তালেবানদের উত্থান ও সাংস্কৃতিক হিমঘর
সম্প্রতি আফগানিস্তানে রাজনৈতিক পটভূমির যে পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে দক্ষিণ এশিয়াসহ সারা পৃথিবীর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেই নানা ধরনের উত্থান-পতন ঘটবে বলে মনে করছেন ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। সেই পরিবর্তনগুলোর অনেকটা আভাসই আমরা পেতে পারি ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে তালেবানি শাসনের নজির থেকে।
১৯৯৪ সালে আফগান গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই ধর্মভিত্তিক উগ্র জাতীয়তাবাদী দলটির আবির্ভাব ঘটে। ২০০১ সালে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স এবং ন্যাটো দেশগুলোর পরিচালিত যৌথ অভিযানের মাধ্যমে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের অবসান হয় এবং তালেবান নেতাদের বন্দি করা হয়, বাকিরা পালিয়ে যায়।
প্রায় দুই দশক পর এই সশস্ত্র তালেবানদের পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে অনেকগুলো রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্ন আমাদের সামনে উঠে এসেছে। প্রশ্নগুলো কেবল বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশের নিজস্ব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিতেও আলোচনার দাবি রাখে।
যেকোনো উগ্রবাদ দমনে সাংস্কৃতিক লড়াই ও আন্দোলনের কথা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা করে আসছি। পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত থাকলেও এ বিষয়ে নিশ্চয়ই সকলে একমত হবেন যে, উগ্রবাদ দমনে সাংস্কৃতিক উদারনৈতিক লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই।
আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে চেনার অন্যতম একটি উৎস হলো, প্রখ্যাত বাঙালি লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমণকাহিনী ‘দেশে বিদেশে’। ১৯২০- এর দশকের ধর্মনিরপেক্ষ আফগানিস্তানকে চেনা যায় এই গ্রন্থের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেই ধর্মনিরপেক্ষতা এখন প্রায় সুদূর অতীত।
আগ্রাসী বা ধ্বংসাত্মক মতবাদকে নিষ্ক্রিয় করতে উদারনৈতিক রাজনৈতিক মতবাদের মূল স্রোত হিসেবে কাজ করে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। কিন্তু সেই আন্দোলনের স্বরূপটি কেমন, সেটি বিবেচনার দাবি রাখে। যদি আফগানিস্তানের প্রেক্ষাপট থেকেই বিবেচনা করি, তাহলেও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাববার অবকাশ রয়েছে।
নানা রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের যে ইতিহাস আমরা জানি, সেটিই যে প্রকৃত ইতিহাস নয়, তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে চেনার অন্যতম একটি উৎস হলো, প্রখ্যাত বাঙালি লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমণকাহিনী ‘দেশে বিদেশে’। ১৯২০- এর দশকের ধর্মনিরপেক্ষ আফগানিস্তানকে চেনা যায় এই গ্রন্থের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেই ধর্মনিরপেক্ষতা এখন প্রায় সুদূর অতীত।
বর্তমানে গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা যে আফগানিস্তানকে দেখছি, তা উগ্র ধর্মান্ধদের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত এক দেশ। এখানে তালেবানি অপশক্তির পুনরুত্থান ঘটেছে কিন্তু আফগান সভ্যতার যে উদারনৈতিক নজির, তার আর পুনরাগমন ঘটেনি। বরং সেটি যেন আর না ঘটে তার সমস্ত আয়োজনই সম্পন্ন করেছে এইসব ধর্মান্ধ সশস্ত্র তালেবানরা।
তারপরও একটি প্রশ্ন জাগে, ২০০১ সাল থেকে গত দুই দশকে আমরা আফগানিস্তান সম্পর্কে নানা ইতিবাচক সংবাদ পড়েছি। শিক্ষা (বিশেষত নারী শিক্ষা), অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, গণমাধ্যম ও দারিদ্র বিমোচনসহ নানা সূচকে আফগানিস্তানের উন্নয়নের সংবাদ আমরা জেনেছি।
২০১০ সালে আফগানিস্তান ক্রিকেট দল টি-২০ বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে আর ২০১৩ সালে চার বছরের জন্য অর্জন করে একদিনের ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা।
নব্বইয়ের দশকে তালেবান শাসনের সময় নারীদের শিক্ষা বা কাজে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তালেবান শাসনের অবসানের পর বিচারক, পুলিশ ও সরকারি দপ্তরগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
আফগান পার্লামেন্ট, প্রাদেশিক পরিষদ ও জেলা কাউন্সিলে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, স্কুলে শিশুর সংখ্যা নয় লাখ থেকে বেড়ে ২০১৭ সালে এসে ৯২ লাখ হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ শতাংশই মেয়ে।
গত বিশ বছরে আমরা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আফগান চলচ্চিত্র দেখেছি। ২০০৩ সালের আফগান চলচ্চিত্র ‘ওসামা’ পেয়েছিল গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার। ‘বুজকাশি বয়েজ’ মনোনয়ন পেয়েছিল অস্কারে। ‘অ্যা লেটার টু দ্য প্রেসিডেন্ট’ পুরো বিশ্বে সাড়া ফেলেছিল।
আফগানিস্তানের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বিশ্বের কাছে লেখা খোলা চিঠি পড়ে আমাদের মন ভেঙে যায়, তবে সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্নটিও তৈরি হয় যে, ২০০১ সাল থেকে চলচ্চিত্রকর্মী, শিল্পী, নির্মাতাদের শ্রমে যে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছিল, তা কি এক লহমায় ভেঙে পড়ল?
আফগানিস্তানের অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা নিজ দেশের বাইরে গিয়েও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। রাশিয়া থেকে তৈরি হয়েছে ‘শিরিন গুল-ও-শির আগা’, ‘ফরেইন ল্যান্ড’, ‘লুরি’, ‘শেরাঘাই দাঘালবাজ’, ‘ইন দ্য রং হ্যান্ডস’, ‘শেড অব ফায়ার।’ আমেরিকা প্রবাসী নির্মাতা তৈরি করেছেন ‘আল কারিম’। তাছাড়া পাকিস্তান থেকে তৈরি হয়েছে ‘শেকাস্ত’ এবং ইতালিতে তৈরি হয়েছে ‘গ্রিদামি’।
কিন্তু বিশ বছরের এত ইতিবাচক হিসাবের পরও মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই গোটা আফগানিস্তান প্রতিরোধহীনভাবেই চলে যায় ধর্মান্ধ সশস্ত্র তালেবানদের দখলে।
আফগানিস্তানের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বিশ্বের কাছে লেখা খোলা চিঠি পড়ে আমাদের মন ভেঙে যায়, তবে সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্নটিও তৈরি হয় যে, ২০০১ সাল থেকে চলচ্চিত্রকর্মী, শিল্পী, নির্মাতাদের শ্রমে যে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছিল, তা কি এক লহমায় ভেঙে পড়ল? তাহলে কি বিশ বছরের এই সাহিত্য, সিনেমা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান জনগণের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াই তৈরি করতে পারল না? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কেন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেশটির এই পরিণতি ঠেকাতে পারলো না?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আত্মসমালোচনা সম্ভব। কেবল সাংস্কৃতিক আন্দোলনই নয়, রাজনৈতিক অসারতার জায়গাগুলোও চিহ্নিত করা সম্ভব।
২০০১ সালের পর আফগানিস্তানে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, সেখান থেকেই বিরাজনীতিকরণ শুরু হয়। ফলে গত বিশ বছরে আফগানিস্তানে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সবগুলোই ছিল নামেমাত্র। তাতে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল না বললেই চলে। কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্যোগ ছিল না, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক চর্চাও ছিল না।
২০১৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসেন আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করা নৃতত্ত্ববিদ ড. আশরাফ গনি। কোনো প্রকার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছাড়াই একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং বিশ্বব্যাংকের আমলার এমন নির্বাচনী জয় অভূতপূর্ব। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, যে দেশের রাজনীতিতেই কোনো জনসম্পৃক্ততা নেই, সে দেশের সংস্কৃতিও হবে কেবলই উদযাপন আর উৎসবের। সংস্কৃতি এখানে রাজনৈতিক বোধ বা মানসিকতা তৈরিতে কোনো প্রভাব রাখবে না।
আফগানিস্তানের সঙ্গে তুলনা না করলেও এ কথাটি সত্য যে, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনও এখন অনেকটাই উৎসব আর পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গত এক যুগের খতিয়ানই যদি উল্লেখ করি, রাজধানী বা বড় শহরগুলোর বাইরে গিয়ে আমরা কতগুলো চলচ্চিত্র উৎসব করতে পেরেছি? কতগুলো নাট্যোৎসব করতে পেরেছি?
শহরের সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে আমরা নানাবিধ উৎসব আয়োজন করেছি, তাতে আপামর জনসাধারণের মৌলিক বোধে কোনো পরিবর্তন এসেছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। উল্টো আমাদের দেশে সংস্কৃতি বিরোধী চক্রগুলো ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিলের নামে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তৃণমূল পর্যায়ে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক বিদ্বেষ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আমরা শহরে বসে তার প্রতিবাদ করেছি কিন্তু উৎস-অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হইনি। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আরও বেশি একা হয়ে পড়েছেন এবং আশ্রয় নিয়েছেন ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোর বিভ্রান্তিকর জগতে।
আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, বিদেশি সাহায্য দিয়ে রাষ্ট্রের আদর্শ টিকিয়ে রাখা যায় না। এমনকি দেশীয় সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক কদরে হয়তো ব্যক্তিগত উপকার হয় কিন্তু দেশের জনগণের মানসিকতাকে স্পর্শ করতে না পারলে সেই ‘আন্তর্জাতিক কদর পাওয়া’ সংস্কৃতিও শেষ পর্যন্ত একটি শো-পিস মাত্র। এই উপলব্ধি আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে নতুনভাবে বেগবান করতে পারে বলে মনে করি।
সঙ্গীতা ইমাম ।। শিক্ষক, শিশুসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী