নারীর মানবাধিকার কতটা নিশ্চিত?
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ নারী, যারা অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও অংশীদার। নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়টি খুব বেশি দিন হয়নি আলোচনায় এসেছে। মূলত হিসেব করে বলতে গেলে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলেই আমরা নারীর অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন শব্দগুলোর সামাজিকীকরণ হতে দেখেছি। এর আগে বিষয়গুলো এক প্রকার খাতা-কলমে ছিল।
এখানে আমি সামাজিকীকরণ বলতে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে আলোচিত হওয়ার বিষয়টিকে বুঝিয়েছি। নারীর ক্ষমতায়ন কিন্তু এর আগে কোনো সরকারের আমলেই সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
কার্যকর পদক্ষেপ তো অনেক দূরের কথা। এই সরকারের আমলেই আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Millennium Development Goals-MDG) অর্জন হতে দেখেছি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals-SDG)’র লক্ষ্য অর্জনের স্বপ্ন দেখেছি। ক্ষমতায়নের অংশ হিসেবে প্রশাসনিক উচ্চপদে নারীর পদায়নও আমরা দেখেছি। আর সেজন্য এই সরকার ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
আমরা যখন দেখি নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণের মতো বিষয়গুলো বিনা বিচারে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। নারীর শত চিৎকারেও বিচারের বাণী নীরবে, নিভৃতে কাঁদে তখন আমাদেরকে এক অজানা হতাশা এসে ঘিরে ধরে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বলেন, সম্পত্তিতে নারীর অধিকারকে নিশ্চিত করা হবে, তখন কিন্তু আমরা এদেশের নারীরা নিজেদের অস্তিত্বকে টের পাই। নতুন দিনের স্বপ্ন দেখতে পারি। আমার অধিকার নিয়ে জোর লড়াই করার শক্তি পাই। এই সাহসটাও কিন্তু এই সরকারেরই দেওয়া।
কিন্তু হায়! এর পাশাপাশি আমরা যখন দেখি নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণের মতো বিষয়গুলো বিনা বিচারে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। নারীর শত চিৎকারেও বিচারের বাণী নীরবে, নিভৃতে কাঁদে তখন আমাদেরকে এক অজানা হতাশা এসে ঘিরে ধরে।
ছাত্রজীবন থেকে স্লোগান দিয়ে এসেছি, নারীর অধিকার মানবাধিকার। সেই স্লোগানে স্বপ্ন ছিল কিন্তু শক্তি ছিল না। বর্তমান সরকারের আমলেই আমরা সেই শক্তিও অর্জন করতে পেরেছিলাম। তাহলে আমাদের সেই শক্তিকে কেন আজকে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে? কারা দুর্বল করে দিতে চাইছে নারীর ক্ষমতায়নের অর্জনকে?
অনেকেই ভাবছেন কেন আমি এই প্রশ্ন করছি। কী এমন ঘটনা ঘটলো যে, আমি একদাগে নারীর অর্জনকে জিরো করে দিতে পারছি? পারছি কারণ আমি একজন নারী হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে, একজন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে পরীমণিকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে দেখছি।
পরীমণিকে গ্রেফতার থেকে শুরু করে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ, প্রমাণ, রিমান্ড এবং সর্বশেষ জামিন নিয়ে যে লুকোচুরি খেলা হচ্ছে সেখানে আর যাই হোক, পরীমণি তার নাগরিক অধিকার থেকে পাচ্ছে, সেটি বলা যাচ্ছে না।
যত বড় অপরাধী হোক না কেন, আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার একজন নাগরিকের মানবাধিকার। সংবিধান সেই অধিকারকে সংরক্ষণ করে দিয়েছে। অথচ আমরা দেখছি পরীমণিকে দিনের পর দিন রিমান্ডের নাম করে মানসিক অত্যাচার করা হচ্ছে।
জামিনের আবেদন কোনো কারণ ছাড়াই নাকচ করে দেওয়া হচ্ছে। আইনজীবীকে তার সাথে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এই বাংলাদেশের রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার সময় তিনটি মূলমন্ত্র ছিল সকল মানুষের সমতা, মানবিক মর্যাদা রক্ষা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা যার আলোকে পরবর্তীতে স্বাধীন দেশের সংবিধান রচিত হয়েছিল। তখন কিন্তু কোথাও বলা হয়নি যে এগুলো কেবল পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য হবে বা সংবিধানের কোথাও নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বলা হয়নি যাদের জন্য রাষ্ট্রের সকল সুবিধা সমান হবে না।
যত বড় অপরাধী হোক না কেন, আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার একজন নাগরিকের মানবাধিকার। সংবিধান সেই অধিকারকে সংরক্ষণ করে দিয়েছে। অথচ আমরা দেখছি পরীমণিকে দিনের পর দিন রিমান্ডের নাম করে মানসিক অত্যাচার করা হচ্ছে।
আমি জানি, এই সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাহলে প্রশ্ন এসেই যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলমন্ত্র কিন্তু বঙ্গবন্ধুরই তৈরি ছিল। তার মানে তিনি এদেশের নারীদেরকেও মর্যাদার আসীনে দেখতে চেয়েছিলেন। নারীর অধিকারকে মানবিক অধিকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন সাংবিধানিকভাবে। অথচ আজকে আমরা কী দেখছি?
রাষ্ট্র কখনো এক পাক্ষিক হতে পারে না। রাষ্ট্রের কাছে নারী বা পুরুষ বলে কোনো শব্দ থাকতে পারে না। তার কাছে সকল নাগরিক সমান হবে।
আইন যেমন সকলের জন্য সমান ঠিক তেমনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠাও তারই অন্যতম অংশ। অথচ আজকে পরীমণিকে তার নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
পরীমণি যদি একজন অপরাধী হয়ে থাকে তাহলে সেটিও হতে হবে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেখানে উভয় পক্ষের আইনি লড়াই হবে, যুক্তি তর্ক হবে। প্রতিষ্ঠা পাবে সত্য।
প্রশ্ন এসেছে পরীমণির অপরাধগুলো কী কী? সেটি কি পরীমণি নিজেও জানে? পরীমণির আইনজীবীরাও এই জায়গায় অন্ধকারে রয়েছে। দিনের পর দিন রিমান্ডে নিয়ে কোন অজানা তথ্য বের করতে চাইছে সেটিও অজানা। এমন প্রশ্নবিদ্ধ বিচার ব্যবস্থা নিয়ে রাষ্ট্র কখনো সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। আর সাম্য বা মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না হলে সেই রাষ্ট্রকে মানবিক রাষ্ট্র বলা যাবে না।
আমরা চাই আমাদের রাষ্ট্র হবে মানবিক মর্যাদা সম্পন্ন। রাষ্ট্রের কোনো আইন বা সিদ্ধান্ত নিয়ে নাগরিকের মনে সামান্যতম সন্দেহ থাকা মানেই সেখানে সংশোধনের সুযোগ থেকে যায়।
একজন নাগরিকও যদি সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে রাষ্ট্র তার প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র হারায়। নারীর মানবাধিকারকে স্বীকৃতি না দিয়ে একটি রাষ্ট্র মানবিক হতে পারে কী? প্রশ্ন রেখে গেলাম।
লীনা পারভীন ।। কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট