শিক্ষক ও শিক্ষকতা
যাদের কাজ সমাজে সবচেয়ে বেশি ভ্যালু বা মূল্য যোগ করে তারা হলেন কৃষক। কেবল একবার ভাবুন, কৃষকরা যদি একটা মৌসুম ধর্মঘট করে আমাদের খাবার টেবিলের কী হবে? অথচ তারাই সবচেয়ে বেশি গরিব। আরেকটা শ্রেণি আছে যাদের কাজ সমাজে অদেখা মূল্য সংযোগের মাধ্যমে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তারা হলেন শিক্ষক।
একটি সমাজ কতটা সভ্য হবে সেটা শিক্ষকরাই নির্ধারণ করবেন। শিক্ষকরা যত বেশি মানসম্পন্ন হবেন দেশটা তত বেশি মানসম্পন্ন হবে। অথচ আমাদের দেশে কৃষকদের পরেই শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। এই দেশের জাতীয় গণমাধ্যম দেখলে দেখবেন, অমুক কলেজের অধ্যক্ষকে তালাবদ্ধ করে রেখেছে, ওই স্কুলের শিক্ষককে নকল ধরায় রাস্তায় মেরেছে, এমনকি মেরে ফেলার উদাহরণও আছে, শিক্ষককে কান ধরিয়ে উঠবস করানোর সংবাদও পাই।
পৃথিবীতে এমন একটি দেশ দেখানতো যেখানে শিক্ষার্থী তার নিজ শিক্ষকের গায়ে হাত তুলেছে? বা নির্বাচিত প্রতিনিধি শিক্ষককে মারধর কিংবা গায়ে হাত তুলেছে? আর যদি কোথাও হয়েও যায় সেখানে সেই এলাকার মানুষ প্রতিবাদে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলবে। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা বা অপমান করা কিংবা অবহেলা করা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
এই দেশে কোন পেশা সবচেয়ে বেশি কাঙ্ক্ষিত? প্রশাসন, আইনজীবী, ব্যবসা ইত্যাদি পেশা সরাসরি সমাজে কোনো ভ্যালু যোগ করে না। অথচ এরাই অর্থ-বিত্তে সবচেয়ে ভালো থাকে।
আমরা জানি, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক থেকে ছাত্রদের মাঝে জ্ঞানের প্রবাহ তখনই সম্ভব যখন শিক্ষকের জ্ঞান ছাত্রদের থেকে অনেক বেশি থাকে। এইটা অনেকটা পানির প্রবাহের মতো। পানির প্রবাহের জন্য যেমন উচ্চতর গ্র্যাডিয়েন্ট বা ঢাল লাগে তেমনি জ্ঞানের প্রবাহের জন্যও জ্ঞান, সম্মান এবং সম্মানীর ঢাল লাগে। এমন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে যেন তারা জ্ঞান-বুদ্ধিতে এমন উঁচুতে থাকেন যাতে সমাজ তথা শিক্ষার্থীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্মান করবে।
একটি সমাজ কতটা সভ্য হবে সেটা শিক্ষকরাই নির্ধারণ করবেন। শিক্ষকরা যত বেশি মানসম্পন্ন হবেন দেশটা তত বেশি মানসম্পন্ন হবে। অথচ আমাদের দেশে কৃষকদের পরেই শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত।
সম্মান কখনো জোর করে বা আইন দিয়ে করানো যায় না। সেইরকম ভালো শিক্ষক পেতে হলে শিক্ষকদের বেতন ও সুবিধাদি অন্য অনেক পেশা থেকে উন্নত হতে হবে। তাহলেই কেবল মেধাবীরা এই পেশায় আসবেন। আর তখনই শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞান প্রবাহের ঢাল বৃদ্ধি পাবে এবং জ্ঞান সুষ্ঠুভাবে প্রবাহিত হবে। তাই রাষ্ট্রের উচিত এই ঢাল নির্ধারণে ভূমিকা রাখা।
বর্তমানে শিক্ষকদের পেশাটির কী অবস্থা সেটি গতকালকের একটি সংবাদ পড়লেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক এক দফা বিসিএস দিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়ে শিক্ষক হয়েছেন। তিনি আবার বিসিএস দিয়ে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন। প্রশাসন ক্যাডারে যোগ ফিয়ে তিনি টানা তিন ঘণ্টা শিক্ষকতা করে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। এই হলো এই দেশের শিক্ষকদের দশা।
আমাদের দেশে জ্ঞান প্রবাহের ঢাল কীভাবে হবে যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদা দেওয়া হয়? একটি সভ্য দেশে এটি কল্পনা করা যায়? অথচ সমাজের অন্য কোনো পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ দেখা যায় না। গত ৩০-৪০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই দেশের কোনো সরকার শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়নি।
ইউনেসকো বলেছে, একটি উন্নত রাষ্ট্র হতে হলে সেই দেশকে তার জিডিপির অন্তত ৫% শিক্ষায় বরাদ্দ দিতে হবে। অথচ গত ৩০-৪০ বছরের সব সরকার জিডিপির ১.৮% থেকে ২.২% শিক্ষায় বরাদ্দ দিয়েছে। এই স্বল্প বরাদ্দের একটা বড় অংশই চলে যায় তাদের পেছনে, যাদের কাজ সমাজে তেমন কোনো ভ্যালু যোগ করে না। শুধু তাই না এই স্বল্প বরাদ্দের একটা বড় অংশই চলে যায় অবকাঠামো নির্মাণ ও দুর্নীতিতে। যার কারণে বেচারা শিক্ষকরা এত অবহেলিত।
আমাদের সরকার যে শিক্ষা এবং শিক্ষকদের কথা কতটা ভাবেন তা বোঝা যায় আমাদের শিক্ষানীতি তৈরি এবং তার বাস্তবায়নের দিকে একটু নজর দিলে।
ইউনেসকো বলেছে, একটি উন্নত রাষ্ট্র হতে হলে সেই দেশকে তার জিডিপির অন্তত ৫% শিক্ষায় বরাদ্দ দিতে হবে। অথচ গত ৩০-৪০ বছরের সব সরকার জিডিপির ১.৮% থেকে ২.২% শিক্ষায় বরাদ্দ দিয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত সাতটি শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে। সরকার একজন দেশবরেণ্য শিক্ষকের নেতৃত্বে একদল শিক্ষাবিদ দিয়ে এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। তথাপি আজ পর্যন্ত কোনো সরকার তাদের আমলে তৈরি শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করেনি। এইটা একটা চরম ধাঁধা। কেন তাহলে শিক্ষকদের দিয়ে শিক্ষানীতি বানায়? কেন এত এত শিক্ষকদের এত কর্মঘণ্টার অপচয় করল? এর কোনো সদুত্তর আছে? নেই।
এই সরকারও আমাদের জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিশন করেন যেখানে দেশ বরেণ্য শিক্ষাবিদরা এর সদস্য ছিলেন। সরকার টানা তিনবার ক্ষমতায়। তথাপি তাদের আমলের তৈরি শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের পথে না হেঁটে এমন সবকিছু করছে যা দেশের শিক্ষার মানের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। যেমন পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষার কথা শিক্ষানীতিতে না থাকলেও এই সরকার চালু করেছে। কয়েক বছর চালিয়ে বুঝতে পেরেছে এইটা ঠিক হয়নি।
তেমনি শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, দেশের চলমান শিক্ষায় বিদ্যমান নানা মাধ্যমের একটা সমন্বয় করে একমুখী শিক্ষার দিকে নেওয়া। সরকার কী করছে? নবম ও দশম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য শাখা উঠিয়ে বিজ্ঞানকে নামিয়ে সকলকে ১০টি বিষয় পড়তে বাধ্য করার শিক্ষাক্রমের একটা নতুন রূপরেখা চালু করতে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো কাদের নেতৃত্বে আনছে? যারা শিক্ষার সাথে সরাসরি জড়িত না। যাদের কাজ সমাজে সরাসরি কোনো ভ্যালু যোগ করে না।
একজন জাতীয় অধ্যাপকের নেতৃত্বে শিক্ষানীতি করে সেটা বাস্তবায়ন না করে আমলাদের নেতৃত্বে কমিটি করে উল্টো পথে যাওয়া কি শিক্ষকদের অপমান নয়? গত ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্ক্যালের মাধ্যমে শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি অপমান করা হয়েছে। যাদের হাতে সরকারকে অবৈধভাবে সাহায্যের ক্ষমতা আছে তাদেরকে উপরে তুলে শিক্ষকদের অবস্থান অনেক নিচে নামানো হয়েছে। এইসব কিন্তু দিন শেষে ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না। তার লক্ষণ কিন্তু আমরা দেখছি। দেশে সততা উঠে গেছে।
তারপরেও মানুষ শিক্ষকতা পেশায় আসেন। কারণ এটি এমন একটি পেশা যার মাধ্যমে একজন শিক্ষক শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজে শিখবেন ও শানিত করে জ্ঞানী নিজে হবেন এবং তার জন্য বেতন পাবেন। এইরকম পেশা আর আছে?
মানুষকে মানুষ বানানোর কাজ শিক্ষকদের। এই কাজের গুরুত্ব যারা বুঝে না তাদের শিক্ষক বানালে বিপত্তি ঘটবেই। এই কাজের গুরুত্ব যারা বুঝে না শিক্ষক বানালে তারাতো শিক্ষক সুলভ আচরণ করবে না। এতে শিক্ষকতা পেশার উপর কালিমা পড়ে। এইরকম শিক্ষকের ভিড়ে পঙ্কজ মধুর মতো শিক্ষকও আছেন, যিনি শিক্ষার্থীর সন্তান কোলে রেখে ক্লাস নিয়ে আলোচনায় এসেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাল্যবিবাহের শিকার এক ছাত্রীর শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে ক্লাস নিয়েছেন পঙ্কজ মধু। ৩ অক্টোবর সকালে সদর উপজেলার চিনাইর আঞ্জুমান আরা উচ্চ বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীকে পাঠে মনোযোগী করে তোলার জন্য তিনি শিশুটিকে কোলে নিয়ে ক্লাস নেন। এইরকম শিক্ষকদের কারণে শিক্ষকতা মহান হয়ে ওঠে।
আশা করি, সরকার শিক্ষার গুরুত্ব, শিক্ষকের গুরুত্ব বুঝে সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখবে এবং শিক্ষায় জিডিপির ৫% বরাদ্দ দিবেন। শিক্ষক দিবসে সকল শিক্ষকদের শুভেচ্ছা।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়