স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে করণীয় কী?
মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার একটি হলো স্বাস্থ্য। একটি দেশের অগ্রযাত্রায় সুপরিকল্পিত স্বাস্থ্যসেবা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আমাদের সংবিধানেও সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে উল্লেখ আছে। জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয় তাহলে জনগণের দুর্ভোগের সীমা থাকে না।
সারাবিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশও করোনার মহামারির ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এ ক্রান্তিকালে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় বেশ দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবার সাথে চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, নার্স, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সকলে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এইসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঠিক নির্দেশনা বা পরিকল্পনার দুর্বলতা থাকলে এই খাতকে এগিয়ে নেওয়া কঠিন।
স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে সুষ্ঠু পরিকল্পনার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকরা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। বরং নতুন সমস্যা তৈরি হলে সেগুলো জোড়াতালি দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। যার ফলে সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান হচ্ছে কিন্তু পুরোপুরি লাঘব হচ্ছে না। ফলে বড় বড় বিপদগুলো মোকাবিলা করা সত্যি কঠিন হয়। করোনা মহামারি আমাদের স্বাস্থ্যসেবার দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবা বলতে সাধারণ মানুষ চিকিৎসকের ভূমিকাকে বুঝে থাকে। ফলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়টি অনেকটা আড়ালে থেকে যায়। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা হচ্ছে, একটি দেশের স্বাস্থ্য খাতকে এগিয়ে নেওয়ার মূল হাতিয়ার। অথচ আমাদের দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সাথে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ জড়িত থাকছে না। যার ফলশ্রুতিতে বৈজ্ঞানিক অনেক বিষয়ে যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। উদাহরণস্বরুপ, স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে যে বরাদ্দ থাকে সেটিও সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা হচ্ছে, একটি দেশের স্বাস্থ্য খাতকে এগিয়ে নেওয়ার মূল হাতিয়ার। অথচ আমাদের দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সাথে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ জড়িত থাকছে না।
সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমের তথ্যমতে, গত বছর স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সরকারকে ফেরত দিয়েছে। কেননা টাকা কাজে লাগানোর সুযোগ হয়নি। গণমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশিত হয় যে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে ক্রয়কৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এগুলো সঠিক পরিকল্পনার ঘাটতির জন্য হয়ে থাকে বলে মনে করি।
উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন লন্ডনে থাকার সুযোগ হয়েছে। সেখানে পড়াশোনাও করেছি ওষুধ প্রযুক্তি বিষয়ে। তাই ব্রিটেনের স্বাস্থ্য খাতকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমি বলব না ব্রিটেনের স্বাস্থ্যসেবায় আমি পরিতৃপ্ত। কিন্তু রোগী চিকিৎসকের সম্পর্ককে ওরা খুব সুন্দর ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে এসেছে।
সেখানকার জনগণকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিতে হলে তার আবাসস্থলের নিকটবর্তী সরকার অনুমোদিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে (যেটাকে ওরা জেনারেল প্র্যাকটিস বা জিপি বলে থাকে) অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে। এই সুবিধাটি সরকার স্পন্সর করলেও প্রতি বছর জনগণকে একটি নির্ধারিত ফ্রি দিয়ে সেবাটি গ্রহণ করতে হয়।
এরকম কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো তৈরি করা আমাদের দেশে অতীব জরুরি। এখন বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। সরকার তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে মহাপরিকল্পনা করে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবাকে উন্নত বিশ্বের মতো সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় রূপান্তরিত করা সম্ভব।
স্বাস্থ্যসেবাকে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিতে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ পরিকল্পনার অন্যতম সফলতা টেলিমেডিসিন সেবা চালুকরণ। ইন্টারনেট ও মোবাইল সহজলভ্য হওয়ায় করোনা মহামারির এই দুর্যোগে টেলিমেডিসিন সেবা স্বাস্থ্য খাতে একটি নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। এ সেবাটি জনগণের কাছে পৌঁছাতে বেসরকারি হাসপাতালগুলো বেশি অগ্রগামী।
ফলশ্রুতিতে সেবা এক শ্রেণির মানুষ গ্রহণ করছে। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ এ সেবার সুফল ভোগ করতে সক্ষম হচ্ছে না। কেননা সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখনো এ ধরনের ব্যবস্থাপনা তৈরি হয়ে উঠেনি।
স্বাস্থ্যসেবা একটি মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হলে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। এটা একবারে কখনো সম্ভব নয়। তাই মহাপরিকল্পনা করে সময় ধরে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে কিছু সুপারিশ তুলে ধরছি।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বর্তমান বেতন কাঠামো পরিবর্তন করে বিশেষজ্ঞদের জন্য বিশেষ বেতন কাঠামো তৈরি করতে হবে।
১. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, নার্স এবং অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সাথে সমন্বয় করে থাকে। তাছাড়া বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নেও মন্ত্রণালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও সমন্বয় সাধনে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা জড়িত থাকেন।
সরকারি তথ্যমতে, প্রশাসন ক্যাডারে এখন অনেক ডাক্তার-ফার্মাসিস্টরা যোগদান করছেন। সেক্ষেত্রে আমার সুনির্দিষ্ট সুপারিশ হচ্ছে, প্রশাসন ক্যাডারের যারা স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করে এসেছে তাদেরকে বিশেষজ্ঞ কমিটির সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমন্বয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। তাহলে অপচয়ও কম হবে এবং সমন্বয় ও সঠিকভাবে সম্ভব হবে।
২. সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বর্তমান বেতন কাঠামো পরিবর্তন করে বিশেষজ্ঞদের জন্য বিশেষ বেতন কাঠামো তৈরি করতে হবে। এছাড়াও তাদের সামাজিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্র্যাকটিসের প্রতি মনোযোগী কম থাকবে বলে আশা করা যায়।
৩. উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ করতে হবে। গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা ওষুধ প্রয়োগ, ব্যবহার ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারে। দেশে প্রতি বছর সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বের হচ্ছে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো গেলে স্বাস্থ্য খাতে আমূল পরিবর্তন আসবে বলে মনে করি।
৪. বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা একটি বড় ব্যবসা খাত। কিন্তু এটি অন্যান্য ব্যবসা থেকে আলাদা। তাই এ খাতকে নজরদারি ও অন্যান্য নিয়মনীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৫. স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম স্তম্ভ হলো ওষুধ খাত। বাংলাদেশ এখন ওষুধ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমরা এখন আমেরিকা ও ব্রিটেনের মতো উন্নত বিশ্বে রপ্তানি করছি। তথাপিও দেশে এখনো নিম্নমান ও ভেজাল ওষুধের সমস্যা বিদ্যমান। এ সম্পর্কিত বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হলো ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ জনবল নিয়োগ করতে হবে।
স্বাস্থ্য খাতে পরিপূর্ণতা নিশ্চিত করা না গেলে দেশের দরিদ্রতা দূর করা কঠিন হবে। বিশেষত ক্যান্সার, কিডনি ট্রান্সপ্লানটেশন, কিডনি ডায়ালাইসিস ও হার্ট-এর মতো জটিল ব্যয়বহুল চিকিৎসাসমূহ সামাল দেওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব।
এক্ষেত্রে সরকারকে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের জনগণকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বিশ্বমানের পর্যায়ে উন্নীত করতে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। বিষয়টি বাস্তবায়ন কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।
ড. আ. স. ম. মঞ্জুর আল হোসেন ।। সহকারী অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়