শিশুদের অনলাইন থেকে অফলাইনে ফেরা
প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর আবার খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই দীর্ঘ বিরতির মাঝে স্কুল-কলেজগামী শিশু-কিশোররা তাদের চিরচেনা পরিবেশ থেকে যেমনটা দূরে থেকেছে, তেমনি আবার অনেকেই অভ্যস্ত হয়েছে অনলাইন ক্লাসে।
এমতাবস্থায়, আবার যখন ক্লাসরুমে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে, তখন সেটি স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে, শিক্ষার্থীরা এক ধরনের অনিশ্চয়তা এবং বেশ কিছু নির্দেশিকা পালনের তাগাদার ভেতর দিয়ে যাবে, যেটি তারা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগে কখনো দেখেনি।
পরিবর্তনের এই সময়টাতে করোনার জন্য প্রদত্ত স্বাস্থ্য নির্দেশিকা ছাড়াও, অনলাইন থেকে অফলাইনে যাওয়ার এই ক্রান্তিকালে বেশ কিছু জিনিস খেয়াল রাখা জরুরি। যেমন তাদের ঘুমের অভ্যাস স্কুলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যদি পরিবর্তন আনার দরকার হয় সেটি আগে থেকেই শুরু করে দিতে হবে। তাদের দৈনন্দিন রুটিনে যে পরিবর্তন আসবে সেটি শিক্ষার্থীদের সাথে আগে থেকেই আলোচনা করে বুঝিয়ে বলতে পারে অভিভাবকরা।
শিশু-কিশোরদের ব্যাপারে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে, তারা ছোট, অতএব তাদের সাথে আলোচনার প্রয়োজন নেই। যত বয়সই হোক না কেন, তাদেরকে সিদ্ধান্তগুলো ব্যাখ্যা করা উচিত। তারা যেন বুঝতে পারে, যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের মতামতকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় আনা দরকার।
শিশু যদি প্রথমবারের মতো স্কুলে যায়, এমনকি যদি স্কুল শুরুই হয়ে থাকে অনলাইনের মাধ্যমে, তাহলে শিশুকে স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সুন্দর করে বুঝিয়ে দেওয়া অভিভাবকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
শিশুদেরকে স্বাধীনভাবে বাসার ছোটখাটো কিছু কাজ করতে দেওয়ার অভ্যাস করানো যেতে পারে। কারণ, এমনও অনেকে শিশু আছে, যাদের হয়তো স্কুল জীবনটা শুরুই হয়েছে অনলাইন ক্লাসের মধ্য দিয়ে। এখন, সশরীরে স্কুলে যাওয়ার পর সেখানে যে তাদের পরিবারের পরিচিত মুখগুলো থাকবে না, কিছু জিনিস যে শিশুকে নিজেকেই করতে হবে, আগে থেকে বাসার কাজের মধ্য দিয়ে তাকে সেরকম একটু অভিজ্ঞতা দিয়ে দিতে পারলে, স্কুলের পরিবেশে মানিয়ে নিতে সুবিধা হবে।
অনেকগুলো বিষয় আছে, যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও, সেগুলো যথেষ্ট মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। এমনকি, সেগুলোর প্রভাব শুধু মানসিক নয়, বরং শারীরিকও। যেমন, সঠিক ব্যাকপ্যাক সাইজ, যে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে শিশু চলাফেরা করবে, সেটির আকার আরামদায়ক হওয়া, যে জুতা পরে হাঁটা-চলা করবে, সেটির আকার সঠিক হওয়া খুবই জরুরি।
পানীয় বা খাবারের ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেওয়া নির্দেশিকা মানতে গিয়ে শিশুদের যদি সমস্যা হয়, সেক্ষেত্রে শিশুর কী করতে হবে, সেটি তার সাথে কথা বলে, আগে থেকেই বুঝিয়ে দিতে হবে।
বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীদের জন্য স্ক্রিন টাইম অর্থাৎ কত সময়ের জন্য বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিনে সময় কাটাতে পারবে সেটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনার বিষয়। বিভিন্ন বয়সীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত স্ক্রিন টাইমও বিভিন্ন হয়ে থাকে। অনলাইন ক্লাসের কারণে এই স্ক্রিন টাইম বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
এখন অফলাইন বা সশরীরে ক্লাস শুরু হলে, অথবা অনলাইন-অফলাইন দুই পদ্ধতিতেই চলতে থাকলে, সে হিসেবে শিক্ষার্থীদের স্ক্রিন টাইম সমন্বয় করতে হবে। এই সমন্বয়ের কাজটি হঠাৎ করে না করে, ধীরে ধীরে করাটাই যৌক্তিক। এক্ষেত্রে, পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা, প্রয়োজনে অভিভাবকদের নিজেদের স্ক্রিন টাইম কমিয়ে আনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অভ্যস্ত করতে হবে।
স্কুলে যেতে পারা যে আনন্দের বিষয়, তা যে উৎসবের উপলক্ষ হতে পারে, তা বোঝানোর মাধ্যমে পরিবার বা অভিভাবকদের পক্ষ থেকে নেওয়া কিছু উদ্যোগ, শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে।
শিশু যদি প্রথমবারের মতো স্কুলে যায়, এমনকি যদি স্কুল শুরুই হয়ে থাকে অনলাইনের মাধ্যমে, তাহলে শিশুকে স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সুন্দর করে বুঝিয়ে দেওয়া অভিভাবকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। যেমন রাস্তা পারাপারের নিয়মকানুন, অপরিচিত লোকজনের দেওয়া খাবার বা কথোপকথনে সতর্কতা এবং সেরকম কিছু হলে পরবর্তীতে অভিভাবকদের জানানো, শিক্ষকের কথা অনুসরণ করা, অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে তার শ্রেণিশিক্ষকই যে তার অভিভাবক, এ সমস্ত জিনিসগুলো জানা থাকলে, জরুরি পরিস্থিতিতে শিশু সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে আতঙ্কিত হয়ে পড়বে না।
সবকিছুর পরও যদি এই শিশুর আতঙ্ক, উদ্বেগ থাকে বা অন্য যেকোনো কারণে যদি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলা যেতে পারে।
সর্বোপরি, স্কুলে যেতে পারা যে আনন্দের বিষয়, তা যে উৎসবের উপলক্ষ হতে পারে, তা বোঝানোর মাধ্যমে পরিবার বা অভিভাবকদের পক্ষ থেকে নেওয়া কিছু উদ্যোগ, শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে।
অনলাইন এবং অফলাইন, দুটো মাধ্যমেরই সুবিধা-অসুবিধা আছে। করোনার এই মহামারিতে কিছু ভোগান্তি মেনে নিয়ে হলেও, আমাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা যে অনলাইনের শিক্ষার সাথে পরিচিত হতে পেরেছে, অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরেছে, এটি ভবিষ্যতে সবারই কাজে আসবে, সুবিধা হবে শিক্ষা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিলে শিশুদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে আরও সুন্দর হবে।
ড. বি এম মইনুল হোসেন ।। সহযোগী অধ্যাপক, তথ্য প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।