নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার পটভূমি
সমালোচকেরা নজরুলের বিদ্রোহ ও বিপ্লবের মূল সুর এবং আকুতি ভালোভাবেই শনাক্ত করেছেন। দেখা যাচ্ছে, তার বিদ্রোহ বহুমাত্রিক। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক দাবি সে বিদ্রোহের একাংশ মাত্র। খুব গভীরতর অর্থে ব্যক্তির মুক্তি এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক যেকোনো জড়তা থেকে একটা সচলতায় উত্তরণ সবসময়ই তার বিদ্রোহের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল।
বিধিবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মসূচির বদলে তার আকাঙ্ক্ষায় ছিল ব্যাপক জন গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিমূর্ত রূপরেখা, যাকে এককাট্টা কোনো সূত্রে বেঁধে ফেলা মুশকিল। ফলে নজরুলের বিদ্রোহ এক নিত্য প্রক্রিয়া, যা চলমান থাকবে ব্যক্তিদের প্রাত্যহিক ও সামষ্টিক সক্রিয়তায়। নজরুলের প্রথম পর্বের কবিতা ও গানে বিদ্রোহ-বিপ্লবের এই গভীর অভীপ্সারই প্রতিফলন দেখি। বলা যায়, এটিই নজরুল-সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব।
প্রশ্ন হলো, নজরুলের এ ব্যাপক-গভীর ও সফল বিদ্রোহী কবি-মানসের প্রেক্ষাপট কী? কেনইবা বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির হাতে, কিংবা দ্বিতীয় কোনো মুহূর্তে আমরা এ ধরনের অগ্নিঝরা রচনার পুনরাবির্ভাব দেখি না।
হুমায়ুন কবির তার বিখ্যাত ‘বাংলার কাব্য’ বইয়ে নজরুলকে অভিহিত করেছিলেন অসহযোগ আন্দোলনের কবি হিসেবে। এ শনাক্তি যথার্থ। অসহযোগ আন্দোলনে ব্রিটিশ-বিরোধী গণজাগরণ প্রথমবারের মতো একটা সর্বভারতীয় অবয়বই শুধু লাভ করেনি, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত আন্দোলনের সর্বোত্তম সম্ভাবনাও তৈরি করেছিল। দুটি দিকই নজরুল-সাহিত্যে গভীরভাবে অনূদিত হয়েছে। তারও আগে বাংলা অঞ্চলে সশস্ত্র ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামের যে পর্ব সংঘটিত হয়েছিল, তথ্য-উপাত্ত বলছে, নজরুল তার সাথেও পরিচিত ছিলেন, আর প্রভাবিতও হয়েছিলেন। কিশোর কালের সে প্রভাব তার প্রথম পর্বের কবিতা-গানে-যে প্রত্যক্ষভাবে মুদ্রিত হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে এ ব্যাপারে তার জীবনের একটি পর্ব ও অভিজ্ঞতা সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল, দেখতে পাই। তিনি সৈনিক হিসেবে কাজ করেছিলেন কয়েক বছর। তার বিদ্রোহ-বিপ্লবের কবিতা-গানে সে অভিজ্ঞতা গভীর ভূমিকা রেখেছে।
অসহযোগ আন্দোলনে ব্রিটিশ-বিরোধী গণজাগরণ প্রথমবারের মতো একটা সর্বভারতীয় অবয়বই শুধু লাভ করেনি, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত আন্দোলনের সর্বোত্তম সম্ভাবনাও তৈরি করেছিল। দুটি দিকই নজরুল-সাহিত্যে গভীরভাবে অনূদিত হয়েছে।
বিখ্যাত ‘কামাল পাশা’ কবিতায় দেখি, একজন সৈনিক হয়ে সৈনিকদের পক্ষ থেকেই তিনি কথাগুলো উচ্চারণ করছেন। এ কবিতায়, এবং সমধর্মী অন্য বহু কবিতায়, ছন্দ-যোজনার ক্ষেত্রে সৈন্যদের চলার ছন্দ অনুসৃত হয়েছে। অবশ্য এটাও বাইরের দিক। মনের দিক থেকে সৈনিকতা আসলে একটি ছাড়পত্র। এ পরিচয় নির্দেশ করে একটি যুদ্ধ-পরিস্থিতি, যেখানে জীবন দেওয়া-নেওয়া বৈধ, পরিবর্তনের দাবি স্বাভাবিক, সামষ্টিকতা অবশ্যম্ভাবী, উচ্চকণ্ঠ জয়ধ্বনি ও উজ্জীবনী বাণী সব পরিবেশের স্বাভাবিক দাবিতেই ন্যায্য। নজরুলের বিদ্রোহ-বিপ্লবের বহু কবিতা রূপ পেয়েছে এই ন্যায্যতার ভিত্তিতে।
জীবনের বাস্তব প্রয়োজন এবং কর্তব্যকে সৈনিকের চোখে দেখেছেন বলেই হয়তো নজরুলের সাহিত্যকর্মে গতি, যাত্রা, অভিযান, অগ্রসরতা ইত্যাদির এত অপার মহিমায়ন।
অভিযাত্রীর ইমেজ তার লেখায় বারবার এসেছে। এসেছে রক্ত, অগ্নি এবং ঝড়-ঝঞ্ঝার প্রসঙ্গ। এসবকে নজরুল সমর্পিত করতে চেয়েছেন প্রধানত সুরে, যে সুর ভেতর থেকে জাগিয়ে তুলবে ব্যক্তিকে-যাবতীয় জড়তা আর ভেতর-বাইরের বাধা ডিঙিয়ে বের করে আনবে যুদ্ধের ময়দানে।
যুদ্ধের প্রচলিত সুরের আবহের মধ্যে পেশল হাতে নিয়ন্ত্রিত শব্দ ও অনুষঙ্গের সুচারু বিন্যাসই আসলে তার ‘ভাঙার গান’সহ আরও বহু বিস্ময়কর গানের উৎস। দেহে-প্রাণে সে সুর নিত্য না বাজলে শুধু পরিকল্পিত শব্দবয়নে এ ধরনের রচনা সম্ভব নয়। নজরুলের এ ধরনের রচনার মধ্যে - যেগুলো মূলত গান - ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার!’ সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ।
আলবার্ট হলে নজরুলকে দেওয়া সংবর্ধনায় সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছিলেন, আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মতো প্রাণ মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।
সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছিলেন, আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মতো প্রাণ মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।
তবে সামাজিক-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক এ প্রত্যক্ষ পটভূমির বাইরে নজরুলের বিদ্রোহে-বিপ্লবের অন্য আরেকটা ভিত্তিও খুব প্রকট। তা হলো, জগতের লাঞ্ছিত-ভাগ্যাহত মানুষদের প্রতি সমবেদনা। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার রচনায় এ আকুতি কাজ করেছে; আর বিবর্ণ বর্তমানকে বদলে দিয়ে নতুন দুনিয়ার আকাঙ্ক্ষায় তার শব্দ-যোজনার অন্যতম প্রধান প্রেরণাও এ সহানুভূতি। বলা দরকার, ব্যক্তিজীবনের ইতিহাস ও দারিদ্র্য এ ক্ষেত্রে তার অন্যতম প্রধান প্রণোদনা। অন্য অনেক কবিতায় তো বটেই, এমনকি বহুমাত্রিক বিদ্রোহের আকর-কবিতা ‘বিদ্রোহী’তেও নজরুল ওই কর্তব্য এক মুহূর্তের জন্যও বিস্মৃত হননি।
সমালোচক-তাত্ত্বিক আজফার হোসেন দেখিয়েছেন, শেলীর বিদ্রোহের গতি ও গন্তব্য প্রায়শই আকাশমুখী হয়ে ‘কখনো ঝুলে থাকে মেঘে, কখনো আকাশে’; আর নজরুলের ‘বিদ্রোহী বীর ক্ষ্যাপা, বেপরোয়া, মুক্ত জীবনানন্দ হলেও তার ‘শির’ নতজানু হয় ইতিহাসের কাছেই ... তাকে বলতে হয়, আমি সেইদিন হবো শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না’। অন্তর্গত এ ঝোঁক নজরুলের বিদ্রোহমূলক কবিতার প্রবলতার অন্যতম উৎস এবং একই সাথে অব্যাহত তাৎপর্যেরও আকর।
কোনো সন্দেহ নেই, নজরুলের বিদ্রোহ-বিপ্লবের বিপুল কবিতা-গান রচিত হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতের এক উত্তুঙ্গ মুহূর্তে। নিজের ইতিহাস ও প্রস্তুতির নিরিখে সময়ই হয়তো নজরুলকে নির্বাচন করেছিল সে দায়িত্ব পালনের জন্য যথার্থ ব্যক্তি হিসেবে।
হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ভাষার গভীর থেকে নজরুল সে ভাবকে ভাষা দিয়েছেন। আর এভাবেই রচিত হয়েছে বাংলা ভাষার অন্যতম ক্লাসিক, যার কোনো জুড়ি আগে তো নয়ই, পরেও আর কখনো পাওয়া যায়নি।
ড. মোহাম্মদ আজম ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়