শিশুরা কেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়?
সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশ যখন করোনা যুদ্ধ মোকাবিলায় ব্যস্ত সময় অতিক্রম করছে, তখন ডেঙ্গু জ্বরের উচ্চ প্রকোপ আমাদেরকে নতুন করে আতঙ্কগ্রস্ত করছে। করোনা ও ডেঙ্গু উভয়ের প্রাথমিক উপসর্গ জ্বর, যা সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জুন-সেপ্টেম্বর এই চার মাস ডেঙ্গুর প্রকোপ অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ সময়ে করোনা মৃত্যু ঝুঁকিও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। একইসাথে শিশুদের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বর সংক্রমণের হারও বেশি থাকায় অভিভাবকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। করোনার পাশাপাশি শিশুদের ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বাড়ায় আমাদের স্বাস্থ্য খাত নতুন করে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে দৈনিক দুইশ’র বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে এবং এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী হচ্ছে শিশু। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সূত্রমতে, তাদের শিশু বিভাগে ভর্তিকৃত সতেরো জন রোগীর পনেরো জনই ডেঙ্গু আক্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে তারা নতুন করে ডেঙ্গু ইউনিট চালু করেছে।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ভ্যারিয়েন্ট বিদ্যমান। সেগুলো হলো সেরোটাইপ-১, সেরোটাইপ-২, সেরোটাইপ-৩ ও সেরোটাইপ-৪।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ডেঙ্গু কি এবং কেন আমরা আতঙ্কগ্রস্ত? আমরা সকলেই জানি ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ যা এডিস মশার মাধ্যমে একজন আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে অন্য ব্যক্তির শরীরে সংক্রমিত হয়। বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ভ্যারিয়েন্ট বিদ্যমান। সেগুলো হলো সেরোটাইপ-১, সেরোটাইপ-২, সেরোটাইপ-৩ ও সেরোটাইপ-৪।
সম্প্রতি আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীদের নমুনায় সেরোটাইপ-৩ ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেরোটাইপ-৩ ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি সেরোটাইপ-১ ও সেরোটাইপ-২ অপেক্ষা অনেক বেশি। আমাদের দেশের নমুনায় এখনো সেরোটাইপ-৪ এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ভ্যারিয়েন্টের যেকোনো একটি শরীরে প্রবেশ করলে ডেঙ্গু রোগ হয়ে থাকে। এ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে রক্তনালী, যকৃত ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ক্ষতিসাধন করে থাকে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে দেহের বিশেষ অঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, কিডনি ও যকৃতে রক্ত সরবরাহের ঘাটতি দেখা যায়। এছাড়া রক্ত জমাট বাঁধার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্লাটিলেট কমে যায়। এ সবকিছুর ফলে আক্রান্ত শিশু দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে। এছাড়াও শিশুর রক্ত চাপ কমে যেতে পারে, যেটি মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ায়।
শিশুরা ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হলে খুব দ্রুতই পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। কেননা শিশুদের শারীরিক গঠন প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম। কিন্তু শিশুদের ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো একই রকম। এগুলো হচ্ছে, উচ্চমাত্রার জ্বর, মাথা-চোখ-মাংসপেশির ব্যথা, গিরায় গিরায় ব্যথা, রক্ত বমি হওয়া, শরীরে লাল লাল দাগ হওয়া, নাক-মাড়ি দিয়ে রক্ত ঝরা প্রভৃতি। এছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর জ্বর কমে যাওয়ার পরও রোগটি সংকটময় অবস্থায় চলে যেতে পারে।
ডেঙ্গু, করোনা ও ইনফ্লুয়েঞ্জা সবগুলো রোগের সাধারণ উপসর্গ হলো জ্বর। তাই শিশুদের জ্বর হলে সাধারণ ফ্লু মনে করে ঘরে বসে থাকা যাবে না। সাথে সাথেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। করোনা সংক্রমণ রোধে এখন সরকারকে প্রায়ই লকডাউন ঘোষণা করতে হচ্ছে।
যদি চিকিৎসকের পরামর্শ পেতে দেরি হয়, তাহলে অপেক্ষা না করে দ্রুত করোনা পরীক্ষা, রক্তের সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) ও এসএসওয়ান এন্টিজেন্ট পরীক্ষা করানো উচিত। একই সাথে দ্রুত সময়ের মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু শনাক্তে প্রয়োজনীয় অন্যান্য পরীক্ষাগুলো করতে হবে।
প্রাথমিকভাবে ডেঙ্গু শনাক্তের পর সাধারণ জ্বর হলে যা যা করণীয় অভিভাবকদের তাই-ই করতে হবে। যেমন, প্যারাসিটামল খাওয়ানো, কুসুম গরম পানিতে গা মোছানো ও তরল জাতীয় খাবার (ডাবের পানি, খাওয়ার স্যালাইন, লেবুর শরবত, স্যুপ) বেশি বেশি খাওয়ানো ইত্যাদি।
শিশুরা ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হলে খুব দ্রুতই পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। কেননা শিশুদের শারীরিক গঠন প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম।
জ্বর উচ্চমাত্রায় আসলেও প্যারাসিটামল ছাড়া অন্যান্য ব্যথানাশক ওষুধ যেমন অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ কোনোভাবে সেবন করা যাবে না। কেননা এ জাতীয় ওষুধে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও আক্রান্ত শিশুর প্রস্রাব ঠিকমতো হচ্ছে কি না, রক্তচাপ ও নারীর গতি স্বাভাবিক আছে কি না তা লক্ষ্য করতে হবে। কোনো অবস্থায় যদি উপসর্গগুলোর অবনতি ঘটে, তাহলে দেরি না করে সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
শিশুদের এডিস মশার কামড় থেকে সুরক্ষার জন্য অভিভাবকদের কিছু সাধারণ নির্দেশবলী মাথায় রাখতে হবে। সেগুলো হলো—
১. দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের সুতির ফুল হাতা জামা-প্যান্ট ও মোজা পরিধান করানো। দুই বছরের বেশি বয়সী শিশুদের এই গরমে ফুল হাতার জামা-কাপড় পরিয়ে রাখা কষ্টকর হতে পারে, সেক্ষেত্রে মশা নিরোধক ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
২. ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের সবসময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে রোগটি অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত হতে না পারে।
৩. সাধারণত সন্ধ্যার দিকে মশার সংক্রমণ বেশি থাকে। তাই এ সময় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে হবে। যদি সম্ভবপর হয় তাহলে দরজা-জানালায় মশা প্রবেশ বিরোধী নেট লাগাতে হবে।
৪. মশা সাধারণত স্বচ্ছ পানিতে বংশ বিস্তার করে। তাই ফুলের টব, ফ্রিজের নিচের ট্রে, নষ্ট চৌবাচ্চা এবং ঘর বা ব্যালকনির আশেপাশে যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঘরে পোষা প্রাণী থাকলে তার খাবারের পাত্র ও থাকার জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ের তথ্যমতে, ডেঙ্গুর প্রকোপ মূলত রাজধানী ঢাকাতে বেশি এবং ডেঙ্গু জ্বরে যারা মৃত্যুবরণ করছে তাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেশি। তাই বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সরকার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে।
এছাড়াও সরকার বিভিন্ন গণমাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ মূলক সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস চালাচ্ছে। কিন্তু সরকারের একার পক্ষে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব না। তাই সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং শিশুদের সুরক্ষায় অভিভাবকদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, তা না হলে করোনা দুর্যোগের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সত্যিই কষ্টসাধ্য হবে।
ড. আ. স. ম. মঞ্জুর আল হোসেন ।। সহকারী অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়