বাল্যবিবাহ উপসর্গ মাত্র, মূল ব্যাধি পিতৃতন্ত্র
বাল্যবিবাহ যে একটা মন্দ বিষয় সেটা নিয়ে তো আর কোনো বিতর্ক নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানেই বলা হয় যে, অপরিণত বয়সে বিয়ের ফলে শিশুর শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, মানসিক বিপর্যয় ঘটে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হয়। এইজন্য দেশে বাল্যবিবাহ নিরোধের উদ্দেশ্যে আইন হয়েছে, সরকার থেকে এবং অনেক বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে প্রচারণা হয়। তথাপি এইসব বৈজ্ঞানিক তথ্য, আইন বা প্রচারণা এইসব কোনোকিছুই বাল্যবিবাহ যেন কোনোভাবেই কমাতে পারছে না। এখন দেখা যাচ্ছে যে, করোনা মহামারি যখন থেকে শুরু হয়েছে তখন থেকে আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের সংখ্যা শঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এইবার বিশ্ব নারী দিবসে ইউনিসেফ থেকে তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে যে, করোনা মহামারি শুরুর আগেও বাংলাদেশের এক কোটি কন্যা শিশু বাল্যবিবাহের ঝুঁকির মধ্যে ছিল। আর সতর্কবার্তা দিয়ে ইউনিসেফ জানাচ্ছে যে, মহামারি শুরু হয়ে যাওয়ার পর ক্রমাগত স্কুল বন্ধ থাকা, অর্থনৈতিক চাপ, পিতামাতার কাজ হারানো বা করোনায় পিতামাতার মৃত্যু বা মৃত্যুর আশঙ্কা এইসব কারণে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। এই সংক্রান্ত নানা তথ্য খবর ইত্যাদি আমরা প্রতিদিনই দেখতে পাই গণমাধ্যমে। আলোচনাও হয় এইসব নিয়ে। কিন্তু বাল্যবিবাহ বন্ধ হচ্ছে না কেন?
বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বিবাহের পাত্র বা ছেলেটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাপ্তবয়স্ক থাকে, কিন্তু পাত্রী বা মেয়েটি থাকে আঠারো বয়সের চেয়ে কম বয়সী। কেন এইরকম হয়? কেন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরকে পিতামাতা এবং সমাজ সবাই মিলে আইন ফাঁকি দিয়ে কোনো কোনো সময় পুলিশ বা প্রশাসনের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়?
করোনা মহামারি যখন থেকে শুরু হয়েছে তখন থেকে আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের সংখ্যা শঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এত প্রচারণা, এত আলোচনা এতকিছুর পরও কেন কন্যা শিশুদেরকে অপরিণত বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়ার প্রবণতা কমছে না? কমছে না তার কারণ পিতৃতন্ত্র বা পেট্রিয়ার্কি (Patriarchy)।
পিতৃতন্ত্রে নারীকে পুরুষের সমান মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, নারীর মর্যাদা হচ্ছে পুরুষের অধীন বা পুরুষের মালিকানার বস্তু হিসেবে।
একজন কৃষকের পরিবারে মেয়েটির মর্যাদা হালের গরুটি বা পোষা ছাগলটির চেয়ে হয়তো বেশি, কিন্তু পুত্রের সমান মোটেই নয়। কন্যা সন্তান হচ্ছে পিতামাতার কাছে রক্ষিত অপরের আমানত। পিতামাতার দায়িত্ব হচ্ছে এই মেয়েটিকে দেখেশুনে রাখা, লালন পালন করা আর তারপর তাকে বিয়ে দিয়ে মেয়েটির প্রকৃত মালিকের হাতে তুলে দেওয়া।
এই যে শতাব্দী প্রাচীন বিধান, এইটার কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। আর এই দৃষ্টিভঙ্গির যেসব প্রায়োগিক দিক যেমন সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার, কর্মক্ষেত্র, ঘরের বাইরে ও ঘরে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়—সেইসব ক্ষেত্রে তো মোটেই কোনো পরিবর্তন আসেনি।
সেই সাথে যুক্ত হয়েছে ধর্ম। মোটামুটিভাবে প্রতিটা ধর্মই তো নারীর প্রতি বৈষম্যের বিধান করে রেখেছে। নারীকে তুচ্ছ করার এই ধার্মিক দৃষ্টিভঙ্গি তো কেবল গ্রন্থেই লেখা থাকে না। ধর্মগুরুরা সেগুলো প্রতিনিয়ত প্রচার করে এবং মানুষকে ভয় দেখায় যেন এইসব বিধানের ব্যত্যয় ঘটানো না হয়।
প্রতিদিন ধর্মগুরুরা মানুষকে নারী বিদ্বেষী প্রবচন দিতে থাকে। একদিকে আমরা বাল্যবিবাহ বিরোধী আইন করেছি আর অপরদিকে ওলামা লীগ নামক একটি সংগঠনসহ একদল লোক ঢাকার কেন্দ্রে ঠিক শিশু একাডেমি থেকে কয়েক গজ দূরে প্রেসক্লাবের কোনায় মানববন্ধন করেছে। কী তাদের দাবি? কম বয়সী মেয়েদেরকে বিবাহ করা নাকি ওদের অধিকার! বাল্যবিবাহ বিরোধী আইন ওরা মানবে না।
কেবল মাত্র আইন করে কি বাল্যবিবাহ বন্ধ করা যাবে? সমাজে সর্বত্র পিতৃতন্ত্র বিরাজ করছে, ধর্মগুলো নারীকে নিতান্ত পুরুষের ভোগের পণ্য বলে প্রচার করতে থাকবে। গ্রামের ও শহরের মানুষ চেতনায় ধারণ করবে যে, কন্যা শিশুটি ওর কাঁধে একটি বোঝা, ওকে একজন পুরুষের হাতে তুলে না দেওয়া পর্যন্ত এই বোঝা থেকে মুক্তি নেই।
কেবল মাত্র আইন করে কি বাল্যবিবাহ বন্ধ করা যাবে? সমাজে সর্বত্র পিতৃতন্ত্র বিরাজ করছে, গ্রামের ও শহরের মানুষ চেতনায় ধারণ করবে যে, কন্যা শিশুটি ওর কাঁধে একটি বোঝা...
পিতামাতারা মনে করবে যে, মেয়েটিকে যদি কেউ ছুঁয়ে দেয় বা মেয়েটি যদি একটা প্রেম করে তাহলে সে অশুদ্ধ হয়ে যাবে, যেন পোকায় কাটা বা বাদুরে চুষে দেওয়া আমটি। এইসব পিতামাতাকে আপনি কেবল আইন করে কতদিন বাল্যবিবাহ থেকে নিরুৎসাহিত করবেন? কয়জনকে বিরত রাখতে পারবেন?
ঐখানে যদি আমরা আদর্শগত প্রতিরোধ গড়তে না পারি, যদি স্পষ্ট করে বলতে না পারি যে, নারী ও পুরুষ সমান এবং নারীর প্রতি বৈষম্য করা অন্যায়- সেই বৈষম্য যেখানেই থাকুক না কেন বা যে গ্রন্থেই থাকুক না কেন বা যে প্রথা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্বাসেই থাকুক না কেন- তাইলে তো কন্যা শিশুটিকে ঐভাবেই দেখা হবে।
আমরা যতই আইন করি না কেন তাতে খুব বেশি লাভ হবে না। নারীর প্রতি অন্য সব বৈষম্যের মতো, বাল্যবিবাহ সেটাও পিতৃতন্ত্রেরই একটি প্রকাশ মাত্র। সেইখানে যদি আঘাত করতে না পারি, তাহলে পিতামাতারা শিশু কন্যাদের বিয়ে দিতেই থাকবে। আর যখন মহামারি শুরু হয়ে যায় বা এইরকম অন্য যেকোনো প্রকার বিপর্যয় আসে- তখন ঐসব পিতামাতা কী করবে সেটা কি আরও ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হবে?
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট