ফিরে আসুক সম্প্রীতি
পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রয়াত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের একটি সুলিখিত উপন্যাসের নাম ‘আবার কর্ণফুলী আবার সমুদ্র’। সাম্প্রতিক সময়ে যা ঘটছে তা দেখে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, ‘আবার গুজব, আবার অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা’। এবার লক্ষ্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশে গুজব রটিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অত্যন্ত আনন্দের উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানকে নষ্ট করল কিছু দুষ্কৃতকারী। কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে প্রতিমার কোলে কোরআন রেখে দিয়ে দেশের বিস্তীর্ণ অংশে অশান্তি সৃষ্টি করে নষ্ট করা হলো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। এই অন্যায় কাজে ব্যবহার করা হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও মসজিদ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে এই ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে। এখানেও ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে। দুই ক্ষেত্রেই পদ্ধতি এক—গুজব রটানো। লক্ষ্য, অশান্তি সৃষ্টি করে সামাজিক ঐক্য নষ্ট করা।
বিগত কয়েক দিন ধরে প্রিয় স্বদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নতুনভাবে সংঘটিত হলেও এর রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য বারবার হারিয়েছে তার যৌবন। প্রতিবার যে আঘাত এসেছে তা মানুষের প্রতি মানুষের আঘাত। ধর্ম সেখানে অজুহাত। ধর্মের নামে যে সহিংসতাগুলো আঘাত হেনেছে এই বাংলায় তা ধর্মের চেয়ে মজবুত করেছে স্বার্থকে। আর সেখানেই ফিকে হয়েছে ধর্মের বাণী, শান্তির বাণী। মানুষের প্রয়োজনে যেখানে মানুষ মরে, ধর্মের সেখানে কী কাজ?
যারা গুজব রটায় তারা একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই এ কাজ করে। তৃতীয় বিশ্বের পিছিয়ে থাকা সমাজ হলো, গুজব রটানোর উর্বর ক্ষেত্র। যেহেতু এই সমাজগুলোতে শিক্ষার প্রসার অপেক্ষাকৃত কম ফলে মানুষের মনে যুক্তির বদলে আবেগের প্রাবল্য বেশি। মানুষ দ্রুত গুজব বিশ্বাস করে নেয়। তারপর গুজব সৃষ্টিকারীদের হাতেই ক্রীড়নক হয়ে যায়। সমস্ত বোধবুদ্ধি হারিয়ে সে যুক্তিহীন আচরণ করতে থাকে। বিশিষ্ট ফরাসী সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্খেইম (Émile Durkheim) এই ধরনের আচরণকে এনোমিক বিহেভিয়ার বলে উল্লেখ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐক্যবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, ১৯৭৫ সালে তার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর স্বৈরাচারী ধর্মান্ধ শাসকরা বাংলাদেশকে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে নিয়ে গেছে ধর্মভিত্তিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় ব্যবস্থার দিকে।
মানুষ গুজবে বিশ্বাস করে উন্মাদের মতো আচরণ করলে লাভ হয় গুজব রটনাকারীদের। অল্প চেষ্টাতেই তাদের একেবারে ষোলোআনা সাফল্য মিলে যায়। শারদীয় দুর্গোৎসবে ঘটে যাওয়া ঘটনা তারই নমুনা।
মানুষের মনে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা চলল যে, হিন্দুরাই মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থকে অবমাননা করেছে। বাংলাদেশের অনেকগুলো অঞ্চলে হিন্দুদের পূজামণ্ডপ, মন্দির, আশ্রম, ঘরবাড়ি, দোকানপাটের ওপর আক্রমণ চলল। নিরীহ মানুষের মৃত্যু হলো। আক্রান্ত মানুষগুলোকে সারাজীবন এই বিভীষিকাময় স্মৃতি বহন করে যেতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা ঘটল তা হলো বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও একবার ভূলুণ্ঠিত হলো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐক্যবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, ১৯৭৫ সালে তার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর স্বৈরাচারী ধর্মান্ধ শাসকরা বাংলাদেশকে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে নিয়ে গেছে ধর্মভিত্তিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় ব্যবস্থার দিকে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণপণে চেষ্টা চালাচ্ছেন মৌলবাদী অপশক্তিকে হটিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। যে শক্তিগুলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের দালাল হিসেবে ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল তারা চাইছে না শেখ হাসিনা সফল হোন। তাই এই ষড়যন্ত্রের জাল বোনা।
সরকারের তদন্তে এটা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত, এই কাজ কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ করেনি। এই ভয়ংকর অপকর্ম করে নিজের ধর্মের মানুষদের জীবন ও জীবিকাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার মতো নির্বুদ্ধিতা কোনো হিন্দু করবে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই ঘটনা ঘটানোর জন্য যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সে একজন মুসলমান। যারা এই চক্রান্তের অংশ বলে সন্দেহের তালিকায় আছে তারাও মুসলমান। নিজে মুসলমান হয়ে পবিত্র কোরাআনকে অসম্মানিত করতে এদের হাত কাঁপল না? অশান্তি এবং সামাজিক অনৈক্য সৃষ্টি করতে এরা ধর্মকেই হাতিয়ার করল এবং অত্যন্ত খারাপ পদ্ধতিতে। এরা অবশ্যই সত্যিকারের মুসলমান নয়। এই ধরনের মানুষদের জন্যই গোটা বিশ্বে মুসলমানরা সমালোচিত হচ্ছে। এরা ইসলামকে রক্ষার দায়িত্ব নিজেরাই নিজের কাঁধে তুলে নেয়, আর ক্ষতি করে ইসলামের। এদের স্বার্থসিদ্ধির অন্যতম হাতিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এরা বহু মানুষকে নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশে এবার সেটাই ঘটেছে।
বাংলাদেশে সরকারের কড়া মনোভাবে মৌলবাদী শক্তিগুলো আপাতত পিছু হটলেও নিবৃত্ত হয়েছে বলা কঠিন। কারণ মৌলবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের সমন্বয়ে যে ভয়ংকর শক্তি বিগত শতাব্দীর শেষ থেকে গোটা বিশ্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তা এখন সমাজে একটি আপাত স্থায়ী রূপ নিয়ে নিয়েছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে নিরন্তর প্রয়াস চালানো জরুরি। এছাড়া মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদ কোনো দেশের সীমানায় আবদ্ধ থাকে না। এর একটা বিশ্বজনীন চরিত্র আছে। এক দেশ থেকে তা অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে কিংবা ছড়িয়ে দেওয়া হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণপণে চেষ্টা চালাচ্ছেন মৌলবাদী অপশক্তিকে হটিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে।
ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরায় সম্প্রতি যা ঘটেছে এবং সেইসব ঘটনা নিয়ে যেভাবে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বাংলাদেশে, তা দেখে এটা নিশ্চিতভাবেই মনে যায় মৌলবাদের শক্তিকে খাটো করে দেখলে বিপদকে ঘরের আঙিনায় রেখে দেওয়া হবে। ভারতের উত্তর- পূর্বাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরার তিনদিকেই বাংলাদেশ। ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার ৮৩.৪০ শতাংশই হিন্দু এবং বাংলাভাষীদের অধিকাংশই ১৯৪৬ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ত্রিপুরায় গিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন (সংখ্যাটা প্রায় নয় লক্ষ)। ফলে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার প্রভাব ত্রিপুরার সমাজ এবং রাজনীতিতে পড়াই স্বাভাবিক।
দুর্গাপূজা এবং তার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে অশান্তির আঁচ ত্রিপুরাতেও পড়েছে। গত ২৬ অক্টোবর ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে প্রায় ১৫৫ কিলোমিটার দূরে উত্তর ত্রিপুরা জেলার পানিসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে হিন্দু সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। অভিযোগ উঠেছে ওই মিছিল থেকেই সংখ্যালঘু মুসলিমদের কিছু ঘরবাড়ি ও দোকানপাট আক্রান্ত হয়েছে। এমনকি স্থানীয় একটি মসজিদেও হামলার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে এবং রাজ্যের প্রায় ১৫০টি মসজিদের সামনে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মানুষের আবাসস্থল কিংবা ধর্মীয় উপাসনালয়ের ওপর হামলা অত্যন্ত দুঃখের। তবে মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ অবশ্যই স্বস্তির। তবে মানুষ স্বস্তিতে থাকুক এটা কখনোই মৌলবাদীরা চায় না। তারা চায় কোনো না কোনোভাবে অশান্তি চলুক, মানুষ আক্রান্ত হোক। কারণ অস্থিতিশীল সমাজ মৌলবাদীদের হাতকেই শক্ত করে।
ত্রিপুরায় গত ২৬ অক্টোবর পানিসাগর ঘটনার পর শুরু হয়েছে গুজব ছড়ানো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন মসজিদ জ্বালিয়ে দেওয়ার ভুয়া খবর এবং ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভারতে তো বটেই বাংলাদেশের বহু মানুষ সেই ভিডিও দেখছেন, শেয়ার করছেন। নানা মন্তব্য ভেসে আসছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ত্রিপুরা রাজ্য পুলিশের পক্ষ থেকে গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু গুজব থেমে নেই। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে গুজব কখনো দেশের সীমানায় আবদ্ধ থাকে না। ছড়িয়ে পড়ে কিংবা বলা ভালো ছড়িয়ে দেওয়া হয় সমাজের কোণে কোণে। এর শিকার হয় অসহায় মানুষ।
ত্রিপুরার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে গুজব ছড়ানোর লক্ষ্য একটাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে কড়া ব্যবস্থা নিয়ে মৌলবাদ এবং সন্ত্রাসবাদকে দমন করার চেষ্টা করছেন তাকে কোথাও থামিয়ে দেওয়া। আবার বাংলাদেশকে অশান্তির আবর্তে ফেলে দেওয়া যাতে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।
ভারত এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এই দুই দেশকেই মেটাতে হবে, কারণ তারা স্বাধীন এবং সার্বভৌম। কোনো দেশেই অন্য দেশের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। কারণ তাতে সমস্যার কোনো সমাধান হয় না। আবার কেবল সরকারই সব সমস্যা মেটাতে পারে না। প্রয়োজন গণউদ্যোগ। গুজব রটনাকারীরা এই গণউদ্যোগকে বিনষ্ট করতে চায়। আমাদের দেখতে হবে আমরা যেন গুজব রটনাকারীদের হাতের পুতুল হয়ে না উঠি।
অনয় মুখার্জী ।। সাংবাদিক ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ