পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার মান
বিদেশে একজন আন্ডার গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীকে ভর্তি করতে অনেকেকিছুর প্রয়োজন হয়। কেবল মাত্র একটি ভর্তি পরীক্ষাই সব না। শিক্ষার্থীকে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে একটি রচনা লিখতে হয়, স্কুলের শিক্ষক এবং স্কুলের কাউন্সিলরের সুপারিশ পত্র দিতে হয়, বাবা মায়ের আয় রোজগারের বিষয় জানাতে হয়, যেই প্রতিষ্ঠানে দরখাস্ত করবে সেখানে কেন পড়তে চায় সেটার উপর বিশেষভাবে রচনা লিখতে হয়। তারপর আবার অ্যাডমিশন অফিস থেকে সাক্ষাৎকার নেয়। কল্পনা করা যায়, একজন শিক্ষার্থীকে বাছাই করতে কত কষ্ট করে!
আর আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ হয় ২০ মিনিটের একটা সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। কত অবহেলা! অথচ একজন শিক্ষক নিয়োগ মানে ৩০-৩৫ বছর ধরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের পড়াবে। একটা ভুল নিয়োগ মানে হাজার হাজার শিক্ষার্থীদেরকে ভালো শিক্ষক থেকে বঞ্চিত করা।
খোদ ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্থা (আইআইএসসি) [Indian Institute of Science (IISc)] তে ফ্যাকাল্টি নিয়োগেও কত ধাপ! দরখাস্ত আহ্বানে বিশ্বের যেকোনো সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। সেখানে এসএসসি এইচএসসি কিংবা অনার্স মাস্টার্সের রেজাল্টই চাওয়া হয় না। ন্যূনতম যোগ্যতা কেবল পিএইচডি নয়, সাথে এক থেকে দুইটা পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতাও চায়।
গবেষণা পত্রের সংখ্যা জানতে চায়। তারা চায় কমপক্ষে ৩টি সুপারিশ পত্র, গবেষণা প্রস্তাব, শিক্ষকের দর্শন ইত্যাদি। তারা আরও জানতে চায় গবেষণা ফিল্ডে তার কী কী অবদান আছে এবং নিয়োগ পেলে সেই প্রতিষ্ঠানে কীভাবে সহকর্মীদের সাথে সহযোগিতাপূর্ণ মানসিকতা নিয়ে কাজ করবে। একই সাথে প্রতিটি ধাপেই দরখাস্ত বাছাই করে কিছু বাদ দিয়ে শর্ট লিস্ট করা হয়। শেষ ধাপে যে কয়জন শর্ট লিস্টেড তাদেরকে একজন করে ডাকে।
যাদেরকে ক্যাম্পাসে ডাকা হয়, তারা সাধারণত সারা দিনের জন্য আসে। সেইদিন তারা সংশ্লিষ্ট বিভাগের ফ্যাকাল্টির সাথে পরিচিত হয়, সেমিনারে অংশগ্রহণ করে, নিজেদের আগ্রহের কথা জানায়। সেই সেমিনারে ছাত্ররাও থাকে। তারপর ডিনের সাথে কথা হয়। একসাথে সবাই মিলে ক্যাফেটেরিয়াতে লাঞ্চ করে। এই পুরো ধাপে প্রার্থীকে পরখ করে দেখা হয়। তারপর প্রার্থী চলে গেলে সকলের মতামত নেওয়া হয়। সেই মতামত নিয়ে নির্বাচন কমিটি বসে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে প্রার্থী বাছাই করে। তবেই না যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পাবে।
আমাদের দেশে প্রভাষক পদ থেকেই চাকরি স্থায়ীকরণ করা হয়। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার চাকরি পাওয়ার পর যত খারাপ পারফর্মই করুক না কেন তাকে চাকরিচ্যুত করা প্রায় অসম্ভব।
আমাদের এখানে দরখাস্তে চাওয়া হয় এসএসসি, এইচএসসি, বিএস এবং অনার্সের রেজাল্ট। কলেজের শিক্ষক নিয়োগেও একই যোগ্যতা চাওয়া হয়। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অতিরিক্ত সম্মান এবং অতিরিক্ত সম্মানী কীভাবে আশা করে?
মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে পার্মানেন্ট পজিশনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া উচিত না। প্রভাষক পদ হওয়া উচিত টেম্পোরারি পোস্ট। পিএইচডি এবং অন্যান্য যোগ্যতা পূরণ সাপেক্ষেই পার্মানেন্ট পজিশন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
যারা মাস্টার্স করে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পায় তারা পরবর্তীতে যখন পিএইচডি করতে যায় সেখানে কিন্তু তারা টিচিং এসিস্টেন্ট হিসেবে কাজ করে। আমাদের এখানেও প্রভাষকদের বড়জোর প্রথম বর্ষের কোর্স দেওয়া যেতে পারে। এর বাইরে তাদেরকে ল্যাব ক্লাস, প্রব্লেম সলভিং ক্লাস ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে। সারা বিশ্বের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে টেনুর পজিশন পেতে অনেক কষ্ট করতে হয়।
Giulia Heyward ১৩ নভেম্বরে নিউ ইয়র্ক টাইমসে ‘Georgia's University System Takes On Tenure’ শিরোনামে একটি আর্টিকেল লিখেছেন। সেখানে আমেরিকার জর্জিয়া স্টেটের স্টেট ইউনিভার্সিটি ও কলেজের tenured অধ্যাপকদের জন্য নতুন আইন করেছে। এখন থেকে টেনুর পাওয়া অধ্যাপকদের মধ্যে যারা ভালো পারফর্ম করবে না তাদের চাকরিচ্যুত করা যাবে। এতদিন আমেরিকাতে টেনুর পেতে অসম্ভব কষ্ট করতে হতো। এত কষ্টের পুরস্কার ছিল যে একবার টেনুর প্রফেসর হয়ে গেলে ধরা হয় চাকরি স্থায়ী।
আমাদের দেশে প্রভাষক পদ থেকেই চাকরি স্থায়ীকরণ করা হয়। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার চাকরি পাওয়ার পর যত খারাপ পারফর্মই করুক না কেন তাকে চাকরিচ্যুত করা প্রায় অসম্ভব। আমেরিকাতে টেনুরশিপ পজিশন পাওয়ার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়। তারপর পদটি পাওয়া মানে যেন অনেককিছু অর্জন করে ফেলা। অনেকেই tenured হয়ে গেলে রিলাক্স মুডে চলে যায়।
আমেরিকায় অধ্যাপকদের জীবনযাপন অত্যন্ত স্ট্রেসফুল। বাংলাদেশে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। কোনো স্ট্রেস নেই। ফলে শিক্ষকতা করে আর একই সাথে চুটিয়ে রাজনীতি করা যায়। এমনও শিক্ষক আছে ৬০টি ক্লাসের মধ্যে ১২টি ক্লাস নিয়ে কোর্স শেষ করে ফেলে। স্ট্রেস কমানোর জন্য আমরা যথেষ্ট সৃষ্টিশীল।
আমাদের প্রায় প্রত্যেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের জার্নাল প্রকাশনা চালু করে যাতে তাদের শিক্ষকরা অতি সহজে প্রমোশনের জন্য প্রয়োজনীয় আর্টিকেল প্রকাশ করে এবং সহজেই প্রমোশন পেয়ে যায়।
আমাদের প্রায় প্রত্যেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের জার্নাল প্রকাশনা চালু করে যাতে তাদের শিক্ষকরা অতি সহজে প্রমোশনের জন্য প্রয়োজনীয় আর্টিকেল প্রকাশ করে এবং সহজেই প্রমোশন পেয়ে যায়। অবশিষ্ট সময় চুটিয়ে রাজনীতি করতে পারে। এর বিপরীত কাজ যারা করে তারাই বরং চাপে থাকে।
পদার্থবিজ্ঞানে কাজের সংজ্ঞানুসারে চাপ ছাড়া কাজ হয় না। আবার অতি চাপে সৃষ্টিশীল কাজ হয় না। তাই এই দুইয়ের একটি ব্যালেন্স দরকার। কোনো প্রকার গবেষণা বা ধান্দাবাজি করে যারা ন্যূনতম সংখ্যক গবেষণাপত্র নিজ দেশের গার্বেজ জার্নালে প্রকাশ করে তারাই বরং পুরস্কার পায়। তারাই ভিসি হয় প্রোভিসি হয়, ডিন হয়। তাহলে বলুন এই দেশের শিক্ষার মান কেমনে ভালো হবে?
মাত্র কয়েকটি কাজ করলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মান দ্রুত ভালো হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নাল প্রকাশনা বন্ধ করুন অথবা ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর শূন্য এমন জার্নালে আর্টিকেল প্রকাশনা প্রমোশনে ব্যবহার বাতিল করুন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দেশি বা বিদেশি স্কলারকে ভিসি প্রোভিসি হিসেবে নিয়োগ দিন।
ডিন পদে নির্বাচনী ব্যবস্থা বাতিল করুন। আর কারা ঠিক মতো ক্লাস নেয় আর নেয় না সেটি মনিটর করুন। ভালো কাজের মূল্যায়ন করুন মন্দ কাজে তিরস্কার করুন। দেখবেন শিক্ষার মান দ্রুতই ভালো হয়ে যাচ্ছে। কাজগুলো কি খুব কঠিন? মোটেও না। কেবল দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকলেই হবে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে হলে শিক্ষকদের উপর আরও চাপ প্রয়োগের বিকল্প নেই। তবে চাপের সাথে অতিরিক্ত পুরস্কারও যুক্ত করতে হবে। ভালো কাজ করলে ভালো বেতন ও পুরস্কার এবং মন্দ কাজ করলে তিরস্কার ও চাকরিচ্যুত করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
আমরা শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রমোশনকে একদম হাস্যকর বানিয়ে ফেলেছি। একজন শিক্ষার্থী নিয়োগের চেয়েও শিক্ষক নিয়োগকে অনেক সহজ করে ফেলেছি। এর কারণ আমরা আজও শিক্ষকতা পেশার গুরুত্ব বুঝিনি।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়