কিন্ডারগার্টেন : শিক্ষক, কর্মচারীর খোঁজ কে রাখছে?
প্রথম ক্ষুদ্র বার্তাটা এসেছিল টঙ্গী থেকে। ‘আমি একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াতাম। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে স্কুল বন্ধ। বেতনও বন্ধ হয়ে গেছে। আমাকে কিছু সাহায্য করুন। মেয়েটা অসুস্থ। স্বামীও কাজ হারিয়ে বসে আছেন। দয়া করে দুই হাজার টাকা হলেও দিন’।
রাজশাহী থেকে একজন লিখেছিলেন—‘বাবা একটা কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করতেন। এখন স্কুল বন্ধ। কোভিডের জন্য টিফিনও বন্ধ। কিছু টাকা দেন, বাবাকে বাজারের জন্য টাকা পাঠাবো’।
আমার মহল্লার আশপাশে তিনটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে। ঐ স্কুলগুলোতে যারা শিক্ষক, তাদের চিনি। উনাদের অনেকেই আমার প্রতিবেশী। খবর পেয়েছি বাসা ভাড়া আটকে আছে। মাসের পর মাস ভাড়া দিতে পারছেন না। পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়াই অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
অনেকে সুদে টাকা ধার করে সংসার চালাতে গিয়ে বিপদের সমুদ্রে পড়ে গেছেন। ধার দেনা দিতে না পারার লজ্জায় কোনো কোনো পরিবার স্বেচ্ছায় ঘর বন্দি। শুনেছি, গত প্রায় দুই বছরে কুড়িটিরও বেশি পরিবার এলাকা ছেড়েছে রাতের আঁধারে। তিনটির মধ্যে দুটি স্কুলই নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছে, তারা আর স্কুল চালাবে না।
করোনা শুরুর বছর খানেকের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি—কিন্ডারগার্টেন স্কুল বিক্রির বিজ্ঞাপন। সপ্তাহ দুই আগে দেশের চার প্রান্তই ঘুরে এলাম একযোগে। বড়, ছোট সব শহরেই স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া বা বিক্রি করে দেওয়ার ব্যানার চোখে পড়ল।
করোনা শুরুর বছর খানেকের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি—কিন্ডারগার্টেন স্কুল বিক্রির বিজ্ঞাপন। সপ্তাহ দুই আগে দেশের চার প্রান্তই ঘুরে এলাম একযোগে। বড়, ছোট সব শহরেই স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া বা বিক্রি করে দেওয়ার ব্যানার চোখে পড়ল। আর মন আর্দ্র হয়ে গেল, এই স্কুলগুলোতে যারা চাকরি করতেন তাদের কথা ভেবে।
করোনা মহামারিতে দেশে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে তিন হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল। বেকার হয়েছেন প্রায় তিন লাখ ৬০ হাজার শিক্ষক, কর্মচারী। দেশে এমন স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ।
কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, প্রাথমিক শিক্ষায় এসব স্কুলের ভূমিকা ৩০ শতাংশ। সরকারের দিক থেকে বই ছাড়া এই স্কুলগুলোতে কোনো বিনিয়োগ নেই। করোনায় বিপর্যস্ত এই শিক্ষা মাধ্যমটি স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার সম্ভাবনাটুকুও হারিয়ে ফেলছে।
এখানকার শিক্ষকরা এরই মধ্যে অন্য পেশায় যেতে শুরু করেছেন। চাকরি জোগাড় করতে পারেননি এমন অনেক শিক্ষক হকারি করছেন। গ্রামে গিয়ে দিন মজুরের কাজ করার কথাও জানিয়েছেন কেউ কেউ।
সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিলেও, পুঁজি হারিয়ে ঋণগ্রস্ত মালিকদের কতজন এই ব্যবসায় ফিরতে পারবেন তা অনিশ্চিত। একই সঙ্গে অনিশ্চিত এখানে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া।
করোনা মহামারিতে দেশে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে তিন হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল। বেকার হয়েছেন প্রায় তিন লাখ ৬০ হাজার শিক্ষক, কর্মচারী।
আমাদের শিশুদের, একটি বড় অংশের হাতেখড়ি মহল্লার কিন্ডারগার্টেনে। আমার নিজেরও হাতেখড়ি হয়েছিল এমন একটি স্কুলে। মহল্লার স্কুল উঠে গেলে, অনেক অভিভাবকের সামর্থ্য নেই দূরে স্কুলে সন্তানকে দেওয়ার। এভাবে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার একটি শঙ্কাও দেখা দিচ্ছে।
সরকার করোনাকালে বিভিন্ন খাত ও পেশায় প্রণোদনা দিয়েছে। এই খাতের শিক্ষকরা প্রণোদনা প্রত্যাশা করতেই পারেন। তবে এটি কোনো স্থায়ী সমাধান হবে না এই শিক্ষা মাধ্যমটির জন্য।
কিন্ডারগার্টেন স্কুল টিকিয়ে রাখাটা হচ্ছে স্থায়ী সমাধান। এজন্য অন্যান্য ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও ব্যবসার মতো এই মাধ্যমটিতেও সহজ ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এখানকার শিক্ষক ও পড়ুয়াদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েও এখানে বলে রাখা দরকার, দেশে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার বিস্তার পরিকল্পিতভাবে হয়নি।
এখানকার পাঠ্যসূচি ও বইয়ের উপর প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের নজরদারি নেই। ফলে এখানে মিশ্র শিক্ষা চলছে। ইংরেজি, বাংলা, ক্যাডেট, মাদরাসা, যেখানে যেমন করে শিক্ষার্থী জালে আটকা পড়বে তেমন করেই, স্কুলগুলো চালানো হচ্ছে।
এসব স্কুলের শিক্ষকরাও প্রশিক্ষণের বাইরে থাকছেন। করোনার এই বিরতিকালে বা পুনরায় শুরুর সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ এই দিকগুলো বিবেচনায় এনে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসার উপায় খুঁজতে পারেন। তবে অবশ্যই প্রাণে বাঁচিয়ে ।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী