সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা : চেতনা জাগুক মনে
আমরা ভুলেই গিয়েছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র স্বাধীন ভূখণ্ড পাওয়ার যুদ্ধ ছিল না। ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলন দিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের দাবি। সংস্কৃতি একটি উপন্যাস হলে, ভাষা তার প্রথম অধ্যায়। সেই ভাষাকে ভিত্তি করে অন্যান্য অধ্যায়গুলোর বুনন হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য রক্ষার লড়াই।
স্বাধীন ভূখণ্ডে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ধর্মের সমন্বয়ে, আদিবাসী, নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সকল লিঙ্গের মানুষ এবং তাদের ভাষা, আচার, উপাসনা নিজের মতো করে পালন করবার লড়াই ছিল, একাত্তর।
একটা দেশ সম্পর্কে জানতে গেলে সবচেয়ে আগে যেসব তথ্যগুলো জানানো হয়, সেগুলো হচ্ছে কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস, শিক্ষা, প্রকৃতি, গান, চলচ্চিত্রের মতো বিভিন্ন ধারাগুলো। আমরা যখন আমাদের দেশের এই তথ্যগুলো তুলে আনতে থাকি তখন সেই একাত্তর পূর্ববর্তী সময়ের সোনালি অতীত ছাড়া তেমন কোনো নতুন সৃষ্টিশীলতা দেখাতে পারি না।
স্বাধীন হওয়ার পর গত পঞ্চাশ বছরে হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র, উপন্যাস, গান বা নাটক আমরা মনে করতে পারি। অথচ আমাদের কত শত গল্প বলার ছিল, সাহিত্য লেখার কথা ছিল, বছর বছর নতুন সাফল্যে ভরপুর সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল।
সংস্কৃতি একটি উপন্যাস হলে, ভাষা তার প্রথম অধ্যায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য রক্ষার লড়াই।
আজকাল যেকোনো শূন্যতার তল খুঁজে না পেলে তরুণদের দিকে আঙুল তুলি, সহজ পথে নিজ দায়িত্ব ঝেরে ফেলার উপায়। অথচ আমরা তারুণ্যের সংজ্ঞা জানতে চাই না আর। একাত্তর পূর্ববর্তী এক দশক খেয়াল করে দেখলে খুব সহজ সাধারণ তারুণ্যের দেখা পাওয়া যায়।
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঝাঁক বেঁধে সোনালি তারুণ্যের সাক্ষাৎ মেলে। সেখানে বিভিন্ন বয়সী ছাত্র, লেখক, সাংবাদিক, অভিনেতা, সংগীত পরিচালক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এমনকি চলচ্চিত্র পরিচালকেরও দেখা মেলে। ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী হওয়ার পরও তারা দেশ স্বাধীনের বীজমন্ত্রে এক মঞ্চে এসে দাঁড়াতেন।
প্রতিবাদে নাটক করতেন, গান লিখতেন, মিছিল করতেন, সত্যের পাশে থাকতেন। তখনকার রাজনীতিবিদেরাও সেই তারুণ্যের এক ভাগে থাকতেন, চায়ের আড্ডায় সু-তর্কের ঝড় তুলতেন। মিছিলে কণ্ঠ মেলাতেন। মতামতে শ্রদ্ধা জানাতেন। সমষ্টিগত তারুণ্যের মিলিত প্রাণের কলরবে সরব হয়ে উঠেছিল মুক্ত স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ একটি ভূখণ্ড পাওয়ার শক্ত স্লোগান।
এখানে সোনালি দিনের একটি উদাহরণ আমাকে দিতেই হবে, ১৯৭০ সালে জহির রায়হান নির্মিত জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রটি ভাষা আন্দোলন এবং আগামীর মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশের দুটো গান দিয়ে তৈরি হয়েছিল। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ এবং ‘আমার সোনার বাংলা’। উনারা জানতেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবে এবং এ দুটো গানই হবে সে দেশের সবচেয়ে বড় পরিচয়। এমনকি এই চলচ্চিত্রে নজরুলের ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি ব্যবহার করা হয়েছে, আগামীতে দেশ স্বাধীন করার যুদ্ধ আসছে তৈরি হও, এমন একটি ভাবনা থেকেই।
গত ৪৭ বছরে শুধুমাত্র অবকাঠামোগত এবং বেতন প্রাপ্তিতে কয়েকটি পদ ছাড়া উপজেলা বা গ্রামে-গঞ্জে এই একাডেমি সংস্কৃতি রক্ষায় বা চর্চায় কোনো কাজ করেনি এবং কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা না থাকায় জেলা, উপজেলা ছেড়ে গ্রাম পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে উগ্র মৌলবাদের বীজ।
তারুণ্যে সাংস্কৃতিক ভাবনার সংকট। এটা কখনই বয়সে তরুণদের সংকট নয়। তারুণ্যের কোনো নির্ধারিত বয়স নেই। স্বাধীন হওয়ার পর এদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন যাদের হাতে পড়েছিল, সেইসব আত্মকেন্দ্রিক মানুষদের তারুণ্যের অবহেলায় আজ আমাদের জন্মগত, উত্তরসূরির সুফসলের প্রাপ্তিগুলো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
এবার স্বাধীন দেশের একটা উদাহরণ দেই। ’৭৪ সালে জাতির পিতা বাংলাদেশের ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে শিল্প সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিল্পকলা একাডেমি তৈরি করেন। উনি জানতেন ’৫২ আর ’৭১ এর অর্জনে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গভীরতা সম্পর্কে। গত ৪৭ বছরে শুধুমাত্র অবকাঠামোগত এবং বেতন প্রাপ্তিতে কয়েকটি পদ ছাড়া উপজেলা বা গ্রামে-গঞ্জে এই একাডেমি সংস্কৃতি রক্ষায় বা চর্চায় কোনো কাজ করেনি এবং কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা না থাকায় জেলা, উপজেলা ছেড়ে গ্রাম পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে উগ্র মৌলবাদের বীজ।
বেড়েছে মাদ্রাসা, মসজিদ আর এতিমখানার মতো ধর্ম ব্যবসা। সমাজে মাদকাসক্ত, ধর্ষণ, কিশোর গ্যাং এর অত্যাচার, জমি দখল, ক্ষমতার অপব্যবহার এখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। আরেকটি জীবন থেকে নেয়া রচনা করার রসদ প্রাপ্তি তরুণেরা হারিয়ে ফেলেছে।
রাষ্ট্র ধর্ম ভিত্তিক খাতে যে পরিমাণ বার্ষিক বাজেট ব্যয় করে, তার একশ ভাগের তিন ভাগও সংস্কৃতি খাতে আসে না। সংবিধানের চারটি মূলনীতি স্মরণ রাখে না কেউ।
এখনকার রাজনৈতিক নেতারা ব্যবসায়ীদের সাথে পথ চলেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কর্পোরেট ব্যবসা খুলে বসেন, ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে নামেন। এরা নিজেদের আখের গোছাতে গিয়ে জনপ্রতিনিধির পদটি অবহেলায় ঝাপসা হয়ে যায়। তৃণমূলে, জনগণের সাথে, রাজপথ-জনপথে কাজ করার সময়টুকু আর কারো থাকে না। তারুণ্যের ঝাঁপি আর পূর্ণ হয় না।
শিক্ষা, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য নিয়ে মাথা ঘামানোর চর্চা থেকে দূরে থাকা ক্ষমতাবান সুশীলেরা সংস্কৃতির জন্য তাই বাড়ায় না বাজেট বা বাড়ানোর তাগিদ থাকে না। গবেষণা বা সংরক্ষণ করার জন্য ইতিহাসবিদদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করে না কেউ। জানতে চান না কখনো এদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধে সংস্কৃতি রক্ষা লড়াইয়ের কথা। মুখস্থ কিছু বাক্য উগড়ে পথ পাড়ি দেন। নিজেরাই ইতিহাস বিকৃত করতে করতে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেন।
উগ্রবাদের সহজ পথে ধনী হওয়ার সহজ অর্থের দম্ভ ভরা কূপে ঘুরপাক খেতে খেতে ভুলেই যান যে বাংলাদেশ নামের ধর্মনিরপেক্ষ ভূখণ্ডটি রক্তস্নাত এক অবিস্মরণীয় মুক্তির উদাহরণ হয়ে গেছে। তাই আজকাল পাড়ায় মহল্লায় লাইব্রেরি নয়, নৃত্য-গীত সংগঠন নয়, ছবি আঁকার স্কুল নয়—মসজিদ আর মাদ্রাসা তৈরি করার বিশাল বাজেট আসে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ আপন শেকড় থেকে মুখ থুবড়ে বহুদূরে অস্তিত্বহীন ছায়ার খোঁজে অস্থির সময় পাড় করে। তারুণ্যে ভরপুর বাংলাদেশ ফিরে আসুক বারবার।
শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা