পরিবহন নৈরাজ্য!
এ যেন ঠিক মগের মুল্লুক। পরিবহন খাতের ওপর যেন কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা চাইলেই যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। তাদের কোনো আইন মানতে হয় না, নিয়ম মানতে হয় না, জনগণের কথা ভাবতে হয় না। তারা নিজেদের স্বার্থের কথাটাই ভাবে শুধু। আর স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে যখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারে।
একটা সভ্য সমাজে সবকিছুর নিয়ম আছে; সেটা যুদ্ধ হোক আর আন্দোলন হোক। দাবি যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক, তা পূরণের জন্য কর্তৃপক্ষকে যথাযথ সময় দিতে হয়। ধর্মঘট বলেন আর কর্মবিরতি, সেটা হলো যেকোনো আন্দোলনের শেষ ধাপ। কিন্তু একমাত্র বাংলাদেশের পরিবহন খাতে আন্দোলন শুরুই হয় কর্মবিরতি দিয়ে। এটা সত্যিই নজিরবিহীন।
মালিকরা সরকারের নিয়ম মানে না, শ্রমিকরা মালিকদের কথা শোনে না। এই যে এত অনিয়ম, নৈরাজ্য; তার পুরো ধাক্কাটা যায় জনগণের ওপর দিয়ে। যাদের এ ব্যাপারে কোনো দায় নেই, কিছু করারও নেই।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের বাড়ার অজুহাতে সরকার বাংলাদেশেও ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম বাড়িয়ে দেয়। সরকার এক লাফে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় ২৩ ভাগ। ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম বাড়ানো আসলে একটি চক্রবৃদ্ধি হারের ভোগান্তির সূচনা মাত্র।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়ে, সেচের খরচ বাড়ে, দ্রব্যমূল্য বাড়ে, বিদ্যুতের দাম বাড়ে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা ভাবার যেন কেউ নেই।
বাংলাদেশে সব খাতেই সুশাসনের ঘাটতি আছে। কিন্তু পরিবহন খাতে সুশাসন তো দূরের কথা কোনো শাসনেরই বালাই নেই। এখানে কেউ কারো কথা শোনে না।
ডিজেলের দাম বাড়লে বাসের ভাড়া বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক কাজটি করতেও সরকারকে ন্যূনতম সময় না দিয়ে মালিকরা তাৎক্ষণিকভাবে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ভাড়া বাড়ানো হবে এটা নিশ্চিত জেনেও মালিকরা যান চলাচল বন্ধ করে দিলেন কেন?
আগের লেখায় লিখেছিলাম, মালিকরা আসলে সরকারের কাছ থেকে বেশি করে ভাড়া বাড়ানোর দাবি আদায় করতে চেয়েছে গোটা জাতিকে জিম্মি করে। যা লিখেছিলাম, তাই হয়েছে। তিনদিন সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে মালিকরা ২৭ ভাগ ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে। অথচ ডিজেলের দাম বেড়েছে ২৩ ভাগ। সাধারণ মানুষকে বেআইনিভাবে জিম্মি করার অপরাধে যাদের কারাগারে থাকার কথা, তারাই টেলিভিশনের সামনে বড় বড় মুখে কথা বলছে।
ভাড়া বাড়ানোর পর শুরু হয়েছে নতুন নৈরাজ্য। কোন রুটে কত ভাড়া হবে, কোন বাসের ভাড়া কত হবে তার নিয়ম থাকলেও পরিবহন খাতের লোকজনের তাতে থোড়াই কেয়ার। তারা যেন যেমন খুশি তেমন ভাড়া পদ্ধতি চালু করেছে।
ভাড়া বাড়িয়েই যেন সরকারের দায়িত্ব শেষ। সেটা মাঠ পর্যায়ে কার্যকর হচ্ছে কি না, সেটা দেখার যেন কেউ নেই। নামকাওয়াস্তে মোবাইল কোর্ট বসানো হলেও নৈরাজ্য তো দেশজুড়ে। পুরো খাতকে একটা নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মধ্যে আনতে না পারলে এ নৈরাজ্য থামবে না কখনোই।
সরকার ভাড়া বাড়ানোর পরও মালিকরা আগের ভাড়া থেকে ২৭ ভাগ বেশি আদায় করছে। কিন্তু অনেক রুটে আগে থেকেই এরচেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছিল। এখন বাস ভাড়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে অনেক রুটে ভাড়া কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে একবার বাড়লে সেটা আর কমার নিয়ম নেই।
রাজধানীতে বাড়তি ভাড়া আদায়ের নানাবিধ কৌশল আছে। অনেক বাস সিটিং সার্ভিস, গেটলক সার্ভিস নাম দিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করত। কিন্তু সকাল আর বিকাল অফিস সময় আর ছুটির সময় সিটিং সার্ভিস হলেও অন্যসময় এগুলো আসলে চিটিং সার্ভিস। যেকোনো মূল্যে সরকারকে তোয়াক্কা না করে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অপকৌশল মাত্র। নতুন ভাড়া নির্ধারণের পর মালিকরা বলেছিল, সিটিং সার্ভিস বলে কিছু থাকবে না। কিন্তু তাও লোক দেখানো। এখন কোথাও আছে কোথাও নেই। এও এক নৈরাজ্য।
এতদিন আমরা জানতাম, ঢাকার ৯৫ ভাগ বাসই সিএনজি চালিত। এখন মালিকরা বলছে, সিএনজি চালিত বাস মাত্র ৩ ভাগ। রাতারাতি ৯২ ভাগ বাস কীভাবে ডিজেল চালিত হয়ে গেল, এ এক জাদু বটে। আমি নিশ্চিত, কাল যদি সিএনজির দাম বাড়ে, তাহলে আবার ৯৫ ভাগ গাড়ি সিএনজি চালিত হয়ে যাবে।
দাম বেড়েছে ডিজেলের। তাই ভাড়াও বেড়েছে শুধু ডিজেল চালিত বাসের। কিন্তু ঢাকার সব বাসেই বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। কোনটা ডিজেল চালিত আর কোনটা সিএনজি চালিত তার কোনো চিহ্ন নেই সব বাসে। এতদিন আমরা জানতাম, ঢাকার ৯৫ ভাগ বাসই সিএনজি চালিত। এখন মালিকরা বলছে, সিএনজি চালিত বাস মাত্র ৩ ভাগ। রাতারাতি ৯২ ভাগ বাস কীভাবে ডিজেল চালিত হয়ে গেল, এ এক জাদু বটে। আমি নিশ্চিত, কাল যদি সিএনজির দাম বাড়ে, তাহলে আবার ৯৫ ভাগ গাড়ি সিএনজি চালিত হয়ে যাবে। আসলে মালিকরা গাছেরটাও খাবে, তলারটাও কুড়াবে।
সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে নেওয়ার পর মালিকরা এখন শ্রমিকদের ঠকানোর কৌশল নিয়েছে, জমা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই মালিকদের পর এবার মাঠে নেমেছে শ্রমিকরা। তাদের কৌশলও মালিকদের কাছ থেকেই শেখা, গাড়ি বন্ধ। তার মানে ডিজেলের দাম বাড়ল, ভাড়া বাড়ল; কিন্তু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমলো না। বরং দুর্ভোগ প্রতিদিনই যেন বাড়ছে। কারণ মালিক বলেন আর শ্রমিক; কেউই ঘোষণা দিয়ে ধর্মঘট ডাকে না। কারণ সেটা ডাকার সুযোগ তাদের নেই।
ধর্মঘট ডাকতে হলে অন্তত ১৫ দিনের আল্টিমেটাম দিতে হয়। তাই কোনোকিছু মালিকদের পছন্দ না হলে, তারা গাড়ি চালানো বন্ধ করে দেয়; কোনো কিছু শ্রমিকদের পছন্দ না হলে তারাও গাড়ি চালানো বন্ধ করে দেয়। আর সাধারণ মানুষ সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে গাড়ি নেই।
বাস মালিকদের হাতে অস্ত্র আছে, শ্রমিকদের হাতেও অস্ত্র আছে; কিন্তু যাদের দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি, সেই জনগণের হাতে কোনো অস্ত্র নেই। ভাড়া নিয়ে শ্রমিকদের সাথে তর্কাতর্কি করতে পারে, কিন্তু শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ মাস্তানির কাছে তারা সত্যি অসহায়। আর সংগঠিত হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সংস্কৃতিটাই আমাদের দেশ থেকে উঠে গেছে। সবাই এখন অসহায়। অদৃষ্টের কাছে বিচার দেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। সবাই মিলে যে বাসে চড়া বন্ধ করে দেবে সে উপায়ও নেই।
তবুও আশার কথা হলো, প্রতিবাদে ছাত্ররা মাঠে নেমেছে। যুগ যুগ ধরে ছাত্রদের জন্য হাফ ভাড়া প্রযোজ্য। কিন্তু এখন অধিকাংশ বাসের গেটেই লেখা থাকে ‘হাফ পাস নাই’। এ নিয়ে ঝগড়া করা যায়, দাবি আদায় হয় না। এবার ছাত্ররা সংগঠিত হয়েই মাঠে নেমেছে। দেখা যাক, সরকার যেমন কথায় কথায় মালিকদের, শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়; এবার ছাত্রদের দাবি মানে কি না।
বর্তমান সরকার অনেক ব্যাপারেই কঠোর। কিন্তু পরিবহন খাতের প্রসঙ্গ এলেই তারা নরম। কারণ পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ সরকারি দলের নেতাদের হাতেই। সরকারের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, আপনার পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনুন। বাড়তি ভাড়াই আমরা দেব। তবে সেটা যেন সরকার নির্ধারিত বাড়তি ভাড়াই হয়। বাড়তির ওপর যেন মালিকরা-শ্রমিকরা অন্যায়ভাবে আরও বেশি চাপিয়ে দিতে না পারে। সরকার পরিবহন মাফিয়াদের দমন করুক, জনগণের সমর্থন তারা পাবে। পরিবহন মাফিয়াদের হাতে একটা জাতি বছরের পর বছর জিম্মি থাকতে পারে না।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
[email protected]