শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
আমাদের ছোট ছেলের বয়স এখন ৪ বছর ১০ মাস। বাংলাদেশের শিশুদের অনেকেই এ বয়সে স্কুলে যাতায়াত শুরু করে। কিন্তু আমাদের সন্তানের এখনো স্কুলের সাথে পরিচয়ই ঘটল না। ইচ্ছে ছিল, ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে সে স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করবে।
নার্সারি, জুনিয়র প্লে, সিনিয়র প্লে- কত ক্লাস। এসব ক্লাসের উদ্দেশ্য শুধু লেখাপড়া নয়, বরং বন্ধু তৈরি করা, বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করা, পরিবারের বাইরের গণ্ডির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চর্চা করা- এক কথায় তার সামাজিকীকরণ এবং এসবের মধ্য দিয়ে শিক্ষায়তনিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা। কিন্তু বিধি বাম! শুধু আমাদের সন্তান নয়, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের এমন প্রায় ৪০ লাখ শিশু এখন সশরীরে শিক্ষা গ্রহণের অপেক্ষায় রয়েছে।
এর কারণটা কিন্তু আমি বা আপনি নয়। কারণটা কোভিড-১৯, আমরা যাকে করোনাভাইরাস নামে চিনি। ২০২০ সালের শুরুর দিকে বিভীষিকার মতো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল এই মহামারি।
বিশ্বের সকল দেশকেই পর্যুদস্ত করে ফেলল। জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ল। বন্ধ রাখা হলো অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার-ঘাট, দোকানপাট সবকিছু। শুরু হলো বেঁচে থাকার লড়াই। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের ছোবল লাগল বাংলাদেশেও। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রাখতে হলো দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার সিদ্ধান্ত এখনো না নেওয়া হলেও সরকার ১২ সেপ্টেম্বর থেকে স্কুল-কলেজ খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু স্কুল-কলেজ খুললেও এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে সংক্রমণের হার ৯ শতাংশের উপরে। এ কারণে করোনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চ্যালেঞ্জ নিয়েই দেশের স্কুল-কলেজগুলো খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে স্কুল-কলেজ খুললেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ কিন্তু রয়েই গেছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিষ্কার-পরিছন্নতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিক্ষার্থীদের টিকার (অন্তত এক ডোজ) আওতায় আনা, শিক্ষণ-ঘাটতি দূর করা, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের, বিশেষত মেয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সেশনজট মোকাবিলাসহ তৃতীয় ঢেউ সামলানোর পরিকল্পনা করা।
একজন শিশু প্রথম শ্রেণি থেকে ধাপে ধাপে উচ্চশিক্ষার স্তরে পা রাখে। প্রতিটি স্তরে পাঠ্যক্রম অনুযায়ী তাকে এগিয়ে যেতে হয় এবং পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে হয়। প্রথম শ্রেণিতে যে জ্ঞান সে অর্জন করে, পরবর্তী শ্রেণিতে সেই জ্ঞানকে কাজে লাগায়।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই কোটি পঁচাত্তর লাখের মতো এবং মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি। ইউনিসেফের সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, স্কুলগুলো বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশে প্রায় চার কোটি ২০ লাখ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
করোনা মহামারি চলাকালীন সরকার অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরা অনলাইন শিক্ষণ তথা টেলিভিশনে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম কতটা আত্মস্থ করতে পেরেছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েই গেছে।
ইউনিসেফ-আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ)-এর এক রিপোর্টে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে স্কুলগামী শিশুদের ৬৩ শতাংশের বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ নেই। আবার স্যাটেলাইটের কল্যাণে ৮০ শতাংশ পরিবারে টেলিভিশন সেট থাকলেও ২০ শতাংশ পরিবারে কোনো টেলিভিশন সেটও নেই।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের জরিপ বলছে, দেশের ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই টেলিভিশন ক্লাসের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এসব পরিসংখ্যানই বলে দেয়, আপৎকালীন অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম ও দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে অনেক শিশুই অংশগ্রহণ করতে পারেনি।
আর একটি বিষয় না বললেই নয়। সেটি হলো, শিক্ষা একটা পরম্পরার ব্যাপার। একজন শিশু প্রথম শ্রেণি থেকে ধাপে ধাপে উচ্চশিক্ষার স্তরে পা রাখে। প্রতিটি স্তরে পাঠ্যক্রম অনুযায়ী তাকে এগিয়ে যেতে হয় এবং পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে হয়। প্রথম শ্রেণিতে যে জ্ঞান সে অর্জন করে, পরবর্তী শ্রেণিতে সেই জ্ঞানকে কাজে লাগায়। আর এভাবেই চলতে থাকে তার শিক্ষাজীবন। এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট স্তরে/শ্রেণিতে বিচ্যুতি কিন্তু তার সমস্ত শিক্ষাজীবনে প্রভাব ফেলে, তৈরি করে জ্ঞানগত ঘাটতি।
আবার শ্রেণীকক্ষের তুলনায় অনলাইন শিক্ষায় প্রয়োজনীয় একাডেমিক দিক-নির্দেশনা, মূল্যায়ন এবং মতামত আদান-প্রদানের অভাব এবং প্রযুক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতায় দ্রুত সামাজিক দক্ষতা ও প্রতিভা হারানোর বিষয়টি অপকটে অনেক শিক্ষার্থী স্বীকারও করেছে।
আমার কাছে আর একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্কুল থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করা বা ঝরে পড়া শিশুদের আবারও স্কুলে ফিরিয়ে আনা। কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান এইড-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, মহামারির কারণে গরিব দেশগুলোতে বহুসংখ্যক শিশু, বিশেষত মেয়েরা, করোনা পরবর্তীতে আর স্কুলে ফিরে আসবে না।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, করোনাকালীন শুধুমাত্র নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাবে আগামী বছরে শিক্ষা থেকে প্রায় দুই কোটি ৩৮ লাখের বেশি শিশু ও তরুণ শিক্ষা থেকে ঝরে পড়তে পারে। মহামারি শেষে স্কুল খোলার পর বাংলাদেশে কী পরিমাণ শিশু লেখাপড়ার বাইরে চলে যাবে, সেই পরিসংখ্যান না থাকলেও এ সংখ্যা ৪০ শতাংশ হতে পারে বলে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। আসলে করোনাকালীন বাবা-মায়ের আয়ের পথ বন্ধ হওয়ায় ঢাকাসহ অন্যান্য শহর ছেড়েছে বহু শিশু, আবার কাউকে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে, কেউ কাজ শুরু করেছে কল-কারখানায়, কেউবা আবার গাড়িতে। এভাবে শিশু-শ্রমিকের সংখ্যাও বেড়ে গেছে।
গ্রামের স্কুলগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। শহরের কিছু কিছু স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হলেও গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানা খুবই কঠিন।
মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ঝরে পড়ার হার আরও বেশি হতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। করোনার কারণে ১৮ বছরের কম বয়সী পাঁচ লাখের বেশি মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে সেভ দ্য চিলড্রেনের ‘গ্লোবাল গার্ল হুড’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহের শিকার হতে পারে আরও অতিরিক্ত ২৫ লাখ মেয়ে, যা নারী শিক্ষায় ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এছাড়াও গ্রামের স্কুলগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। শহরের কিছু কিছু স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হলেও গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানা খুবই কঠিন। বাংলাদেশের অধিকাংশ স্কুলের অবকাঠামো এবং এক কক্ষে বসে ক্লাস করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস করানো প্রায় দুঃসাধ্য বিষয়। যদিও সরকার এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা করেছে যাতে করে প্রতিটি ক্লাসের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন স্কুলে আসতে না হয়। আবার স্কুলে থাকার সময় অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে, মাস্ক পরা কিংবা সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি যেখানে গ্রামের সাধারণ মানুষই ঠিকমতো মানছেন না, সেক্ষেত্রে শিশুরা এগুলো কতটা মানবে সেটা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
অন্যদিকে, সকল স্কুলগামী শিশুকে টিকার আওতায় আনাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ১২ বছরের বেশি বয়সীদের অবিলম্বে টিকার আওতার আনার ঘোষণা দিলেও এখনো পর্যন্ত ১০-১৫ শতাংশ শিক্ষক-কর্মচারী এবং ১৮ বছর বয়সী বেশিরভাগ শিক্ষার্থী টিকা পায়নি।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার নিম্নগামী এবং এ ধারা বেশ কিছুদিন ধরে অব্যাহত আছে। অন্যদিকে করোনায় মৃত্যুর হারও বেশ কমেছে। কিন্তু করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ে ইতিমধ্যে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। স্কুল-কলেজ খোলার পর যদি কোনো শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হয়, সেক্ষেত্রে স্কুল-কলেজগুলোর যথেষ্ট প্রস্তুতি রাখা প্রয়োজন। আবার করোনার তৃতীয় ঢেউ আসলে তা কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, সেক্ষেত্রে থাকা দরকার আপৎকালীন পরিকল্পনা।
প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষার্থীরা বাড়িতে বসে আছে। এতে করে তাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই আবার মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিকল্পও বর্তমানে আছে বলে মনে হয় না। তবে, আশু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা।
ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলগামী করা, ঝরে পড়া মেয়েদের স্কুলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা পদ্ধতি ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা, স্কুল গেটে তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা রাখা, স্কুলের কোনো শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হলে করণীয় সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রাখা এবং স্কুলের পরিষ্কার-পরিছন্নতা নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে শুধু শিক্ষকদের দায়িত্ব দিলেই চলবে না। অভিভাবক, মাঠ-প্রশাসন, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি সবাইকে নিয়ে একযোগে কাজ করার বিকল্প নেই। প্রয়োজনে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দেরও প্রয়োজন হতে পারে।
ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়