ঢাবিতে মাদরাসাছাত্রের সাফল্যে আমরা কেন বিস্মিত?
মাদরাসার ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় অনেকেরই চোখ কপালে। কারো বা ভ্রুকুঞ্চিত। কেউবা বিস্মিত, রীতিমত হতবাক। কী করে এটা হলো? মাদরাসার ছাত্ররাতো ইংরেজি জানে না। সাহিত্য বোঝে না। বাইরের কোনো জ্ঞান নেই। শুধু দ্বীনের খবর রাখে, দুনিয়ার খবর রাখে না। অমেধাবী, মূর্খ সব। এমনইতো ধারণা আমাদের মাদরাসার ছাত্রদের নিয়ে।
এ বছর ‘খ’ ইউনিটে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন মোহাম্মদ জাকারিয়া। তিনি দারুন নাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসা থেকে পাস করে ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। মোট ১২০ নাম্বারের মধ্যে তার প্রাপ্ত নাম্বার ১০০.৫। এমনকী গুচ্ছেও মাদরাসা ছাত্রের সাফল্য। প্রথম হয়েছেন রাফিদ হাসান সাফওয়ান। তিনিও একই মাদরাসার ছাত্র।
আমি অবাক হচ্ছি, যারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তাদের বিস্মিত হওয়া দেখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা একটি নির্দিষ্ট কাঠামোয় অনুষ্ঠিত হয়। যোগ্যতা যাচাই হয়। তার সঙ্গে মাদরাসা-অমাদরাসার কোনো সম্পর্ক নেই। মেধা ও যোগ্যতা আছে এমন যেকেউ সেখানে অংশ নিতে পারেন। নিজের যোগ্যতা বিবেচনায়। জাকারিয়া কিংবা রাফিদও তাই করেছেন। অংশ নিয়েছেন পরীক্ষায়। নিজের যোগ্যতায় এবং প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। আমরা কিছু অচল, বস্তাপচা, বাতিল, রদ্দি, মান্ধাতা আমলের ধারণা নিয়ে বসবাস করি যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করি। এই তথাকথিত প্রগতিশীলতা খুব ভয়ংকর। ভয়াবহ কট্টরপন্থিতা। তারা তাদের মতো না হলে, জীবনযাপন না করলে, চিন্তা ভাবনা না করলে এই দুনিয়ায় আর কাউকে আধুনিক বলে মনে করে না। অথচ চিন্তার এই অসারতা, অনগ্রসরতা, কূপমণ্ডুকতা যে চূড়ান্ত। অনাধুনিক তাদের কে বোঝাবে?
মাদরাসা সম্পর্কে একটা অদ্ভুত নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত। মাদরাসার ছাত্ররা অমেধাবী, অনগ্রসর, উগ্রপন্থী, ধর্মান্ধ, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ধারণাটি অরোপিত। ইনজেকটেড টু সোসাইটি। মেধার সাথে মাদরাসা অমাদরাসার সম্পর্ক নেই। মেধা বিকাশের সুযোগ তৈরি সঙ্গে আছে হতো। মাদরাসা ছাত্রদের আমরা কি মূলস্রোতে আসতে দেই? কতোটা সুযোগ দেই তাদের সব কিছুতে অংশগ্রহণে? তাদের তো আলগা করে রাখি, আলাদা করে রাখি। বলি, ‘তুমি ভিন্ন, তুমি হুজুর, তুমি মোল্লা’। তারাও আলাদা করে রাখে নিজেদের মেশবার সুযোগ না পেয়ে। এক বিশাল দেয়াল করে ঘেরাটোপের মধ্যে বসবাস করতে দেই তাদের, তারাও করে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে কেন, এখন প্রযুক্তি সবার হাতের নাগালে। ইন্টারনেট এখন সবার কাছে। কারো সৎ ইচ্ছা থাকলে সে ভালো কাজ করতে পারে। কেবল বাইরে থেকে এসি রুমে বসে মাদরাসার ছাত্রকে জঙ্গি, মৌলবাদী বললেই হবে না। জঙ্গিবাদেও সঙ্গে টুপি আর অটুপির কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক নেই পোশাকেরও। সারা দুনিয়া জুড়ে জঙ্গিবাদ একটি রাজনৈতিক কৌশল এবং অস্ত্র।
মাদরাসার ছাত্রদের বরং কে বা কারা তাদের উগ্রপন্থী করে তুলছে, কার স্বার্থে তা দেখতে হবে।
মাদরাসার ছাত্রটিও দেশপ্রেমে উদ্ভূত হয়ে কাজ করতে চায়। রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির বাইরে এসে জয় বাংলা স্লোগান দিতে চায়। সৃজনশীলতা তার মধ্যেও কম নয়। তারও সাহিত্যের প্রতি প্রেম আছে। সেও গল্প লেখে। কবিতা লেখে। নাটক লেখে। ছবি দেখে। কেবল দাড়ি, টুপি দেখলেই মোল্লা, মৌলবাদী তকমা লেভেলিং করে দেয়া ভুল। উগ্রপন্থিতা আর কট্টরপন্থিতা তো যার যার ব্যক্তিগত। বহু কোট টাই পড়া, বুকে কাপড় খোলা, স্লিভলেসের মধ্যেও কট্টরপন্থিতা প্রবল। অমানবিকতার চাষাবাদের বাম্পার ফলন। এই অমানবিক মানুষ, কট্টরপন্থী মানুষ জগতের যেখানেই যাক, মানুষের কোনো উপকারে আসবে না। কেবল নিজের স্বার্থ বিবেচনা ছাড়া।
স্কুল-কলেজ-মাদরাসা বিষয় নয়। বিষয় মানবিকতা, মানবিক মানুষ হওয়া। মানসিকতা; সুস্থবোধসম্পন্নতা, যার মধ্যে থাকবে সে কখনো উগ্রপন্থী হবে না, হবে না কট্টরপন্থিও। হবে বিপুল বিস্তারিত এক সমুদ্রমন, আকাশসম মানুষ।
এই তরুণদের অভিবাদন। তাদের সাফল্য আর সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা। এগিয়ে এসো হে তরুণ, আগামীর বাংলাদেশ গড়ো। দুর্নীতিমুক্ত, ধর্মান্ধতামুক্ত, দেশপ্রেমেভরা এক সোনার বাংলা।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচকে