পাকিস্তানপ্রেমী বাংলাদেশি!
ক্রিকেটীয় ভালোবাসায়ও কি পরকীয়া আছে? আমার বিশ্বাস আছে। সেই পরকীয়ায় অন্য কোনো দেশের দর্শকরা জড়িয়ে পড়েছে কিনা জানি না। তবে বাংলাদেশের দর্শকরা যে এমন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে, এ বিষয়ে বাজি ধরার সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশের দর্শকদের পরকীয়া এখন প্রকাশ্য।
আমরা যদি বিশ্ব আসরে বাংলাদেশের প্রবেশের আগের সময়টা দেখি, তখন বাংলাদেশে যারা ক্রিকেট নিয়ে অঙ্ক কষতেন, অর্থাৎ টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে কপালে ভাঁজ পড়ত যাদের, তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়াকে সমর্থন করতেন।
সীমিত ওভারের ক্রিকেট অর্থাৎ ওয়ান ডে’তে বাংলাদেশের দর্শকরা ভারত-বাংলাদেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যেতেন। ১৯৯৬-৯৭ সালে যখন শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়াসুরিয়া- অরবিন্দ ডি সিলভার ঝড় উঠল তখন মৌসুমি ভাবে কেউ কেউ শ্রীলঙ্কাকে সমর্থন করতেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা নিষেধাজ্ঞার পর ফিরলে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিও অনুরক্ত হন বাংলাদেশের সমর্থকরা। তবে ব্রায়ান লারা যতদিন ছিলেন, ততদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতি দুর্বলতা ছিল অনেকেরই।
যখন ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করল, তখন আর প্রতিবেশী বা দূর বাড়ির প্রতি অনুরক্ত থাকার কথা নয়। আমাদের সকলের ভালোবাসা কেন্দ্রীভূত হওয়ার কথা লাল-সবুজে। জয়তু বাংলাদেশের বাইরে আমাদের আর কোনো স্লোগান থাকার কথা না।
বাংলাদেশ সীমিত ওভারের খেলা এবং টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর মাঠে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল সংবাদকর্মী হিসেবে। তখন চাক্ষুষ সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশি দর্শকদের পরকীয়া দেখার।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করল, তখন আর প্রতিবেশী বা দূর বাড়ির প্রতি অনুরক্ত থাকার কথা নয়। আমাদের সকলের ভালোবাসা কেন্দ্রীভূত হওয়ার কথা লাল-সবুজে।
জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে খেলায় বাংলাদেশ, বাংলাদেশ স্বতঃস্ফূর্ত ধ্বনি শুনেছি। দর্শকদের আবেগের বহিঃপ্রকাশের নানা ঢঙ দেখে হয়েছি বিস্মিত।
সেই আবেগ নিয়ে বিস্তর রিপোর্টও তৈরি হয়েছে। কিন্তু স্তম্ভিত হয়েছি বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচে। মাঠ ছিল চট্টগ্রাম। টেস্ট কভার করতে গিয়ে সেখানে পাকিস্তান, পাকিস্তান ধ্বনি শুনতে হয়েছে।
পাকিস্তানের ব্যাটসম্যান চার-ছয় হাঁকালে আমাদের বাঙালি দর্শকরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছে। সাকলাইন মুশতাক-ওয়াসিম আকরাম উইকেট পেলে পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে দেখেছি উদ্দাম নৃত্য।
প্রথমে মাঠে থাকা আমরা ভেবেছিলাম, আটকে পড়া পাকিস্তানি বা বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকরা এমন উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছেন। কিন্তু গ্যালারির কাছে গিয়ে দেখলাম এরা খাঁটি বাঙালি।
বাংলাদেশের পতাকার আড়ালে, পাকিস্তানের পতাকাও তারা গ্যালারিতে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশি পতাকা সাদৃশ্য গেঞ্জি পড়লেও বুকে পাকিস্তান নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ক্রিকেট প্রেমীর সংখ্যা নগণ্য নয়, সেটা ২০০১/২০০২ এ দুই পক্ষের টেস্ট দেখেই বুঝে নিতে পেরেছিলাম।
মাঠের বাইরে বিভিন্ন বৈঠকখানা, অফিসের আড্ডায় বসে খেলা দেখা হয়েছে। সেখানে বসে পাকিস্তানের সঙ্গে বিভিন্ন দলের ম্যাচ দেখেছি। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচও দেখেছি অনেক। সেখান থেকে দেখা, দেশীয় ক্রিকেট প্রেমীদের মধ্যে বপন হয়ে থাকা পাকিস্তানি বীজ কেমন হঠাৎ করেই জেসমিন হয়ে প্রস্ফুটিত হয়।
বাংলাদেশের পতাকার আড়ালে, পাকিস্তানের পতাকাও তারা গ্যালারিতে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশি পতাকা সাদৃশ্য গেঞ্জি পড়লেও বুকে পাকিস্তান নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ক্রিকেট প্রেমীর সংখ্যা নগণ্য নয়, সেটা ২০০১/২০০২ এ...
১৯ নভেম্বর ২০২১ তারিখে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ম্যাচে মিরপুরে দেখা গেল সেই পুরনো দৃশ্য। চার-ছয়-উইকেট লাভে পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের চেয়ে বেশি আনন্দে যেন ভেসে গেছে বাংলাদেশের দর্শকরা। এখানেও সংশয় ছিল, হয়তো মিরপুর-মোহাম্মদপুরের আটকে পড়া পাকিস্তানের নাগরিকরা পাকিস্তানের জার্সি পড়ে এ কাণ্ড করছে।
তাদের মানায়, কারণ এদেশে থাকলেও তাদের হৃদয়ে তো পাকিস্তান। কিন্তু পরে ফেসবুক ও টেলিভিশন পরখ করে দেখা গেল একদল তরুণ খেলা দেখতে গিয়েছে, তাদের মধ্যে এক, দুইজন পাকিস্তানি জার্সি গায়ে দিয়ে এসেছে, বাকিরা এসেছে বাংলাদেশের জার্সি পড়ে।
কেন পাকিস্তানের জার্সি? উত্তরে তাদের সাফাই বাক্য, ‘মজা করলাম—এই যে সবাই খ্যাপাচ্ছে। রাজাকার রাজাকার বলে। মজা লাগছে।’
আমরা যখন বিজয়ের ৫০ উদযাপন করতে যাচ্ছি, তখন আমাদের তরুণ কণ্ঠে এমন উচ্চারণে ব্যথিত হয়েছি। তার মানে ৫০ বছরে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন, গৌরব, পাক হানাদার বাহিনীর নিপীড়নের ইতিহাস তুলে ধরেও, আমরা আমাদের তরুণদের এই বীভৎস মজা থেকে দূরে রাখতে পারলাম না? এই দায় সকলকেই নিতে হবে।
শিক্ষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ, বাঙালির যে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইতে থাকার কথা ছিল, সেখান থেকে আমরা সরে এসেছি।
বিজয়ের ৫০ এ দাঁড়িয়ে আবারও বলতে চাই—যেখানে যে মাঠেই বাংলাদেশ, যে ইভেন্টেই খেলতে নামুক, হারি জিতি উচ্চারিত হোক—জয়তু বাংলাদেশ।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী