ওয়ালীউল্লাহ, লালসালু ও ধর্মান্ধ সমাজ
‘শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি।’—১৯৪৮ সালে যিনি একথা লিখেছিলেন এই সময়ে এসে তিনি সেকথা লিখতে পারতেন বলে মনে হয় না। যদিও ধর্মের আগাছায় বহুমাত্রিকভাবে ভরে উঠেছে বাংলাদেশ। ‘ডিজিটাল সাক্ষরতা’ ধর্মীয় নেতাকেও পাঠিয়ে দিয়েছে চাঁদে। কথা হচ্ছে করোনার জীবাণুর সঙ্গে।
নব্যপন্থী বনাম পুরনোপন্থী, আধুনিকতা বনাম পশ্চাৎপদতার তর্কে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কথাগুলো বলতে পেরেছিলেন। বিশ্বায়ন ও উন্নয়নের আলোক-উজ্জ্বল রঙ্গমঞ্চে একালে একথা বলা দুরূহ কর্ম বলে অনুভূত হয়। কল্পনা করি—নিষিদ্ধ হয়ে যেত বই, সমস্বরে তোলা হতো ধর্ম অবমাননার অভিযোগ, মাদরাসা ও মক্তব কেন্দ্রিক শিক্ষার সমালোচনা হিসেবে কাঠগড়ায় যেত লালসালু, হতে পারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে যাওয়া হতো পাঁচ দিনের রিমান্ডে!
এই কল্পনার পেছনে আছে বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক অনুষঙ্গ। কারণ ভিন্নমত দমনের সর্বাত্মক চেষ্টা নানাভাবে জারি আছে সমাজ ও রাষ্ট্রে। বাংলাদেশ এমন একটি দশায় উপনীত হয়েছে যে, যেখানে প্রচলিত কোনো কিছুর বিপরীতে কথা বলার মানেই বিপদে পড়া, ঝুঁকি বাড়ানো; হয় রাষ্ট্র, নয় গোষ্ঠী, নয় সর্ববিদ্যা বিশারদ, বিশেষজ্ঞ ভার্চুয়াল সমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। সেখানে ধর্ম কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ক কোনো সমালোচনা করা আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ!
আরও পড়ুন : বিতর্কিত রবীন্দ্রনাথ?
নাগরিক হিসেবে দুটোর একটিকে আপনার মানতেই হবে, এর বাইরে ধর্মহীন, অজ্ঞেয়বাদী, ক্রিটিক্যাল ভাবুকের অস্তিত্ব মানেই দুপক্ষের আগুন দৃষ্টি পুড়িয়ে দেবে সবকিছু। কিন্তু একটি মুক্ত সমাজ কি এমন হতে পারে? তর্ক, বিতর্ক ছাড়া কি ধর্মও বিবর্তিত হয়েছে? ধর্ম নিজেই মানুষের সভ্যকরণ প্রক্রিয়ার শক্তিশালী উপাদান।
কল্পনা করি—নিষিদ্ধ হয়ে যেত বই, সমস্বরে তোলা হতো ধর্ম অবমাননার অভিযোগ, মাদরাসা ও মক্তব কেন্দ্রিক শিক্ষার সমালোচনা হিসেবে কাঠগড়ায় যেত লালসালু, হতে পারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে যাওয়া হতো পাঁচ দিনের রিমান্ডে!
ভিন্ন চিন্তার প্রকাশ মাত্রই উদ্ধত হাতে তাকে দমন করা হয়। এ প্রবণতা নিশ্চিতভাবেই ফ্যাসিস্ট। ধর্ম কেন্দ্রিক ফ্যাসিস্ট চিন্তার কমপক্ষে দুটি আদর্শ সক্রিয়। এক দিকে, ইসলামকে বাঙালি এবং মানব সমাজের চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে নির্দেশ করা, অন্য দিকে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে আধিপত্যবাদী কাঠামোয় উপস্থাপন করা—ধর্মের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রতিরোধমূলক অবস্থানকে অস্বীকার করা। আদতে এ দুটোই বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী অবস্থান। কোনো অবস্থানই বহুত্ববাদী চিন্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। লালসালু উল্টাতে উল্টাতে এই কথাগুলোই প্রথমে মনে এলো।
বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবতে হলো, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এমন কথাও লিখতে পেরেছিলেন, ‘ভোরবেলার এত মক্তবে আর্তনাদ ওঠে যে, মনে হয় এটা খোদাতা’লার বিশেষ দেশ। ন্যাংটা ছেলেও আমসিপারা পড়ে, গলা ফাটিয়ে মৌলবি বয়স্ক গলাকে ডুবিয়ে সমস্বরে চেঁচিয়ে পড়ে। গোঁফ উঠতে না উঠতেই কোরান হেফজ করা সারা। সঙ্গে সঙ্গে মুখেও কেমন-একটা ভাব জাগে। হাফেজ তারা। বেহেশতে তাদের স্থান নির্দিষ্ট।’
আরও পড়ুন : নতুন আলোয় জেগে উঠুক শিশুসাহিত্য
তিরিশ চল্লিশের দশকের মুসলমান সমাজের বিশিষ্ট চেহারা এটি—মোটেও কোনো অনৈতিহাসিক ছবি নয়। শুধু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নয় তার আগের পরের অনেকের সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের এই দৃশ্য পাওয়া যাবে—যেখানে পীরবাদ, মাজার ব্যবসা, ধর্ম ব্যবসা সামাজিক পটভূমি। সওগাত, শিখা পত্রিকা কিংবা বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি মুসলমানের গোড়ার গলদগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এতে সন্দেহ নেই যে, রেনেসাঁবাদী একটি ঝোঁক মুসলমান সমাজেও আলোড়ন তুলেছিল।
লালসালুর সমাজপট সামনে রেখে অনেকে বলেন, ওয়ালীউল্লাহ আধুনিক শিক্ষা ও ধর্মাদর্শ কেন্দ্রিক শিক্ষার তর্কে সেক্যুলার শিক্ষার প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। আদতে কি তা-ই? প্রকৃতপক্ষে দুই শিক্ষা ধারার সীমাবদ্ধতা শনাক্ত করেছেন তিনি।
সমাজের আধুনিক বর্গের ছবিতে দেখান ‘বাইরে বিদেশি পোশাক, মুখমণ্ডলও মসৃণ। কিন্তু আসলে ভেতরে মুসলমান। কেবল নতুন খোলস পরা নব্য শিক্ষিত মুসলমান।’ বোঝাই যাচ্ছে, ওয়ালীউল্লাহর দেখা শিক্ষিত মুসলমান শ্রেণিগতভাবে সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্রহীন সত্তা।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের সাহিত্য : পঞ্চাশ পেরিয়ে
কেউ কেউ আরেকটু আগ বাড়িয়ে বলেন, ওয়ালীউল্লাহ ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতিকে নেতিবাচকভাবে দেখিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, সংস্কৃতির কোনো অংশ যদি সামাজিক সমস্যার জন্ম দেয়, সেটির সীমাবদ্ধতা দেখানো সমাজ-সদস্যের কাজও নয় কি?
সমাজের অপরাপর সংকটের উপস্থাপনায় সমস্যা না থাকলে, ধর্ম বিশ্বাসকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা ব্যবসা-বুদ্ধির উপস্থাপনায় সমস্যা কোথায়? এমন তো নয় যে, বিশ্বাস কেন্দ্রিক সমস্ত আয়োজন ও ব্যবস্থা ধর্মের পারমার্থিক ও আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যে সবসময় ভরপুর।
গ্রামীণ ও শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্তের দ্বান্দ্বিক মনস্তত্ত্বকে বুঝতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তৈরি করেছেন মজিদ, আরেফ আলী ও মুহাম্মদ মুস্তফার মতো চরিত্রকে—যাদের একজন আরবি হরফ পড়া মুসলমান, একজন গ্রামের স্কুলের শিক্ষক, অন্যজন উচ্চশিক্ষিত ‘ছোট হাকিম’। তিনজনই উঠে এসেছে সমধর্মী গ্রামীণ সমাজ থেকে। এই সমাজের আধার ও আধেয় হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ গড়ে তুললেন তিন বিচ্ছিন্ন মানুষ, নিঃসঙ্গ নায়ক।
ধর্ম শিক্ষা বা সেক্যুলার শিক্ষা কোনোটিই তাদের দেয়নি সমাজ ও সংস্কৃতির গভীর মূলে প্রবেশ করার সুযোগ। বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে মজিদ তবু একটি ক্ষমতা বলয় তৈরি করতে পেরেছিল। কিন্তু আরেফ আলী কিংবা মুহাম্মদ মুস্তফা ছিল একেবারেই আমূল বিধ্বস্ত মানুষ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মূলত বাঙালি মুসলমান সমাজের সদর ও অন্দরে উঁকি দিয়েছেন।
কেউ কেউ আরেকটু আগ বাড়িয়ে বলেন, ওয়ালীউল্লাহ ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতিকে নেতিবাচকভাবে দেখিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, সংস্কৃতির কোনো অংশ যদি সামাজিক সমস্যার জন্ম দেয়, সেটির সীমাবদ্ধতা দেখানো সমাজ-সদস্যের কাজও নয় কি?
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সত্য হিসেবে আবির্ভূত বিষয়বস্তুকে সাহিত্যে ধারণ করতে চেয়েছেন তিনি। হয়তো তিনি হদিস নিচ্ছিলেন আত্মপরিচয়ের; তর্ক করছিলেন নিজের সঙ্গে নিজে, তর্ক করছিলেন নিজের শ্রেণি ও সমাজ সত্তার সঙ্গে।
আরও পড়ুন : সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন এবং বাস্তবের ফাঁক-ফাঁকি
কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, শওকত ওসমানকে যেতে হয়েছে এইসব জিজ্ঞাসা, তর্ক ও মীমাংসার ভেতর দিয়ে। তারা তাই ঝুঁকিও নিতে পেরেছিলেন। তাদের বুঝতে হয়েছে বাঙালি মুসলমান সমাজের নিজস্ব সমস্যা; একই সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছে বাঙালি হিন্দু-ব্রাহ্ম ঐতিহ্যের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য। আর ক্ষমতার পিরামিডে শীর্ষস্থানে থাকা ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও মিলনের সম্পর্ক বজায় রাখতে তৈরি করতে হয়েছে সুবিধাজনক অবস্থান।
সমাজ সত্তার মর্মে প্রবেশের ঐতিহাসিক দায়িত্ব এসে পড়েছিল ঔপন্যাসিকদের হাতে। বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস অন্তত তা-ই বলে। প্যারীচাঁদ মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিদ্যমান সামাজিক তর্কগুলোকে স্থান দিয়েছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে। অনেক অনেক বাংলা উপন্যাসের নাম নেওয়া যাবে যেগুলোতে সমাজ ও সংস্কৃতির প্রচলিত ডিসকোর্সের পাঠ ও সমালোচনা হাজির।
ওয়ালীউল্লাহ সমাজকে বুঝতে চেয়েছেন প্রধানত ব্যক্তি মানুষকে পাঠ করার মাধ্যমে। কিন্তু সময় ও সমাজের চঞ্চলতাকে উপেক্ষা করেননি। উপন্যাসের মূল বিষয়ের সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে যোগ করে দিয়েছেন ইসলাম ও মুসলমান সমাজের ইতিহাস, বাংলা অঞ্চলের ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ।
আরও পড়ুন : মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
লাল রঙের সালু কাপড়টি যেন নিষেধের প্রতীক—বাঙালি মুসলমানের চোখের সামনে ঝুলে থাকা রহস্য। বিশ্বাসের পাটাতন ভেঙে কেউ সেই মোড়ক সরিয়ে দেখতে চাইছেন না। কিন্তু কেউ কেউ প্রথা ভেঙে আচ্ছাদনে ঢাকা সত্যকে দেখতে চান, দেখাতেও চান। ওয়ালীউল্লাহর ইচ্ছে ছিল সত্য আবিষ্কারের; তার সাহিত্যের বড় অংশ জুড়ে আছে রহস্য সরিয়ে জীবনের মূল স্পন্দনটিকে বোঝার উদ্যোগ।
সম্ভবত সময় আমাদের ইশারা করছে সমাজ ও সত্যকে বুঝে নিতে। অনেককিছুই আবার সালু কাপড়ে ঢাকা পড়েছে; নাস্তিকতার অজুহাতে রক্তের বান বইয়ে দেওয়া হয়েছে, মুক্তচিন্তার নামে ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতিকে আক্রমণ করা হয়েছে, ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রদর্শনবাদিতার আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে সাম্প্রদায়িক ভাবনাপুঞ্জ। কিন্তু এসব নিয়ে প্রত্যক্ষ উচ্চারণে কোথায় যেন বাধা; কোত্থেকে যেন উড়ে আসে নিষেধের লালসালু। তাই আমাদের কথা বলতে ভয়, ভয়কেই আমরা সমীহ করতে শিখছি। কিন্তু লালসালু কাপড়ে ঢাকা সেইসব আড়াল সরাবে কে?
সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়