রাতের রানী, দিনের রাজা শব্দগুলো নষ্ট সমাজের উপমা
সব মানুষই একটা সাজানো গোছানো জীবনের স্বপ্ন দেখে। আর সে স্বপ্নকে ঘিরে আশার বীজ বোনা মানুষের স্বভাবজাত প্রকৃতি। আর এ আশার হাত ধরেই পরিবার, সমাজ, দেশ অগ্রগতির পথে এগিয়ে যায়। প্রতিটি মানুষের দেখা স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটে বাস্তবতার মাধ্যমে। কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন বলতে কেবলমাত্র আর্থিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যকে বোঝায় না।
একটি দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের পথে সে দেশের জনগণের পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধের উন্নয়ন যদি সঠিকভাবে না হয় তবে সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার পথে নৈতিক অবক্ষয় প্রশ্নবিদ্ধ করে। আর তার প্রভাব পড়ে রাষ্ট্রের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে।
সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন এদেশের প্রতিটি নাগরিক প্রতিনিয়ত লালন করে তার চিন্তা চেতনায়। অবকাঠামোগত ভাবে আওয়ামী সরকারের হাত ধরে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে বর্তমান সময়ে দেশের দুর্নীতির পাশাপাশি সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র দেখে মনে হয়, ‘রাতের রানী দিনের রাজা’- এ শব্দগুলো কেবল এক নষ্ট সমাজের উপমা।
করোনার মহামারিতে মানুষকে মৃত্যুভয় তাড়া করছে প্রতি মুহূর্তে। এ এমন এক রোগ যা শরীর মনকে অবসাদ আর বিষণ্ন করে তোলে। সে কারণে করোনাভাইরাসের সাথে লড়াই করার জন্য শরীরের চেয়ে মানসিক শক্তি অনেক বেশি জরুরি। একজন মানুষের শারীরিক অবয়বের অন্তরালে যে মনটা রয়েছে তার ভালো আর মন্দ দুটো দিক রয়েছে। আর সেদিকগুলোর নিয়ন্ত্রক হলো, মানুষের সু-রিপু এবং কু-রিপু।
একজন নারীর নামের সাথে যত খারাপ তকমা লাগানো যায় তার সবই ব্যবহার করা হয়েছে এদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও গণমাধ্যমে।
একজন মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে না যতক্ষণ না সে তার কু-রিপুকে অবদমন করতে পারে। হয়তোবা এ কথাগুলোকে তাত্ত্বিক বলে মনে হতে পারে। তবে তত্ত্ব কথা বলা সহজ হলেও মানা কঠিন। কারণ কু-রিপুর তাড়নায় মানুষ হয় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। ভুলে যায় সমাজের বিধিনিষেধ। অর্থের গরিমায় অন্ধ হয়ে পৃথিবীকে নরকে পরিণত করে। সুন্দরের আড়ালে নিজের কুৎসিত চেহারাটা দেখে লজ্জিত না হয়ে মিথ্যাকে সাথে নিয়ে কিনতে চায় রাষ্ট্র ও সমাজকে।
দিন-রাত্রি, আলো আঁধারের রহস্যভেদ করা যেমন মুশকিল। তেমন দূর্বোধ্য এ সমাজের মুখোশধারী মানুষের আচরণকে অনুধাবন করা। শ্রেণিভেদে চালচলনের বৈচিত্র্যতাতে মানুষের প্রকৃত মানসিক রূপটা সবার কাছে একভাবে প্রকাশ পায় না। ঘরে-বাইরে কোনো মানুষেরই আচরণ যে এক নয় তার প্রমাণ মিলে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা থেকে।
আলোচিত নারীদের নিয়ে নাটকের অন্ত নেই। সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হয় এদেশে নারীরাই প্রথম অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়েছে। একজন নারীর নামের সাথে যত খারাপ তকমা লাগানো যায় তার সবই ব্যবহার করা হয়েছে এদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও গণমাধ্যমে। কিন্তু বিবেকের কাছে কেউ প্রশ্ন রাখে না, তারা কেন এই পথে? বা তাদের পেছনে কে?
নারী বা পুরুষ যেই হোক, সে যখন একবার বিপথে সর্ব সুখের আস্বাদন পায় তখন তার পক্ষে সে পথ থেকে ফিরে আসাটা জটিল হয়ে ওঠে। কারণ তার কু-রিপু তার নৈতিক বোধকে ধ্বংস করে দেয়। এর পাশাপাশি অন্যায়ের বেড়াজাল তাকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরে।
যে নারীদের নিয়ে এতো আলোচনা, তাদের সুদিনের কোনো বন্ধু বা প্রিয় মানুষ এখন পাশে নেই। বরং ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে দুটো গালি দিয়ে নিজেকে সাধু হিসেবে প্রমাণে ব্যতিব্যস্ত।
দিনের আলোতে সমাজের বিত্তবান আলোকিত মানুষের লেবাসধারী ব্যক্তিরা নিজেদের ভোগ বিলাসকে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে তুলে রাতের অন্ধকারে। কারণ অর্থ প্রতিপত্তি সে অধিকার তাদেরকে দিয়েছে বলে তারা মনে করে। নৈতিক- অনৈতিক বোধ তাদের কাছে মুখ্য নয়। এরাই আবার অর্থ দিয়ে কেনা রাতের রানীদের দিনের বেলায় রাজা সেজে চিনতে নারাজ। এমনকি পরিবার সমাজের কাছে নিজেদের সাধু হিসেবে প্রমাণ করতে হত্যা করে নিজের পরকীয়া প্রেমিকাকে। কিংবা ষড়যন্ত্রের নীল নকশায় প্রভাব খাটিয়ে রাতের রানী হিসেবে পরিচয় দিয়ে নারীকে দাঁড় করায় আদালতের কাঠগড়ায়। তাদের এসব অপকর্ম সমাজকে কলুষিত করছে। কিন্তু নৈতিক অবক্ষয়ের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না। কারণ তার অদৃশ্য।
আড়ালের মানুষগুলোকে অন্তত মানবিক মূল্যবোধ থেকে সমাজের কাছে উন্মোচিত করা উচিত। এতে করে হয়তোবা সমাজের নৈতিক অবক্ষয় থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে পাবে আগামী প্রজন্ম।
সমাজের এমন পরিণতি দেখে সব বুঝেও আইনের দোহাই দিয়ে দৃশ্যমান দোষীদের নিয়ে সমালোচনার নহর বইয়ে দেওয়া ঠিক কতটা যুক্তিযুক্ত তার বিচারের দায়ভার রইল রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর। তবে রাতের রানীদের জন্ম যারা দেয় তারা যে এ সমাজের নষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষ তা আজ প্রমাণিত। যদিও বা তাদের ক্ষমতার কাছে পরাজিত সকল শক্তি।
আলোচিত নারীদের ঘটনার আড়ালের মানুষগুলোকে অন্তত মানবিক মূল্যবোধ থেকে সমাজের কাছে উন্মোচিত করা উচিত। এতে করে হয়তোবা সমাজের নৈতিক অবক্ষয় থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে পাবে আগামী প্রজন্ম। তারা নিজেদের চিন্তা থেকে ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদটা বুঝে সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে হয়তোবা চেষ্টা করবে।
ধনাঢ্য পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান কথাটা একটা পরিবার আর সমাজকে বেদনাহত করে। কেননা এর মাধ্যমে সামাজিক অবক্ষয়ের দৈন্যদশা প্রকাশ পায় বিদ্রূপভাবে। আইনের কাঠগড়ায় দৃশ্যত সব অপরাধের বিচার হলেও অদৃশ্য অপরাধের বিচার সম্ভব হয় না। কিন্তু সমাজের একটা বিধিবিধান রয়েছে। যা দিয়ে সেতুবন্ধন রচিত হয় মানুষে মানুষে।
সমাজের নৈতিক শিক্ষাটা না থাকলে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব পড়ে মানুষের নিত্য জীবনে ও রাষ্ট্রের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে। সে জন্য সমাজের নৈতিকতাকে তার নিজস্ব গতিপথে চলতে না দিলে মানুষের বিপথগামীতা বাড়বে বৈ কমবে না। একজন মানুষের পরিচয় কেবল তার অর্থ আর ক্ষমতা দিয়ে হয় না। বরং মানবিক ও নৈতিক গুণাবলীকে ধারণ করে মানুষ হয়ে উঠতে পারলে তবেই বদলে যাবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র।
আজকের সময়ে যে সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার, সেখানে মুষ্টিমেয় ক্ষমতাধরদের কাছে জিম্মি হতে পারে এ সমাজ। তাদের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এমন কোনো উপমা সৃষ্টি করতে দেওয়া উচিত নয় যা থেকে আগামী প্রজন্ম ভুল শিক্ষা নিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবে। সুতরাং আইন আর সমাজের বিধিবিধানের ভারসাম্য বজায় রেখে মানবিক ও নৈতিক অবক্ষয়কে রোধ করতে হবে সরকার ও জনগণকে।
হাসিনা আকতার নিগার ।। কলামিস্ট