নকল ও ভেজাল ওষুধের প্রভাব ও প্রতিকার
করোনা মহামারির প্রকোপ এবং ডেঙ্গুর চোখ রাঙানির মধ্যেই অতি সম্প্রতি খবরের শিরোনাম হয়েছে ‘নকল ও ভেজাল ওষুধ’। স্বনামধন্য ও প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং জীবন রক্ষাকারী কিছু ‘নকল ওষুধ’ জব্দ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে। নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও এর বিপণনের এমন খবর মাঝে মাঝেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
গণমাধ্যমে এ নিয়ে কয়েকদিন বেশ আলোচনা হয়, লেখালেখি হয়, তারপর সবাই ভুলে যায়। কিন্তু জীবন রক্ষকারী ওষুধের নকল কিংবা ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও সরবরাহ কিন্তু থেমে থাকে না। এহেন ঘৃণ্য ও বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত অপরাধীরা প্রশাসনের চোখে ধুলা দিয়ে দিনের পর দিন চালিয়ে যায় তাদের বিধ্বংসী অপতৎপরতা।
প্রশাসন ও লোকচক্ষুর অন্তরালে এই চক্র কীভাবে এমন হীন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে সে প্রশ্ন বারবারই ঘুরে ফিরে আসে। একজন ফার্মাসিস্ট হিসেবে যা আমাকে খুব পীড়া দেয়। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাহিদার ৯৮ ভাগ ওষুধ যেমন আমরা দেশে উৎপাদন করতে পারি, তেমনি বিশ্বের প্রায় ১৪৫টি দেশে আমাদের ওষুধ রপ্তানি হয়। ওষুধ রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৪তম।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুরসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই আমাদের ওষুধ ব্যবহৃত হয় যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। বড় আকারে দেশে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে যা বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি করেছে আরও উজ্জ্বল। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, পঁচিশ হাজার কোটি টাকার বর্তমান বাজার ২০২৫ সালে পঞ্চাশ হাজার কোটিতে উন্নীত হতে পারে।
সার্বিকভাবে ওষুধের সহজলভ্যতা ও গুণগত মান নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি। কিন্তু সেই গর্ব আর সুনাম নিমিষেই ম্লান হয়ে যায় নকল ও নিম্নমানের কিছু ওষুধ প্রস্তুতকারীর ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের জন্য। একজন ফার্মাসিস্ট হিসেবে তখন প্রচণ্ড ব্যথিত হই আমি।
দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সঠিক ধারায় মামলা না হওয়া, মামলা পরিচালনায় যথেষ্ট আন্তরিক না থাকা এবং বিচারালয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অপরাধীরা অনেক ক্ষেত্রে পার পেয়ে যায়, থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
গুণগত, মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন ও সরবরাহ এবং পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ওষুধ সংক্রান্ত সকল কর্মকাণ্ড তদারকির দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনকারীদের শাস্তির আওতায় আনার জন্য মামলা দায়ের ও পরিচালনা করার দায়িত্বও সরকারের এই প্রতিষ্ঠানের।
দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সঠিক ধারায় মামলা না হওয়া, মামলা পরিচালনায় যথেষ্ট আন্তরিক না থাকা এবং বিচারালয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অপরাধীরা অনেক ক্ষেত্রে পার পেয়ে যায়, থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ফলে নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রয় কোনোদিনও বন্ধ হয় না। নকল ও ভেজাল ওষুধ বন্ধে প্রয়োজন সুষ্ঠু ও যুগোপযোগী কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ ও এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
নকল ও নিম্নমানের ওষুধের কারণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই প্রভাব মারাত্মক আকার ধারণ করে। আশির দশকের শেষের দিকে ঘটিত প্যারাসিটামল ট্র্যাজেডির কথা আমাদের মনে থাকার কথা। ভেজাল ও নিম্নমানের প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে প্রায় ২৭০০ জন শিশুর কিডনি ও লিভার বিকল হয়ে মৃত্যু ঘটেছিল।
যে সলভেন্ট বা দ্রাবক ব্যবহার করে এই সিরাপ তৈরি করা হয়েছিল তা কিডনি ও লিভার অকেজো করে ফেলে, যা শিশু মৃত্যুর কারণ। খুবই স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায় বিধায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল নামের এই বিষাক্ত দ্রাবকটি ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করে এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে।
১৯৯২ সালে ওষুধ প্রশাসনের দায়ের করা মামলায় ২০১৪ সালে অর্থাৎ প্রায় ২১ বছর পরে এই মামলার রায়ে দোষীদের কয়েকজনকে শাস্তি প্রদান করা হয়। নকল ও নিম্নমানের ওষুধের প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি হতে পারে যা অনেক সময়ই বোঝা যায় না যে, সেটি ঐ ওষুধের ক্ষতিকর প্রভাব। নকল ও ভেজাল ওষুধ সেবন করলে রোগ থেকে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা থাকে না, ফলে সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত এবং ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের বিক্রয় বন্ধ করতে সরকার ২০১৬ সালে সারা দেশে ‘মডেল ফার্মেসি’ ও ‘মডেল মেডিসিন শপ’ চালুর কার্যক্রম গ্রহণ করে।
এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে নকল ওষুধের দৌরাত্ম্য ঠেকানো যাবে? এ বিষয়েও ইতিপূর্বে বিস্তর আলোচনা হয়েছে গণমাধ্যমে। নকল ওষুধ তৈরি ও সরবরাহ বন্ধ করতে হলে তিনটি ধাপে কাজ করতে হবে। প্রথমত, কোনো লাইসেন্স প্রাপ্ত অথবা লাইসেন্স বিহীন কোম্পানি যাতে নকল ওষুধ তৈরি করতে না পারে সেই ব্যাপারে তৎপরতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনের ব্যাপক তৎপরতা ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো গেলে সুফল পাওয়া যাবে।
দ্বিতীয়ত, প্রস্তুতকৃত নকল ও ভেজাল ওষুধ যেন বাজারে সরবরাহ না হয় সে লক্ষ্যে দেশের বাজারগুলো ব্যাপক নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরেই ওষুধের পাইকারি বাজার থাকে। মূলত এই পাইকারি বাজারগুলো থেকেই সারা দেশে এসমস্ত নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহ করা হয়। সেজন্যই বিভাগীয় পর্যায়ের পাইকারি ওষুধের বাজারে নিয়মিত তল্লাশি চালানো দরকার।
গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত এবং ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের বিক্রয় বন্ধ করতে সরকার ২০১৬ সালে সার দেশে ‘মডেল ফার্মেসি’ ও ‘মডেল মেডিসিন শপ’ চালুর কার্যক্রম গ্রহণ করে। যেখানে প্রতিটি মডেল ফার্মেসিতে ওষুধ ডিস্পেনসিং এর জন্য গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু সুষ্ঠু তদারকির অভাবে এই নির্দেশ মানা হচ্ছে না বেশিরভাগ মডেল ফার্মেসিতে।
এসব ফার্মেসিতে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে নিম্নমানের ওষুধ বিক্রয় অনেকাংশে কমে যাবে। কারণ রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্টরা একটি সুষ্ঠু নীতিমালা মেনে ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়ে দায়বদ্ধ। তারা কোনো অপরাধ করলে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা যায়। প্রয়োজনে তাদের নিবন্ধন বাতিল করে দেওয়া যায়। রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট ছাড়া অন্য কাউকে এই জবাবদিহিতায় আনা যায় না।
তৃতীয়ত, নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রয়ের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ অনুসারে ভেজাল ও নকল ওষুধ তৈরির শাস্তি ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা দুই লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। আর নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রয়ের শাস্তি ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। এই আইনের অধীনে সঠিকভাবে মামলা দায়ের করতে পারলে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা যাবে। আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে এ সমস্ত কর্মকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব।
পরিশেষে আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই, সাধারণ মানুষের পক্ষে ভেজাল, নকল বা নিম্নমানের ওষুধ চেনা খুবই দুরূহ। ওষুধের দোকানে কর্মরত কর্মচারীরা যেটি সহজেই শনাক্ত করতে পারেন। সে কারণে সকলের উচিত যথাসম্ভব নিকটস্থ ‘মডেল ফার্মেসি’ অথবা ‘মডেল মেডিসিন শপ’ থেকে ওষুধ ক্রয় করা। কারণ এই দুই ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের বিশেষ তদারকির অন্তর্ভুক্ত। সাধারণ জনগণের পক্ষে কোনো ক্রমেই ভেজাল ও নকল ওষুধ শনাক্ত ও প্রতিরোধ করা সম্ভবপর নয়। এটি করতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের।
অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ।। চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়