সহমতের রাজনীতি
রাষ্ট্রের সৌন্দর্য হচ্ছে রাজনীতি এবং রাজনীতিতে লাবণ্য ঝরে যখন স্লোগান থাকে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে। নিজে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে পারিনি। কারণ কলেজে প্রবেশ লগ্নেই সার্বক্ষণিক সাংবাদিকতায় নাম লিখিয়ে ফেলি। তবে কলেজে যখন ছাত্র সংগঠনগুলো মিছিল বের করতো, তখন আমি সেই মিছিলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হতাম।
বন্ধুরা সক্রিয় রাজনীতিতে মাঠে নেমে পড়েছিল প্রায় সবাই। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন। বন্ধুরা মিছিল করতো আমি কোনো কোনো মিছিলে তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে কলেজ ক্যাম্পাস বা করিডোর পার হতাম। সকল দলের বন্ধুরা মিলে চা-সিঙাড়ার আড্ডা হতো।
আমার একজন শিক্ষক আমাকে এমন আড্ডায় দেখে ডাকলেন। বললেন, তুমি সাংবাদিকতা করছো। কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে তুমি জড়াবে না। জড়ালে তুমি কোনো একপক্ষের পক্ষপাতিত্ব করতে বাধ্য হবেই। সেটা চেতন-অবচেতন দুইভাবেই হতে পারে। কখনো কখনো পক্ষপাতিত্ব করতে তোমাকে বাধ্যও করতে পারে।
মেধাবীরা রাজনীতি ছাড়ছে। রাজনীতি ক্যাডার ভিত্তিক ও নেতা কেন্দ্রিক হচ্ছে। ছাত্র সংগঠনের ক্যাডাররাই কর্ম কমিশনের ক্যাডার নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। যখন যেই দল ক্ষমতায় আসে তখন সেই দলের ক্যাডাররা সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
আমি শিক্ষকের কথা শুনে সচেতন হলাম। কিন্তু তার কাছে ঐ প্রশ্নও রাখলাম, আমি সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দেখছি রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারীরা শিক্ষা জীবনে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা কি পক্ষপাত আচরণ করেন না? শিক্ষক বললেন, পক্ষপাত আচরণ করার কূটনৈতিক কৌশল আছে।
রাজনীতি মেধাবী শিক্ষার্থীরাই করতেন এক সময়। তারা যেমন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন, তেমনি মুখরিত রাখতেন সংস্কৃতি অঙ্গন। ছাত্র রাজনীতি করা মেধাবীরা তাদের রাজনৈতিক আদর্শের স্বার্থ দেখতেন মূলত। ব্যক্তি স্বার্থও থাকতো কিছুটা প্রচ্ছন্ন ভাবে। কিন্তু কোনোটাই প্রকাশ্যে নিয়ে আসতেন না। পেশাগত দক্ষতার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। নৈতিকতা বিসর্জন দিতেন না। রাষ্ট্রের স্বার্থ তুচ্ছ করে দলীয় স্বার্থকে প্রধান করে তুলতেন না।
রাজনৈতিক দলগুলোও নগদে তাদের অনুসারীদের কাছ থেকে নগদ প্রাপ্তির জন্য হাত পেতে বসতেন না। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে মেধাবীরা রাজনীতি ছাড়ছে। রাজনীতি ক্যাডার ভিত্তিক ও নেতা কেন্দ্রিক হচ্ছে।
ছাত্র সংগঠনের ক্যাডাররাই কর্ম কমিশনের ক্যাডার নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। যখন যেই দল ক্ষমতায় আসে তখন সেই দলের ক্যাডাররা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এতে মেধাবী কর্মচারী পদন্নোতি এবং নিজের মেধা বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। কাউকে কাউকে বিদায় নিতে হয় চাকরি থেকে, স্বেচ্ছায়ও চলে যান অনেকে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র।
কলেজ জীবনে শিক্ষকের বলা কথা এখন জনজীবনে মিলিয়ে দেখছি। ছাত্র সংসদ বন্ধ। ডাকসু চালু হয়েছে। কিন্তু ফিরেনি আগের রূপে। ফলে অন্যদের দাবি জোরদার হচ্ছে না। ছাত্র সংসদ বন্ধ থাকায় শুধু যে রাজনৈতিক নেতৃত্বে সংকট তৈরি হয়েছে এমন নয়। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোতেও তাই।
ছাত্র সংগঠন করে আসা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা রাষ্ট্রের কাছে নগদ আবদার করে বসেন। তাদের অহেতুক বন্দনা গীত, ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলকেও বিব্রত করে অনেক সময়।
কলেজ জীবনে শিক্ষকের বলা কথা এখন জনজীবনে মিলিয়ে দেখছি। ছাত্র সংসদ বন্ধ। ডাকসু চালু হয়েছে। কিন্তু ফিরেনি আগের রূপে। ফলে অন্যদের দাবি জোরদার হচ্ছে না।
কখনো কখনো তাৎক্ষণিক ফলন তুলতে, সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলও তার কর্মীদের কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়। সম্পর্কটা এখন চলে গেছে পারস্পরিক লেনদেনে।
গত শতকের নব্বই পরবর্তী সময় থেকে এই পারস্পরিক লেনদেনের সম্পর্কটা গাঢ় হয়েছে। বেড়েছে আনুকূল্য-আনুগত্যের চর্চা। এতে বিভিন্ন পেশায় রাজনীতিকরণ দৃশ্যমান হয়েছে।
প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে আনুকূল্য এবং আনুগত্যের। কার বেশি প্রাপ্তি যোগ হলো, আর কার কম এ নিয়ে নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বিরোধও কখনো কখনো প্রকাশ্যে এসেছে। এই বিরোধ বিচলিত করে রাষ্ট্র, সরকার এবং জনগণকে। এই আবহাওয়া কোনোভাবেই সুশাসনের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়।
প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া ফিরিয়ে আনতে হলে একদিকে যেমন আদর্শিক রাজনৈতিক চর্চার প্রয়োজন। তেমনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা শতভাগ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীই হবেন, থাকবেন পেশার প্রতি দায়বদ্ধ।
যেকোনো আদর্শে প্রকৃত রাজনীতি করে আসা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বা রাজনৈতিক নেতা দুর্নীতিতে নিজেকে নিমজ্জিত করতে পারেন না । যখন দেশ, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয়ে উঠে তখনই দুর্নীতির প্রবৃদ্ধি হয়। বাড়ে অহং সংঘর্ষ। আমরা অহং বিরোধ মুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নাগরিক জীবন উদযাপন করতে চাই।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী