মৌলভি মুহাম্মদ বকর : উপমহাদেশের প্রথম শহীদ সাংবাদিক
উপমহাদেশের প্রথম শহীদ সাংবাদিক মৌলভি মুহাম্মদ বকর (Moulvi Muhammad Baqir)এর নাম খুব বেশিসংখ্যক মানুষেরই জানার কথা নয়। এই অঞ্চলের সাংবাদিকতার ইতিহাস গ্রন্থগুলোতেও মৌলভি বকরের নাম আমার চোখে পড়েনি। ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতবাসীকে, বিশেষ করে দিল্লিবাসীকে খেপিয়ে তোলার অভিযোগে দিল্লিকে সিপাহিদের কবল থেকে মুক্ত করার পর তাকে দিল্লি গেটের বাইরে কামানের নলের মুখে বেঁধে গোলার বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
ঘটনার তিন দশক পর ১৮৯০ সালে রুশ শিল্পী ভাসিলি ভেরেশ্চেগিন (Vasily Vereshchagin) এর আঁকা ‘সাপ্রেশন অফ দ্য ইন্ডিয়ান রিভোল্ট বাই দ্য ইংলিশ’ তৈলচিত্রে একজন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিকে গোলায় উড়িয়ে দেওয়ার পূর্ব মুহূর্ত কামানের নলের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় কল্পনা করেছেন এবং অনেক বিবরণীতে তিনি মৌলভি বকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকে বলেছেন, মেজর উইলিয়াম হাডসন (William Stephen Raikes Hodson) তাকে গুলি করে হত্যা করেছেন। যেভাবেই হত্যা করা হোক না কেন, তিনি বিদ্রোহী সৈনিক ছিলেন না, তার অপরাধ ছিল তার সম্পাদিত ‘দিল্লি উর্দু আখবার (Delhi Urdu Akhbar)’ ভারতীয়দের ওপর ব্রিটিশ অত্যাচারের তীব্র সমালোচনা করেছে এবং জনগণকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে এবং ওই সময় তার কলম হয়ে ওঠেছিল তরবারিতে এবং শব্দ পরিণত হয়েছিল মতপ্রকাশের পতাকায়।
১৮৫৭ সালের মে মাস থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বিদ্রোহী সিপাহিরা মোট চার মাস দিল্লি নগরীকে তাদের দখলে রাখে। বিদ্রোহ দমনের পর ১৮৫৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যরা তাকে আটক করে দু’দিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর দিল্লি গেটের বাইরে কামানের মুখে বেঁধে গোলার বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়। তাকে গুলি করে হত্যা করার বর্ণনার চেয়ে কামানের গোলায় উড়িয়ে দেওয়ার বর্ণনায় অধিক সত্যতা থাকতে পারে। কারণ এত বেশিসংখ্যক লোককে হত্যা করা হয়েছে যে অল্প সময়ে বেশিসংখ্যককে হত্যা করার জন্য কামান ব্যবহারের কথা অনেক ইতিহাস গ্রন্থে রয়েছে। ঘটনার পর ১৬৫ বছর কেটে গেছে। ভারতে ‘গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়া’ যখন ভেঙে পড়েছে এবং এখন প্রায় আত্মসমর্পণ করেছে ক্ষমতার কাছে, ঠিক তখন প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়া স্মরণ করেছে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য ভূমিকা পালনকারী, ভারতের প্রথম শহীদ সাংবাদিক মৌলভি মোহাম্মদ আবু বকরকে। দুর্ভাগ্যজনক হলো যে, উপমহাদেশের খুব কম সংখ্যক শিক্ষিত মানুষ, এমনকি সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িতরাও মৌলভি আবু বকরের অবদান সম্পর্কে জানেন না। উপমহাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসের উপর কোনো গ্রন্থে তার নাম পাওয়া যাবে না। প্রেসক্লাব অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি উমাকান্ত লাখেরা অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে আবু বকরকে ভারতীয় সাংবাদিকতার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে বর্ণনা করে বলেন যে, আবু বকর ভারতীয় সাংবাদিকতাকে দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন এবং জনগণের কণ্ঠরোধে ব্রিটিশ আইনের বিরুদ্ধে বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে লড়াই করেছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা, যাদের অধিকাংশই সাংবাদিক, তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা কি মতপ্রকাশের অধিকার সংরক্ষণের জন্য লড়াই করছেন?’ এবং ২০১৪ সালের মে মাসে ভারতে রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তনের পর থেকে গত কয়েক বছরে ভারতে সাংবাদিকতার অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করেন। তিনি আরও বলেন, ১৮৫৭ সালে মৌলভি বকর যে ভূমিকা রেখেছেন সেটিই খাঁটি দেশপ্রেম। জাতির জন্য তিনি তার কলমের শক্তিকে ব্যবহার করেছেন। ভারতীয়দের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ নির্মমতাকে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘বকর সাহিব কি ভিরাসত সে হি দেশ বাচেগা’ (বকর সাহেবের ঐতিহ্য অনুসরণ করেই কেবল দেশ রক্ষা করা সম্ভব)। ব্রিটিশরা যখন দেশকে হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নে বিভক্ত করছিল, তিনি তার সংবাদপত্রের মাধ্যমে দুই সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে চেষ্টা করেন।
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১৮৪৭ সালে ‘গ্যাগিং অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন চালু করেছিল দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে, যার মুখ্য টার্গেট ছিল উর্দু ও ফারসি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো। কারণ এই দুটি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোই মূলত ভারতে ব্রিটিশনীতি, জুলুম-অত্যাচারের সমালোচনা করত। মৌলভি বকরের ছাপাখানা বন্ধ করে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।
১৭৮০ সালে দিল্লির এক বিশিষ্ট পরিবারে মৌলভি বকরের জন্ম। তার পিতা মুহাম্মদ আকবর আলী ছিলেন খ্যাতনামা শিয়া পণ্ডিত এবং তিনি দিল্লিতে তার সময়ের ‘মুজতাহিদ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ওই সময়ের প্রচলিত ধর্মীয় শিক্ষা শেষ করে তিনি দিল্লি কলেজে ভর্তি হন এবং কলেজের পড়াশোনা করেন। ১৮২৫ সালে তিনি দিল্লি কলেজে ফারসি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি ব্রিটিশের রাজস্ব বিভাগে তহশিলদার হিসেবেও কিছুদিন চাকরি করেন। লেখালেখি ও সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহের কারণে ১৯৩৪ সালে তিনি একটি লিথোগ্রাফ প্রেস কিনেন। ১৮৩৬ সালে সরকার প্রেস অ্যাক্ট সংশোধন করে সংবাদপত্র প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করলে তিনি সাংবাদিকতাকে দেশ ও জাতির সেবার মাধ্যম এবং পেশা হিসেবে বেছে নেন।
১৮৩৭ সালের জানুয়ারিতে মৌলভি মুহাম্মদ বকর উর্দু সাপ্তাহিক ‘দিল্লি উর্দু আখবার’ প্রকাশ করেন। ১৮২২ সালের মার্চ মাস থেকে কলকাতায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘জামÑএÑ জাহান নুমা’র পর এটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে প্রকাশিত দ্বিতীয় উর্দু সংবাদপত্র এবং উত্তর ভারত থেকে প্রথম। সিপাহি বিদ্রোহ শেষ হওয়া পর্যন্ত মৌলভি বকরের সংবাদপত্রটি ২১ বছর টিকে ছিল এবং এ সময়ে এটির নাম দু’বার পরিবর্তন করা হয়েছিল। ১৮৪০ সালের ৩ মে এটির নাম করা হয় ‘দিল্লি উর্দু আখবার’ এবং ১৮৫৭ সালের ১২ জুলাই পুনরায় নাম বদলে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহের নামে ‘আখবার-আল-জাফর’ রাখা হয়। শেষ নামেই পত্রিকাটির শেষ দশটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এর মাসিক চাঁদার হার ছিল দুই রুপি, ছয় মাসের জন্য ১১ রুপি এবং এক বছরের জন্য ২০ রুপি।
‘দিল্লি উর্দু আখবার’ ছিল ভারতে উর্দু সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠাতা ও পথপ্রদর্শক। মৌলভি বকর তার পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে ওই সময়ের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেন এবং সমসাময়িক চিন্তা-চেতনা, উদ্ভূত পরিস্থিতি তুলে ধরে দেশবাসীকে সচেতন করার চেষ্টা করেন।
বাহাদুর শাহ জাফরের দরবারের খবরগুলো প্রকাশ করা হতো ‘হুজুর-এ-ওয়ালা’ শিরোনামে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খবর প্রকাশিত হতো ‘সাহি-এ-কালান-বাহাদুর’ শিরোনামে। খবর সংগ্রহের জন্য তিনি দিল্লিতে এবং বড় বড় শহরগুলোতে ‘ওয়াকা-এ-নিগার’ অর্থাৎ বর্ণনাকারী সংবাদদাতা নিয়োগ করেছিলেন। যে সময়ে ভারতে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়নি, তখন ‘দিল্লি উর্দু আখবার’ জাতির আগে-অনুভূতি প্রকাশ ও জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজন তুলে ধরার এবং রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। মৌলভি বকর মানুষের মধ্যে দেশের স্বাধীনতার জন্য ভালোবাসার আলো জ্বালিয়েছেন এবং ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস ও আস্থা সৃষ্টি করেছেন তার লেখনীর মাধ্যমে। কোম্পানি সরকারের ১৮৫৩ সালের এক রিপোর্টে ‘দিল্লি উর্দু আখবার’কে ‘অসংযত ও বিরক্তিকর সংবাদপত্র’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ১৮৫৭ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হলে পত্রিকাটি স্বয়ং স্বাধীনতা সংগ্রামীতে পরিণত হয়। ১০ মে মিরাটে স্বাধীনতার যে মশাল জ্বালানো হয়েছিল পরদিন ১১ মে তা দিল্লির স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে পৌঁছে। এরপর একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপকতায় ব্রিটিশের পায়ের নিচে মাটি কেঁপে ওঠেছিল। মৌলভি বকর স্বাধীনতার এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার কলম হাতে স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। দিল্লিতে সিপাহিরা বিদ্রোহ শুরু করার ছয় দিন পর ১৮৫৭ সালের ১৭ মে ‘দিল্লি উর্দু আখবার’ এ সিপাহিদের অগ্রাভিযানের ওপর এক বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যার মূল অংশ এখানে উপস্থাপন করা হলো—
“গ্রীষ্ম মওসুমের কারণে ৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে দরবারের কাজকর্ম বেশ সকালে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কক্ষে সভাপতিত্ব করার জন্য ব্যস্ত ছিলেন। সকাল ৭টায় নৌকার সেতুর দারোগা আসেন এবং জানান, ‘কিছু তুর্কি সৈন্য হিংস্র হয়ে আমাদের প্রহার করতে শুরু করেছে। তারা সংগ্রহ করা খাজনা লুট করতে চেয়েছিল। কিছুটা ছলচাতুরী করে আমি তাদের কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখি এবং সেতু খুলে দেই, যাতে তারা আর সামনে অগ্রসর হয়ে আসতে না পারে। তারা সলিমপুরের রাস্তায় খাজনা আদায়ের টং ঘর ও সাহেবের বাংলো জ্বালিয়ে দিয়েছে।’ সাহেবকে কিছুক্ষণ চিন্তাযুক্ত দেখা গেল, এরপর তিনি ওঠলেন এবং কর্নেল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গেলেন, যিনি সংলগ্ন কক্ষেই মামলা পরিচালনা করছিলেন। কিছু ‘গিটপিট’ (ইংরেজি কথাবার্তা) করার পর তিনি ‘সারিস্তা মাল’ (ট্রেজারি কক্ষ বা তোষাখানা বা কোষাগার) এ গেলেন এবং ‘আফসার খাজানা’র (ট্রেজারি অফিসার) সঙ্গে আলোচনা করে ‘খাজানা’র নিরাপত্তা বিধান ও তোষাখানার ‘মুহাফিজ’দের (প্রহরীদের) প্রস্তুত থাকার হুকুম দিলেন। হুকুম অনুযায়ী তারা বন্দুকে গুলি ভরে তাদের অবস্থান গ্রহণ করল। কাচারির ‘জঙ্গি দরওয়াজা’তেও প্রহরী মোতায়েন করা হলো। দরবার কক্ষ এবং সেখানকার কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ওই খবর নিয়ে কমিশনারের কাছে গেলেন। এরই মধ্যে খবর পাওয়া গেল যে, তুর্কি ঘোড়সওয়াররা কিল্লার ‘ঝরোকা’র নিচে জড়ো হয়েছে। একটু পরই খবর শোনা গেল যে, কিল্লার দরওয়াজায় ‘কিলাদার,’ বড়ে সাহেব’, ‘ডা. সাহেব’ এবং ‘মেম লোগ’ (ইংলিশ মহিলাগণ)দের হত্যা করা হয়েছে এবং সওয়াররা কিল্লার ভেতর প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রথমে স্বল্পসংখ্যক ঘোড়সওয়ার, যারা নগরে প্রবেশ করেছিল, তারা দরিয়াগঞ্জে ব্রিটিশদের হত্যা করে, বাংলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়, ডা. চমন লালকে প্রকৃত ‘দারুল শিফা’য় (চিকিৎসালয়) প্রেরণ করে (হত্যা করে)। তাদের সঙ্গে পরে আরও সওয়ার যোগ দেয় এবং বহু কণ্ঠের কোলাহল শোনা যায় এবং গুজব ওঠে যে, অমুক অমুক ব্রিটিশকে হত্যা করা হয়েছে, আবার আরেক জায়গায় অমুক অমুককে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছে।”
‘দিল্লি উর্দু আখবার’ এর এই সংখ্যায় প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট ছাড়াও মিরাট, সাহরানপুর, লক্ষ্মৌ ও আম্বালাসহ দেশের বিভিন্ন অংশে স্বাধীনতা সংগ্রামের খবর প্রকাশিত হয়েছিল। বিদ্রোহের কারণ হিসেবে একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, “তুর্কি ঘোড়সওয়ারদের মধ্যে ইতিমধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে এবং ঘটনা হচ্ছে, বন্দুকের কার্তুজ শূকর ও গরুর চর্বিতে মাখানো থাকার কারণে কার্তুজ ব্যবহারের আদেশ মান্য করতে অস্বীকার করায় ৮৫ জন সিপাহিকে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল এবং সোমবার ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে তাদের মধ্যে ধর্মকে রক্ষা করার অভিলাষ জেগে ওঠে। যারা পল্টনে ছিল তারা এবং ঘোড়সওয়াররা যেখানে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থাতেই সহসা অস্ত্র তুলে নেয় এবং কয়েদখানা থেকে তাদের ভাইদের মুক্ত করে এবং পল্টন ও শ্বেতাঙ্গদের ওপর হামলা চালায়।”
স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে মৌলভি বকর তাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তাদেরকে সহযোগিতা করা এবং সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য। সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালে ‘দিল্লি উর্দু আখবার’ এর অনেক সংখ্যায় অনুপ্রেরণা জাগরণকারী লেখা প্রকাশিত হয়েছে, “আপনাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও উদ্যম, যার ওপর ভর করে আপনার এমন শক্তিশালী ও উদ্ধত এক সাম্রাজ্যের অযৌক্তিক, অন্যায় দাম্ভিকতাকে খান খান করে দিয়েছেন, যেভাবে ধূলিসাৎ হয়েছিল ফেরাউন ও শাদ্দাদের অহংকার, যা ইতিহাসের পাতায় স্মরণ করা হবে—ভারতীয় জনগণের ওপর আপতিত অদৃশ্য অভিশাপ থেকে আপনারা তাদের মুক্ত করেছেন।” পত্রিকাটিতে আরও লেখা হয়, “ও আমার দেশবাসী, ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটেছে, সময়ের পরিবর্তন ঘটেছে। সকল ব্যবস্থা ও সরকারের ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন আপনাদেরও উচিত আপনাদের অভ্যাসের পরিবর্তন করা, জীবনযাপনের সহজ পদ্ধতি এবং আপনারা আপনাদের শৈশব থেকে যেসব আরাম আয়েশে অভ্যস্ত তা থেকে নিজেদের মুক্ত করুন। নিজেদের সংশোধন করুন। আপনাদের দায়িত্বহীনতা ও ভয় পাওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করে সাহসিকতাকে আলিঙ্গন করুন।”
‘দিল্লি উর্দু আখবার’ এ মৌলভি বকরের নিজ নামে কোনো লেখা প্রকাশিত হতো না, কিন্তু গবেষকদের অভিমত হচ্ছে যে, অধিকাংশ লেখায় আসতো তার শক্তিশালী কলম থেকে। অনেক সময় তার পুত্র মুহাম্মদ হুসাইন আজাদ পিতাকে সহায়তা করতেন। পত্রিকার ১৮৫৭ সালের ২৪ মে সংখ্যায় “তারিখ-এ-ইনকিলাব ইবরাত আফজা” (পরিবর্তনের ইতিহাস একটি শিক্ষা) শিরোনামে তার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়, যা দিল্লিবাসীদের সংগ্রামের চেতনা ও উদ্যমে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জনগণের প্রচণ্ড ক্ষোভের বিস্ফোরণ ও সশস্ত্র সংগ্রাম ব্রিটিশ ক্ষমতার ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। জনগণের প্রতিশোধ স্পৃহার শিকার হচ্ছিল শ্বেতাঙ্গরা এবং তাদের তল্পিবাহকরাও রোষের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছিল না। তিনি এজন্য জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছেন ধৈর্য ধারণ করতে এবং জানমালের ক্ষতি সাধন না করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে।
সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালে সিপাহিদের পক্ষে মৌলভি বকরের দৃঢ় অবস্থান সত্ত্বেও তিনি শতভাগ ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন তা দাবি করার সুযোগ নেই। অনেক ইতিহাসবিদ তাকে ব্রিটিশের গুপ্তচর বলেও উল্লেখ করেছেন। উইলিয়াম ড্যালরিম্পেল (William Dalrymple) তার ‘দ্যা লাস্ট মোগল (The Last Mughal)’ গ্রন্থেও একই ধরনের অভিযোগ করেছেন ‘দিল্লি উর্দু আখবার’ সম্পাদকের বিরুদ্ধে। ‘মিউটিনি পেপারস (Mutiny Papers)’ এর ৫০২৮ নম্বর ফাইলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে ১৮৫৭ সালের জুলাই মাসে মৌলভি বকরের প্রথম গোপন চিঠি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, “সিপাহিদের পরিচালিত সহিংসতায় আমরা যারা নগরীর শ্রদ্ধাভাজন অংশ, তারা চরম সীমার একেবারে শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছি এবং আমাদের জীবন বাঁচানোর আর কোনো আশা নেই। আমি যেখানে যাই, জেনারেল বখত খানের (বিদ্রোহী সিপাহিদের সেনাপতি) গুপ্তচরেরা আমার পেছন পেছন যায়। মুফতি সদরুদ্দিন খানের (আজুরদা) বাড়িতে প্রহরী মোতায়েন করা হয়েছে এবং সকল প্রবেশ ও নির্গমন পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জিনাত মহলের মাধ্যমে আমি বাদশাহকে পরামর্শ দিয়েছি সবগুলো ফটক খুলে দিতে এবং ইংরেজদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নগরীর দখল গ্রহণ করতে। তাকে বলেছি যে, তিনি যদি বিদ্রোহীদের ধ্বংস করতে পারেন, তাহলে তার নিজের ও তার সন্তানদের জন্য বিরাট সুবিধার কাজ হবে। বাদশাহ আমার পরামর্শ অনুমোদন করেছেন এবং তা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু হাকিম আহসানউল্লাহ খান আমাদের বিশ্বাসের পার্থক্যের কারণে আমার পরামর্শ বাস্তবায়নে বাধা প্রদান করেছেন।” হাকিম একজন সুন্নি এবং এর লেখক একজন শিয়া।
নগরবাসীর ওপর সিপাহিদের অত্যাচার এত বেড়ে গিয়েছিল যে, তারা ব্রিটিশের প্রত্যাবর্তন আশা করছিল, যে তারা এসে অন্যায় অত্যাচার বন্ধ করবে এবং স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু এটি যে ব্রিটিশের প্রতি নগরবাসীর প্রকৃত সমর্থন ছিল না, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাদের গুপ্তচরদের মাধ্যমে সে সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ ফিরে এলে লুটপাট, অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাবে এমন ধারণা করেনি নগরবাসী। কিন্তু ব্রিটিশ বাহিনী নগরীর দখল গ্রহণ করা মাত্র তাদের সকল মিত্র ও সমর্থককে ভুলে গিয়েছিল। এমনকি তাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত গুপ্তচরেরাও তাদের হাত থেকে নিরাপদ থাকতে পারেনি। মৌলভি মুহাম্মদ বকরও তাদের একজন ছিলেন। ১৪ সেপ্টেম্বর তাকে ধরে নিয়ে যায় ব্রিটিশ সৈন্যরা। দু’দিন পর ১৮৫৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তাকে হত্যা করা হয়।
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ।। সাংবাদিক