জেএমবি : সুযোগের অপেক্ষায় থাকা শকুন
জাতীয় নির্বাচন শেষ হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। ২০১৩ সালে রাজধানীর গুলশানে ইতালীয় নাগরিক তাভেলা সিজারকে হত্যা করে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। মূলত এর মধ্য দিয়ে দেশজুড়ে একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা ঘটাতে থাকে জেএমবি।
রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশিও কোনি হত্যাকাণ্ড, কাউনিয়ায় মাজারের খাদেম রহমত আলী, রংপুর সদরে বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা রুহুল আমিন হত্যা চেষ্টা, কুড়িগ্রামে পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর রায়, ঝিনাইদহে মন্দিরে হামলা, জয়পুরহাটে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে বোমা বিস্ফোরণ, ইসকন মন্দিরে হামলা, ৭০/৮০টি হত্যা ও নাশকতার ঘটনা ঘটায় জঙ্গি সংগঠনটি।
এদিকে আবার গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যা দিয়ে শুরু করে একের পর এক দেশজুড়ে ব্লগার ও মুক্তচিন্তার মানুষকেও হত্যা করা। হত্যা করতে থাকে আনসার আল ইসলাম। এই হত্যার মিছিলে ছিলেন ব্লগার ও লেখক ড. অভিজিৎ রায়ও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার বরাতে তখন জানা গিয়েছিল, সারোয়ার জাহান মানিক জেএমবির এই ধারাটির নেতৃত্বে রয়েছেন। এই ধারাটিকে নব্য জেএমবি নামে আখ্যায়িত করে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। আর আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার নেতৃত্বে আছেন—সেনা বাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা আরও বলেছিল, আনসার আল ইসলাম আল কায়েদাকে এবং নব্য জেএমবি আইএসকে অনুসরণের চেষ্টা করছে। যদিও আইএস কিংবা আল কায়েদার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ স্থাপনের কোনো তথ্য মেলেনি। সরকারি তরফেও বারবারই বলা হয়েছে, আইএস কিংবা আল কায়েদার কোনো অস্তিত্ব বাংলাদেশে নেই।
২০১৩ সাল থেকে জঙ্গিদের টার্গেট কিলিংয়ের মাধ্যমে শুরু হওয়া অপতৎপরতার মধ্যেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল আন্দোলনের নামে জ্বালাও পোড়াও। সেই সময় পেট্রোল বোমায় মানুষের আহাজারিতে প্রায় দিনই ভারি হয়ে উঠত চারপাশ। আগুনে পোড়ার দগদগে ক্ষত নিয়ে মানুষ ছুটছেন দিগ্বিদিক—এমন খবর প্রতিদিনই আসতে থাকে গণমাধ্যমে।
রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশিও কোনি হত্যাকাণ্ড, কাউনিয়ায় মাজারের খাদেম রহমত আলী, কুড়িগ্রামে পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর রায়, ঝিনাইদহে মন্দিরে হামলা, জয়পুরহাটে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে বোমা বিস্ফোরণ, ইসকন মন্দিরে হামলা, ৭০/৮০টি হত্যা ও নাশকতার ঘটনা ঘটায় জঙ্গি সংগঠনটি।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে তখন ভরা ছিল আন্দোলনের আগুনে পোড়া মানুষে। প্রতিদিনই হাসপাতালে ভিড় করতেন নতুন রোগী। বিএনপি ও জামায়াত জোট এই আন্দোলনের ডাক দিলেও বাসে আগুন, পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ মারার দায় বরাবরই অস্বীকার করেছে বিএনপি। কিন্তু তাদের ডাকা অবরোধ আন্দোলনের সময় চলা এই ভয়াবহ নাশকতার দায় তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জঙ্গি এবং রাজনৈতিক দুই দিকের সহিংসতার মধ্যেই দেশে হয়ে যায় জাতীয় নির্বাচন-২০১৪ সালের জানুয়ারির পাঁচ তারিখে। এসবের পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র যোগসাজশ থাকার কথা বলছিল অনেকেই।
এই অবস্থার মধ্যেই ২০১৫ সালে জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ মেলায় বাংলাদেশে পাকিস্তান হাই কমিশনের দ্বিতীয় সচিব ফারিনা আরশাদ এবং ২০১৬ সালে ভিসা কর্মকর্তা মাজহার খানকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়। তখন নিজেদের লাগাম কিছুটা টেনে ধরেছিল আইএসআই। এখন আবার করোনা মহামারির কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব, অসত্য তথ্য, কুযুক্তি এবং কুতর্কের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে একটি মহলের মধ্যে। এসবের লড়াইয়ের তৎপরতাও অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করছে, এই সুযোগে দেশে আবারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করার চেষ্টা করছে আইএসআই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আইএসআই এখন কেন নিজেদের অপতৎপরতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে?
শুরুতে যেমনটা বলছিলাম, ’১৪ সালের নির্বাচনের আগে জঙ্গি তৎপরতা বাড়ার পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল বিশ্বের অনেক দেশেই বিতর্কিত পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এখন আরেকটি নির্বাচন সামনে।
চৌদ্দ সালের নির্বাচনের বছর দুয়েক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল তাদের অপতৎরতা- আড়াল থেকে। বন্দুকটি তখন তারা রেখেছিল মূলধারার কিছু রাজনৈতিক দল এবং নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের কাঁধে। এখন আবার আরেকটি নির্বাচনের বছর দুয়েক বাকি। সুতরাং তাদের ষড়যন্ত্রের ডালা আবারও খোলার চেষ্টা করছে। পাল্টা প্রশ্ন আসতে চৌদ্দর পর মাঝখানের আঠারোর নির্বাচনের সময় তারা সরব হয়নি কেন? এক্ষেত্রে উত্তরটা হলো, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার পর দেশজুড়ে জঙ্গি বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। শীর্ষস্থানীয় বেশিরভাগ জঙ্গি মারা যায় অভিযানে, গ্রেফতার হয় অনেকেই। ফলে তাদের ঘাড়ে বন্দুক রাখা কঠিন হলেও একটি জায়গায় তারা সফল হয় বলেই মনে হয়।
২০১৫ সালে জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ মেলায় বাংলাদেশে পাকিস্তান হাই কমিশনের দ্বিতীয় সচিব ফারিনা আরশাদ এবং ২০১৬ সালে ভিসা কর্মকর্তা মাজহার খানকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট পুরনো। চারদলীয় জোট করে ২০০১ সালের নির্বাচনে তখন জামায়াতকে নিজেদের নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ দেয়নি বিএনপি। কিন্তু আঠারোর নির্বাচনে ঠিকই নিজেদের প্রতীক তাদের দিয়েছে দলটি। অথচ নতুন প্রজন্মের মাঝে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দায়ী সংগঠনটির প্রতি বিপুল ঘৃণা। নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল বলে দাবি করা বিএনপি এত বড় ঝুঁকি কেন নিল? কারণ এর পেছনে থাকতে পারে কারো পরামর্শ। কাউকে কি সন্তুষ্ট করার বাসনা?
অনেক দিন ধরেই সাংগঠনিকভাবে ঝিমিয়ে থাকা বিএনপি সম্প্রতি সিরিজ বৈঠক করল দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে। মহাসচিব বলছেন, পর্যায়ক্রমে সমমনা ডান- বাম দল এবং পেশাজীবীদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন তারা। আর এসব বৈঠকের নির্দেশ আসছে লন্ডন থেকে।
একটি গল্প বলি—অনেক দিন আগে জঙ্গিবাদ বিষয়ক এক গবেষকের মুখে শোনা। তিনি বলছেন, যখন আপনি কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবেন। দেখা কিন্তু প্রেমিকার বাসায় গিয়ে করবেন না। করবেন প্রতিবেশী কিংবা বন্ধুর বাসায়। বিএনপি কখনো পাকিস্তান যায় না। কিছুদিন পরপর সৌদি আরব যায়। কারণ প্রেমিক বলেন আর প্রেমিকা বলেন সেটি কিন্তু সৌদি আরব না। সৌদি আরব হচ্ছে, বন্ধু কিংবা প্রতিবেশীর বাড়ি। এই ছিল তার গল্প।
শেষ করি একটি প্রসঙ্গ দিয়ে। ২০০০ সালের কথা। বাংলাদেশে নিযুক্ত তখন পাকিস্তানি উপ-হাই কমিশনার ইরফান রাজা। ঢাকায় বসে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্হিত মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ইরফান রাজা একাত্তরের গণহত্যার জন্য তার দেশের সেনাবাহিনী নয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওপর দায় চাপান। একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়ার বিরোধিতা করে ইরফান সে সময় বলেছিলেন, দেশের অর্ধেকটা হারানোর জন্য আমাদের কি ক্ষমা চাওয়া উচিত?
মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিষ্টাচার বহির্ভূত এই মন্তব্যের জন্য ইরফান রাজাকে বাংলাদেশ অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে বাংলাদেশ তাকে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিলে ২০০০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকা ছাড়েন। পাঠক খেয়াল করে দেখুন, ২০০০ সালও কিন্তু নির্বাচনের আগের বছর!
আর আইএসআইয়ের এসব অপতৎপরতা কিন্তু নতুন কিছু নয়। বেলুচিস্তানেও তারা এমন করেছে, এখনো করছে। বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আফগানিস্তানেও বরাবরই নাক গলিয়েছে আইএসআই। এখনো গলাচ্ছে। সুতরাং পুরনো বাংলাদেশকে তারা শান্তিতে থাকতে দেবে কেন? বাংলাদেশের ক্রম অগ্রগতি জ্বালা ধরায় তাদের গায়ে। ফলে নিজেদের অপতৎরতা জারি রাখার অপচেষ্টা অব্যাহত রাখে তারা। সুতরাং সাবধান হওয়ার এখনই সময়।
খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী