঘটিত হয় এবং প্রতিবছর বজ্রপাতের কারণে মারা যায় প্রায় ২০০০ থেকে ২৪০০০...
মেঘে এই দুই বিপরীত চার্জের পরিমাণ বেড়ে গেলে ডিসচার্জ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ডিসচার্জিং এর ফলে বাতাসের মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক স্পার্ক প্রবাহিত হয়। এ বৈদ্যুতিক স্পার্ক এর প্রবাহই ‘বজ্রপাত’। তবে সব বজ্র ভূপৃষ্ঠে পড়ে না। শুধু ক্লাউড টু গ্রাউন্ড ডিসচার্জিং এর ফলে সৃষ্ট বজ্রই ভূপৃষ্ঠে পড়ে।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় ভেনেজুয়েলার মারাকাইবো (Maracaibo) নামক লেকে যা গড়ে বছরে ৩০০ দিন। মারাকাইবোকে পৃথিবীর বজ্রপাতের রাজধানী বলা হয়। বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮৬ লক্ষ বজ্রপাত সংঘটিত হয় এবং প্রতিবছর বজ্রপাতের কারণে মারা যায় প্রায় ২০০০ থেকে ২৪০০০ এবং আহত হয় ২৫০০০০ জন মানুষ।
আরও পড়ুন >>> আধিপত্য নয়, বন্ধুত্ব করি প্রকৃতির সঙ্গে
দেশে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বজ্রপাতে অন্তত ৩২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবগুলো মৃত্যুই হয়েছে খোলা স্থানে। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনুযায়ী ৯৭ দশমিক ৫২ শতাংশ সাধারণ মানুষ বা গ্রামগঞ্জের কৃষক, শ্রমিক, জেলে শ্রেণি। এর মধ্যে কৃষিকাজে সম্পৃক্তদের মৃত্যুর হার ৭৪ শতাংশ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের বজ্রপাতে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বজ্রপাতের সবচাইতে ঝুঁকিতে থাকেন মাঠে কর্মরত কৃষকরা সমুদ্র, নদী ও জলাশয় মাছ ধরতে থাকা জেলে। বজ্র ঝড়ের সময়ে গাছ বা বৈদ্যুতিক খুঁটির নিচে আশ্রয় নেওয়া লোকজন ও মাঠে খেলারত মানুষজন ঝুঁকিতে থাকেন।
বিভিন্ন হিসাবে দেখা গেছে, দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে হাওরের ৩ জেলা কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আর এসব ঘটনা বেশি ঘটে এপ্রিল ও মে মাসে। এ সময় কৃষক ফসল তোলার কাজে মাঠে থাকেন। এ সময়টা কালবৈশাখীর। গত এক দশকে ঝড়, বন্যা বা অন্য কোনো দুর্যোগের তুলনায় বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয়।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ানের গবেষণা মতে, প্রাক মৌসুমে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় হাওর এলাকায়। বিশেষ করে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেটে।
আরও পড়ুন >>> ঢাকার বায়ু দূষণ কমাতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ
মৌসুমি সময়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, বরিশাল এবং উত্তরবঙ্গের রংপুর, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামে। মৌসুম-উত্তর অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে বজ্রপাত সবচেয়ে বেশি হয়।
দেশে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বজ্রপাতে অন্তত ৩২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবগুলো মৃত্যুই হয়েছে খোলা স্থানে। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনুযায়ী ৯৭ দশমিক ৫২ শতাংশ সাধারণ মানুষ বা গ্রামগঞ্জের কৃষক...
সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী এসব অঞ্চলে বেশি বজ্রপাত হয় শীতকালে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আবহাওয়ার নানা ফ্যাক্টরের কারণে একেক অঞ্চলে একেক সময়ে বজ্রপাত কম বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমানোর লক্ষ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন—
• বজ্রপাতের কারণ ও প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধির বৈজ্ঞানিক কারণ উদ্ঘাটন, পূর্বাভাস এবং আগাম বার্তা সংক্রান্ত আঞ্চলিক মেকানিজম গড়ে তোলা।
• বজ্রপাত শনাক্তকরণ ও পূর্বাভাস পদ্ধতির আধুনিকায়ন।
• বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কমানোর কার্যকরী পদ্ধতি বের করা।
• দেশের বজ্রপাত প্রবণ এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা।
• বজ্র নিরোধক দণ্ড প্রতিটা বিল্ডিং-এ লাগানোর বিষয়টি বিল্ডিং কোডে বাধ্যতামূলক করা।
• বজ্রপাত বিষয়ক সচেতনতা শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা।
• বজ্রপাতে আহতদের প্রাথমিক সেবা সংক্রান্ত বিষয়ে স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
• পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের সাথে বজ্রপাতের প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ এর ঝুঁকিসমূহ এবং জলবায়ু পরিবর্তনে এর ভূমিকা সংক্রান্ত বিষয়ে যৌথ গবেষণার উদ্যোগ এবং কার্যক্রম গ্রহণ।
• দ্রুত বর্ধনশীল উঁচু জাতের বৃক্ষরোপণ।
আরও পড়ুন >>> প্লাস্টিক দূষণ : বাংলাদেশ কী করছে?
বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকতে সাধারণ মানুষের করণীয়—
• বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা বা মাঠ অথবা উঁচু স্থানে না থাকা। এই সময়ে ঘরে অবস্থান করা। অতি জরুরি প্রয়োজনে বের হতে হলে রাবারের জুতা পরে বাইরে যাওয়া।
• বজ্রপাতের সময় খোলা স্থানে থাকলে তাড়াতাড়ি পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙ্গুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়া।
• বজ্রপাতের আভাস পেলে সাথে সাথে যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া। বিল্ডিং-এর ছাদে বা উঁচু জায়গায় না যাওয়া।
• খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত থাকা।
• বজ্রপাতের সময় সব ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির সুইচ বন্ধ রাখা এবং বজ্রপাতের আভাস পেলে আগেই এগুলোর প্লাগ বিচ্ছিন্ন করা।
• খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকা অবস্থায় বজ্রপাত শুরু হলে একত্রে না থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
• বৈদ্যুতিক খুঁটি, উঁচু গাছপালা, তার, ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা।
• গভীর মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা বা জলাশয় থেকে দূরে থাকা।
• বজ্রপাতের সময় খোলা নৌকায় মাছ ধরতে না যাওয়া, সমুদ্র বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করা।
• বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতর অবস্থান করলে গাড়ির ধাতব অংশ স্পর্শ না করা।
ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম
[email protected]