শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষানীতি ও সংকট
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যেই ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় সেটা অত্যন্ত নিম্নমানের। প্রথমত, এটি পুরানো আমলের, দ্বিতীয়ত, প্রশ্নগুলো গতানুগতিক ধাঁচের। প্রশ্নের মানই প্রশ্ন সাপেক্ষ। বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যমের অনেক শিক্ষার্থী আমেরিকা, কানাডা, কোরিয়া, চীন, ইউরোপের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেও বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বৈতরণী পার হতে পারে না তাদের অনেকেই।
আমার স্কুল-কলেজের বান্ধবীর ছেলে নটরডেম থেকে পাস করে SAT (Scholastic Assessment Test) পরীক্ষা দিয়েছে। ও SAT খুবই ভালো করেছে এবং আমেরিকা ও কানাডার খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপসহ ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়নি। শুধু সে না বাংলা মাধ্যমের আরও অনেকের কথা জেনেছি যারা SAT-এ খুব ভালো করে বিদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। আর ইংরেজি মাধ্যমে তো বলাই বাহুল্য। যে শিক্ষার্থীরা বিশ্বের সেরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় না তখন আমাদের ভর্তি পরীক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।
সম্প্রতি মাদরাসা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিক হারে চান্স পাচ্ছে বলে একটা আলাপ বেশ জোরালোভাবেই চলছে। আমাদের উচিত বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে সার্জারি করে দেখা যে, সমস্যা কি আদৌ কোথাও আছে নাকি নাই। সমস্যা থাকলে কোথায় সেই সমস্যা।
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় কিংবা অন্য কোনো পরীক্ষায় মাদরাসা শাখা থেকে শিক্ষিত কেউ ভালো করলেই সেটা আলাদা করে শিরোনাম হয়। তেমনি বিসিএস পরীক্ষায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কেউ ভালো করলেই সেটা আলাদা করে শিরোনাম হয়। এই শিরোনাম হওয়ার মধ্যেই বোঝা যায় এইগুলো ব্যতিক্ৰম।
সবসময় সব কিছুতেই ব্যতিক্ৰম থাকবেই। তবে সম্প্রতি বাংলা মাধ্যমের মান খারাপ হওয়া, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া ইত্যাদি নানা কারণে সচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা অধিক হারে ইংরেজি মাধ্যমে যাওয়ায় বাংলা মাধ্যম তার শ্রেষ্ঠত্ব আর ধরে রাখতে পারছে না। সমস্যার শুরু ১৯৮৭ সালে, যখন আলিম পরীক্ষার কারিকুলামে কোনো পরিবর্তন না এনে এটা এইচএসসির সমমান ঘোষণা করা হয়।
আমরা সবাই জানি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের উপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের মধ্যে ৮০ নম্বর থাকে। আমরা আরও জানি মাদরাসা বোর্ডে শিক্ষার্থীরা বাংলা মাধ্যমের থেকে বেশি নম্বর পায়। অধিক পাস দেখানোর জন্য তাদের সেই নম্বর দেওয়া হয়। সুতরাং তারা এক্ষেত্রে একটু এগিয়ে থাকে।
সম্প্রতি বাংলা মাধ্যমের মান খারাপ হওয়া, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া ইত্যাদি নানা কারণে সচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা অধিক হারে ইংরেজি মাধ্যমে যাওয়ায় বাংলা মাধ্যম তার শ্রেষ্ঠত্ব আর ধরে রাখতে পারছে না।
কোন মাধ্যম কত ভালো তা পরীক্ষার জন্য একটি এক্সপেরিমেন্ট হতে পারে। তিনমাধ্যম থেকে সেরা কিছু কিছু শিক্ষার্থীকে নিয়ে একইভাবে SAT-এর জন্য কোচিং করিয়ে SAT পরীক্ষা দিলে কারা কেমন করে সেটা হতে পারে একটা বিশ্বমানের লিটমাস টেস্ট।
আরেকটি লিটমাস টেস্ট হতে পারে আমাদের আইবিএ-তে তিন মাধ্যমের কতজন ভর্তি হতে পারে সেটা দেখা। এছাড়া বিজ্ঞান অনুষদে এই তিন মাধ্যমের কতজন ভর্তি হয় সেটাও বিবেচনায় নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।
আরেকটি সার্ভে হতে পারে। ভর্তি হওয়া শেষ কথা নয়। মাদরাসা, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে যারা ভর্তি হয় তাদের কত শতাংশ অনার্স এবং মাস্টার্সে খুব ভালো করে। যারা খুব ভালো করে তাদের কত শতাংশ উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে যেতে পারে। ভর্তি হয়েও ঝরে পড়া বা খারাপ করার হার কোন মাধ্যমের বেশি। তবে একটি কথা সত্যি, মাদরাসার শিক্ষার্থীরা কিন্তু বিজ্ঞান অনুষদে বেশি চান্স পায় না। মাদরাসায়ও বিজ্ঞান শাখা আছে। তাহলে কেন তারা বিজ্ঞান অনুষদে কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মতো চান্স পায় না?
একটি পরিসংখ্যান বলছে, গত দেড় দশকে মাদরাসায় বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থী ক্রমাগত কমছে। হয়তো বিজ্ঞান পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স বেশি পায় না, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে বেশি পায় এটি দেখেই মাদরাসায় বিজ্ঞান শিক্ষার্থী কমছে। আরেক পরিসংখ্যান বলছে, বাংলা মাধ্যমেও বিজ্ঞান শিক্ষার্থী কমছে যা আরও বেশি ক্ষতির কারণ এটিই আমাদের প্রধান শিক্ষার মাধ্যম।
আবার সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের তথ্য অনুসারে, ২০১৫-২০১৯ পর্যন্ত প্রত্যেক বছরই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে মাদরাসা বোর্ডের ইবতেদায়ি পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা।
২০১৫ সালে পিইসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ২৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৪ জন পরীক্ষার্থী, সেটা কমে ২০১৯ সালে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ ৫৩ হাজার ২৬৭ জনে। অন্যদিকে ২০১৫ সালে ইবতেদায়িতে অংশ নিয়েছিল ৩ লাখ ৬ হাজার ১৯৬ জন পরীক্ষার্থী, সেটা ২০১৯ সালে বেড়ে হয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার ৩৭১ জন। অর্থাৎ, এই পাঁচ বছরে স্কুলের শিক্ষার্থী কমেছে ১৬ শতাংশ, আর মাদরাসার শিক্ষার্থী বেড়েছে ১৭ শতাংশ!
এখন সরকার যে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করতে যাচ্ছে এর কারণে বাংলা মাধ্যমের প্রতি আগ্রহ আরও কমে যাবে। ফলে একটি শ্রেণি ইংরেজি মাধ্যমমুখী হবে এবং আরেকটি শ্রেণি মাদরাসামুখী হবে। এই দুটির কোনোটিই দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয় কারণ দুটোই বাংলাদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতির বাইরের।
কারা পাঠ্যপুস্তক থেকে নির্দিষ্ট একটি ধর্মের কিংবা নির্দিষ্ট একটি ধারার সাহিত্যিক বা কবির গল্প, কবিতা বাদ দিল? কারা অধ্যাপক কবির চৌধুরী প্রণীত শিক্ষানীতি বাদ দিয়ে নিজেদের পাণ্ডিত্য দেখাচ্ছে...
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এইসব সমস্যা থেকে সহজেই উত্তরণ ঘটাতে পারে। সেজন্য সবচেয়ে সহজ পদক্ষেপ হতে পারে ভর্তি পরীক্ষার মান উন্নয়ন ঘটানো। ভালো শিক্ষকদের দিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করানো।
ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের মান কেন খারাপ? পরীক্ষাগুলো হয় স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ডিনের নেতৃত্বে। ৭৩-এর অধ্যাদেশে পরিচালিত ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিন হয় ভোটে জিতে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিন হয় রাজনৈতিকভাবে নিযুক্ত ভিসির ইচ্ছায়। ফলে যখন যেই দল ক্ষমতায় তখন সেই দলের ডিন ও ভিসি হয় এবং এর ফলে ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে যারা যুক্ত হন তাদের প্রায় সকলেই রাজনৈতিক শিক্ষক।
ভর্তি পরীক্ষার সাথে বিশেষ করে প্রশ্নপত্র প্রণয়নে যদি মেধাবী শিক্ষকদের অধিকসংখ্যক সম্পৃক্ত করা যেত তাহলে প্রশ্নের মান ভালো করা যেত। প্রশ্নের মানই দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষার্থীর মান নির্ধারণ করে। শিক্ষার্থীদের মানই বিশ্ববিদ্যালয় তথা দেশের মান বৃদ্ধি করবে।
এই দেশের নিয়ম মেনেই মাদরাসা, বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষামাধ্যম চালু আছে। এই তিন মাধ্যমে যারা পড়ছে সবাই এই দেশের মানুষ। আমাদের উচিত মাদরাসা মাধ্যমের কারিকুলাম আরও উন্নত করা। এরা উন্নত মানের লেখাপড়া করলে দেশেরই লাভ।
আমাদের উচিত বাংলা মাধ্যমকে আরও উন্নত করা। কিন্তু বর্তমান সরকার নতুন শিক্ষাক্রমের নামে যা করতে যাচ্ছে তা চালু হওয়ার দশ বছরের মাঝে বুঝতে পারবে এর মাধ্যমে দেশের কী অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তাই এখনো সময় আছে এ থেকে ফিরে আসার।
বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে আটটি শিক্ষা কমিশন হয় এবং আটবার শিক্ষানীতি প্রণীত হয়। সর্বশেষ ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে প্রধান করে জাতীয় শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিশন ১৯৭৪ সালের শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন ও ২০০০ সালের শিক্ষানীতিকে ভিত্তি ধরে নতুন একটি শিক্ষানীতি তৈরি করে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে শিক্ষানীতি হিসেবে গৃহীত হয় এবং এটিই হলো বর্তমান সরকারের ঘোষিত শিক্ষানীতি। কিন্তু কি আশ্চর্য, অতীতের মতো এবারও ঘোষিত শিক্ষানীতির ভিত্তিতে আমাদের শিক্ষা চলছে না।
মেধাবী এবং আলোকিত শিক্ষকদের দ্বারা প্রণীত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে কারা? কারা এই আটটি শিক্ষা কমিশনের প্রণীত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করেছে? কারা পাঠ্যপুস্তক থেকে নির্দিষ্ট একটি ধর্মের কিংবা নির্দিষ্ট একটি ধারার সাহিত্যিক বা কবির গল্প, কবিতা বাদ দিল? কারা অধ্যাপক কবির চৌধুরী প্রণীত শিক্ষানীতি বাদ দিয়ে নিজেদের পাণ্ডিত্য দেখাচ্ছে? কারা নতুন শিক্ষাক্রম তৈরির মাধ্যমে স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষাকে নিচে নামিয়ে আনছে? কী তাদের উদ্দেশ্য এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেলেই দেশের শত্রু খুঁজে পাওয়া সহজ হবে।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়