হুমায়ুন আজাদের দুঃখ, আমাদের ভ্রান্তি
একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টেনে শুরু করা যাক। আরিফুল কামাল নামে আমাদের এক বন্ধু ছিলেন। পাবনার ছেলে। কলকাতার রবীন্দ্রভারতীতে পড়াশোনা করতেন। কবিতাও লিখতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাকে বেশ স্নেহ করতেন বলে শুনেছি। কারণ, কামাল ভালো কবিতা লিখতেন। সম্ভাবনাময় তরুণ এই কবি ২০০৯ সালে আত্মহত্যা করেন।
তো, কামাল কবিতার বই বের করবেন। পাণ্ডুলিপি দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন নির্মলেন্দু গুণসহ ঢাকার বাছা বাছা সব কবিকে। গুণদা তার কবিতার প্রশংসা করলেন। পরে পাণ্ডুলিপি দেওয়া হলো কবি জাহিদ হায়দারকে। সমালোচনা করার ব্যাপারে ‘চাঁছাছোলা’ বলে খ্যাত জাহিদ হায়দার পড়লেন। পাণ্ডুলিপির ওপরে ছোট্ট করে শুধু লিখলেন, ‘তিনি কবি’। ছোট্ট মন্তব্যটি পড়ে চকিতে বুঝলাম যে, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। জাহিদ হায়দারের ওই মন্তব্য আর আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে বলতে পারি, কবিত্ব আসলে চারপাশকে দেখার, অনুভবের ও প্রকাশের একটা বিশেষ সক্ষমতা। এটা সবার থাকে না।
কবিত্বের এই বিশেষ ব্যাপারটা হুমায়ুন আজাদের মধ্যে ছিল। এদিক বিবেচনায় হুমায়ুন আজাদ কবি ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবিরল কবিতা লিখে গেছেন। তার কাব্যগ্রন্থগুলোর একটা কালানুক্রমিক পরিচয় নিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে—অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩), জ্বলো চিতাবাঘ (১৯৮০), সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫), যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল (১৯৮৭), আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০), কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৯৮), পেরোনোর কিছু নেই (২০০৪)।
ষাটের দশক থেকে মৃত্যুর বছর পর্যন্ত হুমায়ুন আজাদ কবিতাই লিখেছেন। কবিতা থেকে তিনি কখনো সরে আসেননি। অথবা বলা যায়, কবিতা তাকে কখনো মুক্তি দেয়নি।
কবি বিষয়ে উপন্যাসও লিখেছেন একটি, কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ (১৯৯৯)। এছাড়া লিখেছেন বেশকিছু কিশোর কবিতা। অনুবাদ করেছেন জন কিটস, ম্যাথিউ আর্নল্ড, উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, ই ই কামিংস, হাইনরিশ হাইনে প্রমুখ কবির বেশ কিছু কবিতা।
কাব্যগ্রন্থগুলোর প্রকাশ সাল বলছে, ষাটের দশক থেকে মৃত্যুর বছর পর্যন্ত হুমায়ুন আজাদ কবিতাই লিখেছেন। কবিতা থেকে তিনি কখনো সরে আসেননি। অথবা বলা যায়, কবিতা তাকে কখনো মুক্তি দেয়নি। এর মধ্যে বহু চড়াই-উতরাই পার করেছেন। লিখেছেন বহু উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, সমালোচনামূলক সাহিত্য, ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ। কিন্তু কবিতা তাকে রেহাই দেয়নি; নিয়তির মতো জাপটে ধরে ছিল আমৃত্যু।
তবু, বাংলাদেশের কবি, শিক্ষিত পাঠক ও সমালোচক সমাজে কবি হিসেবে তিনি খুব যে পঙ্ক্তিভাজন হয়েছেন তা কিন্তু নয়। তাকে মূলত ষাটের কবিতার আলোচনায় শুধু নামোল্লেখে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। অথচ, বাংলাদেশের কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে যাকে আমরা ‘ভালো কবিতা’ বলি, সেই ‘ভালো কবিতা’র সংখ্যা হুমায়ুন আজাদের নিতান্ত কম নয়।
বাংলাদেশে কবি ও কবিতা বিবেচনার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। এখানে দেখা হয় কবিতার মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার সজ্ঞান উপস্থিতি আছে কি না। থাকলে ওই কবি আমাদের প্রথাগত সমালোচক সমাজে সাধারণত ‘বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কবি’ হিসেবে পঙ্ক্তিভাজন হন।
দ্বিতীয়ত দেখা হয়, কবি গরিব মানুষের কথা বলেন কি না (মার্কসিস্ট!), দেশ ও সমাজ নিয়ে ভাবেন কি না। এই খাপের মধ্যে পড়লেন তো ফাঁড়া কেটে গেল। ওই কবি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে ওঠেন। অন্য সবকিছু বাদ দিয়েও, কবি ও কবিতা বিবেচনায় ঢাকার ক্লিশে মাপকাঠিতে হুমায়ুন আজাদের অসংখ্য ভালো কবিতা পড়বে—একথা দায়িত্ব নিয়েই বলা যায়।
হুমায়ুন আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ অলৌকিক ইস্টিমার-এর কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে। এই কাব্যগ্রন্থের বেশিরভাগ কবিতাই কোনো না কোনোভাবে ষাটের জাতীয়তাবাদী চেতনা আর মুক্তিযুদ্ধকে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন এক শিল্পীতায় ধারণ করেছে।
ষাটের দশকে বাঙালি যখন স্বদেশের মুখের দিকে তাকাতে শুরু করেছে তখন অলৌকিক ইস্টিমার কাব্যগ্রন্থের ‘শ্রেণীসংগ্রাম’ কবিতায়
তিনি লিখেছেন, ‘থরোথরো পদ্য লিখে লাল নীল মেয়েদের/এই বুকে কতো যে ডেকেছি/আমার সোনালি বউ না হয়ে/তারা সব ধনীদের উপপত্নী হয়েছে/বালটিতে জল টেনে কতো দিন/গোলাপের শেকড়ে ঢেলেছি/আমার উঠোনে না ফুটে/উল্লাসভরে তারা ধনীদের ফুলদানিতে ফুটেছে/হে পথ হে দেশ একবার ডাকতেই/বুকের ভেতরে এমন নিবিড় ক’রে টেনে নিলে।’ এই কাব্যগ্রন্থেই আছে ‘খোকনের সানগ্লাস’, ‘আমার ছাত্র ও তার প্রেমিকার জন্যে এলেজি’, ‘গৃহনির্মাণ’-এর মতো মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ সব কবিতা। আছে ‘ব্লাডব্যাংক’-এর মতো জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনায় টুবুটুবু অনবদ্য কবিতা।
হুমায়ুন আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ অলৌকিক ইস্টিমার-এর কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে। এই কাব্যগ্রন্থের বেশিরভাগ কবিতাই কোনো না কোনোভাবে ষাটের জাতীয়তাবাদী চেতনা আর মুক্তিযুদ্ধকে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন এক শিল্পীতায় ধারণ করেছে।
শুধু অলৌকিক ইস্টিমার নয় শেষ কাব্যগ্রন্থ পেরোনোর কিছু নেই পর্যন্ত একটা বড় সংখ্যক কবিতায় দেশমাতৃকা আর তার ইতিহাস-ঐতিহ্যের জন্য দুর্ভাবনাগ্রস্ত উৎকণ্ঠিত এক কবির হৃদয়াবেগ সহজেই চোখে পড়ে। যতই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল কাব্যগ্রন্থের ‘গরিবের সৌন্দর্য’ কবিতায় তিনি যখন বলেন, ‘জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না।/শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়’—তখন আধুনিকতাবাদী কবিতা ও চেতনার উপাসক হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে নতুন ভাবনার উদয় হওয়ারই কথা।
কবিতায় আধুনিকতাবাদের ভোক্তা, উৎপাদক ও তাত্ত্বিক হুমায়ুন আজাদ যখন আপ্তবাক্যের মতো আওড়ান ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ অথবা ‘নিসর্গকে হত্যা করে বাঙলার উন্নয়ন হবে’ তখনো তাকে নিয়ে নতুন ভাবনার উদয় হয় বৈকি! তার সমাজ, রাষ্ট্র ও এর রাজনীতি নিয়ে সচেতনতা তো ছিলই। আর তার কবিতার ইন্দ্রিয়ের গভীর ও বিচিত্র আস্বাদনের বিশেষত্বের কথা না-ই বললাম। এ ব্যাপারে বোধ করি জীবনানন্দ দাশ আর সৈয়দ আলী আহসানের সাথেই তার তুলনা হতে পারে। কিন্তু কী এক বিস্ময়কর কারণে তিনি কবি হিসেবে নামোল্লেখেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকেন।
বাংলাদেশের কবিতায় তার যথাযথ স্থান নির্দেশ করা জরুরি বলে মনে করি। তিনি নিজেও কবি হিসেবে যথাযথভাবে শনাক্ত না হওয়ার দুঃখ নিয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন। বিভিন্ন সময় নানা সাক্ষাৎকারে তিনি আক্ষেপও করেছেন বলে জানি। এই যে, কবি হিসেবে যথাযথ শনাক্ত হলেন না—এর কারণ কী? তিনি মনে করতেন, অন্য কবিদের সম্পর্কে বেশি বেশি আলোচনা-সমালোচনা লেখা হয়তো একটা কারণ।
কবি-সমালোচকরা তাকে সমালোচক-গবেষকের তকমা দিয়ে আলাদা করে রেখেছেন! কারণ, তিনি শামসুর রাহমানকে নিয়ে সেই আশির দশকের গোড়াতেই লিখেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা। অদ্যাবধি হয়তো সেটিই শামসুর রাহমান সম্পর্কে কাজ চালানোর মতো সবচেয়ে ভালো গবেষণা।
তবে কি আমরা হুমায়ুন আজাদের সমালোচক সত্তাকেই নিয়েছি! নাকি ঔপন্যাসিক সত্তা, ভাষাতাত্ত্বিক সত্তা ও গবেষক সত্তা এবং মৌলবাদ বিরোধী অবস্থানও কবি হুমায়ুন আজাদকে যথাযথভাবে পড়তে আমাদের মধ্যে কোনো আবিলতা তৈরি করেছে! অথচ বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে কবিদের গুরুত্ব বিবেচনার সকল মাপকাঠিতেই তার কবিতা গুরুত্বপূর্ণ।
হুমায়ুন আজাদের অন্যান্য সত্তার চোরাবালিতে পড়ে আমরা তার কবিতার কাছে পৌঁছাতে পারিনি! নাকি বাঁধা পথের পরিধি বাড়ানোর ক্লেশে আমরা স্বীকার করতে চাই না! কারণ, কবি হিসেবে হুমায়ুন আজাদ কেমন সেই পরীক্ষা বা আলোচনাই তো এখনো হয়নি। কিন্তু হওয়া উচিত বলেই মনে করি। তাহলেই বোধ করি তার দুঃখ আর কবি হিসেবে তাকে শনাক্ত না করতে পারার আমাদের ভ্রান্তি দুই-ই দূর হবে।
ড. কুদরত-ই-হুদা ।। প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষক
[email protected]