সঞ্চয়পত্র : মুনাফা হ্রাস, সংকট ও বাস্তবতা
ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের অন্যতম জনপ্রিয় আর্থিক পণ্য হলো সঞ্চয়পত্র। নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ, বিশেষত সীমিত আয়ের চাকুরীজীবী, উপার্জন ক্ষমতাসম্পন্ন নারী, পেনশনভোগী অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা- কর্মচারীরা তাদের সঞ্চয়ের সিংহভাগ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে থাকেন। সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত মুনাফাই অনেক পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস যা দিয়ে তাদের সংসার পরিচালনার যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করতে হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এক প্রজ্ঞাপন জারি করে পাঁচ রকমের সঞ্চয়পত্রের উপর নির্ধারিত সুদের হার হ্রাস করেছে। একইসাথে প্রথমবারের মতো মুনাফার হারের আলাদা স্তর নির্ধারণ করে দিয়েছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, যে যত বেশি বিনিয়োগ করবে তার মুনাফার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে।
সরকারি অর্থায়নের একটি হাতিয়ার হলো সঞ্চয়পত্র। সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সংগৃহীত অর্থ ও তার উপর প্রদত্ত সুদ সরকারের দায় হিসেবে বিবেচিত হয়। বিগত কয়েক বছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ বাজেটে প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রাকে অনেকাংশে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যার কারণে সরকারের সুদ বাবদ ব্যয় প্রতিবছর বেড়ে যাচ্ছিল।
সরকারি ভাষ্যমতে, ক্রমবর্ধমান সুদ ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতেই সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কর্তনের এই সিদ্ধান্ত। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের জন্য এই সিদ্ধান্ত বিনা মেঘে বজ্রপাত মনে হলেও দীর্ঘদিন থেকেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকের আমানত দুটোই অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। দুটি একই ধরনের আর্থিক পণ্যের মুনাফার হারে ব্যাপক তারতম্যের কারণে অনেক উচ্চবিত্ত শ্রেণির বিনিয়োগকারীরাও সঞ্চয়পত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিল।
এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সুদের উপর উৎসে কর্তনকৃত করের হার বৃদ্ধি, সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের সময় টিআইএন জমা বাধ্যতামূলক করা, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা কমিয়ে আনা ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে।
সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর আরেকটি কারণ হলো, বিনিয়োগের বিকল্প মাধ্যমগুলোর মুনাফার হারের তারতম্য কমিয়ে আনা। সঞ্চয়পত্রের একটি বিকল্প হলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মেয়াদি আমানত। গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদের হার নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় মেয়াদি আমানত থেকে আয়ের সুযোগও সংকুচিত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, মেয়াদি আমানতের সর্বোচ্চ সুদ হার ৬ শতাংশ। তবে অনেক ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের এর থেকেও কম সুদ দিয়ে থাকে। বাৎসরিক মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশ ধরলে বাস্তবিক অর্থে লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে নেয়। ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ শতাংশ এর কিছু বেশি।
সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকের আমানত দুটোই অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। দুটি একই ধরনের আর্থিক পণ্যের মুনাফার হারে ব্যাপক তারতম্যের কারণে অনেক উচ্চবিত্ত শ্রেণির বিনিয়োগকারীরাও সঞ্চয়পত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। এর প্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, বিনিয়োগ মাধ্যমগুলোর মুনাফার হারে ভারসাম্য আনা। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর সরকারি এই সিদ্ধান্তে অর্থনীতিবিদদের দাবিই প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো শেয়ারবাজার। শেয়ারবাজারে যে সকল আর্থিক পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা হয় তার মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার, বন্ড ও মিউচুয়াল ফান্ড অন্যতম। তবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অনেকেই এখানে বিনিয়োগ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।
বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষ, বয়স্ক ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য শেয়ারবাজার উপযুক্ত বিনিয়োগ ক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে মিউচুয়াল ফান্ডকে ব্যাংক আমানতের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হলেও এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি।
শেয়ারবাজারে একশ্রেণির দুষ্টচক্র সবসময় সক্রিয় থাকে যাদের ফাঁদে পড়ে অতীতে অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। যার ফলস্বরূপ নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কাছে শেয়ারবাজার এখনো আকর্ষণীয় বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে ওঠেনি। এসব কারণে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে নিরাপদ বিনিয়োগমাধ্যম হিসেবে সঞ্চয়পত্রের চাহিদা অতুলনীয়।
সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর সিদ্ধান্তকে অর্থনীতিবিদরা স্বাগত জানালেও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশ মানুষ আশাহত হয়েছে। বিশেষ করে জীবিকা নির্বাহের জন্য সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল পরিবারগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে নিশ্চিতভাবেই অবসরভোগী, নারী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের আয় কমে যাবে।
সঞ্চয়পত্র থেকে আয়ের সুযোগ কমে যাওয়ায় মানুষ এখন অধিক লাভের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহী হবে যা তাদের স্বল্প সঞ্চয়কে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বগতি রোধ ও ক্রমবর্ধমান সুদ ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক সুরক্ষার বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্রকে দেখতে হবে আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। সঞ্চয়পত্রের সুদ সরকারের দৃষ্টিতে শুধুমাত্র একটি খরচের খাত হলেও স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে তা আয়ের নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।
গত এক বছর ধরে করোনা মহামারির ছোবলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে এসেছে। যার প্রভাবে নিম্ন আয়ের মানুষদের অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথ রুদ্ধ হয়েছে ও মানুষের আয়ের সুযোগও সংকুচিত হয়ে এসেছে। এমন দুর্যোগের সময়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোকে দেখা হচ্ছে মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে।
সঞ্চয়পত্র থেকে আয়ের সুযোগ কমে যাওয়ায় মানুষ এখন অধিক লাভের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহী হবে যা তাদের স্বল্প সঞ্চয়কে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলবে। তাই সরকারের উচিত হবে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর পাশাপাশি নিরাপদ ও শক্তিশালী বিকল্প বিনিয়োগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এছাড়াও বয়স্ক, নারী, পেনশনভোগী ও অবসরপ্রাপ্তদের জন্য মুনাফার হার অপরিবর্তিত রাখার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।
সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদের হার না কমিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনতে আগ্রহী ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের আয়ের বিভিন্ন উৎস আছে ও সকল উৎস মিলিয়ে যাদের বাৎসরিক আয় ২৫ লক্ষ টাকার বেশি তাদের জন্য বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া ও সুদের হার কমানোর বিষয়টি বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। এর ফলে একদিকে যেমন সরকারের সুদ ব্যয়ের সাশ্রয় হবে অন্যদিকে উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের আগ্রহ কমে আসবে।
সর্বশেষে সঞ্চয়পত্র বিষয়ক যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে সঞ্চয়পত্রের মূল গ্রাহক দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক সুরক্ষার বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনায় রাখতে হবে।
ড. রঞ্জন কুমার মিত্র ।। সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়