যেভাবে আমরা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারলাম
নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না বাবা সুরত আলী, তাকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরছেন ছেলে জাহাঙ্গীর আলম। শেষমেশ মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালে এসে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামাতে গিয়ে টের পেলেন বাবা আর নেই—আবার সেই অ্যাম্বুলেন্সেই ফিরলেন লাকসামের উদ্দেশ্যে, দাফনের জন্য।
ঢাকার কোনো সরকারি-বেসরকারি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি নেই, এমনকি অক্সিজেন দেওয়ার মতো অবস্থাও নেই। প্রতিদিনই শত শত মানুষ ঘুরছেন এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে, একটু অক্সিজেন কিংবা একটি আইসিইউ বেডের আশায়, কিন্তু কিছুই মিলছে না। কেউ একজন মারা গেলে বা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে সেই আইসিইউ বেডে আরেকজন ভর্তি হতে পারবে—এই হলো ঢাকার করোনা হাসপাতালের বর্তমান চিত্র।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই ভয়াবহতা কমিয়ে আনতে দেশে সর্বশেষ দফার কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে ২৩ জুলাই থেকে, চলার কথা ৫ আগস্ট পর্যন্ত। কথা ছিল এবারের লকডাউনে গার্মেন্টসসহ সবকিছুই বন্ধ থাকবে। কিন্তু গার্মেন্টস মালিকরা এবং তাদের সমিতি বিজিএমইএ শুরু থেকেই গার্মেন্টস কারখানাকে লকডউনের আওতার বাইরে রাখার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। অনেকেই বলছিলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত মানবেন না গার্মেন্টস মালিকরা। ঈদ উপলক্ষে এমনিতেই এক সপ্তাহের ছুটি থাকে কারখানাগুলোতে। সেই ছুটি শেষে ১ আগস্ট থেকে ঠিকই কারখানা চালু করে দেবেন তারা।
আমরা দেখলাম, সত্যি ১ তারিখের আগেই গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র নেতারা সরকারের সাথে দর কষাকষি করে নিজেদের দাবি আদায় করে নিলেন।
কেউ একজন মারা গেলে বা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে সেই আইসিইউ বেডে আরেকজন ভর্তি হতে পারবে—এই হলো ঢাকার করোনা হাসপাতালের বর্তমান চিত্র।
সরকার ১ আগস্ট থেকে গার্মেন্টসসহ রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানা চালুর অনুমতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করল। সাংবাদিকরা বিজিএমইএ নেতাদের প্রশ্ন করলেন, লকডাউনের মধ্যে গণপরিবহন বন্ধ—এ অবস্থায় শ্রমিকরা ঢাকায় আসবে কীভাবে? সভাপতি ফারুক হাসান স্মিত হাস্যে জানালেন, তাদের সব শ্রমিক নাকি আগেই ঢাকায় চলে এসেছে, আর যারা আসেনি তারা ৫ তারিখ লকডাউন প্রত্যাহারের পর ফিরলেও সমস্যা নেই, তাদের চাকরি যাবে না। একই কথার প্রতিধ্বনি করলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ৩১ জুলাই সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পিঁপড়ার মতো মানুষ আসতে শুরু করল ঢাকার দিকে। পরিবহন না পেয়ে রংপুরে সড়ক অবরোধ করলেন শ্রমিকরা। ট্রাকে করে, ভ্যানে করে যে যেভাবে পারেন আসছেন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে।
বরিশাল থেকে পায়ে হেঁটে রওনা হয়েছেন অনেকে—এমন ছবিও দেখেছি ফেসবুকে। নারী-পুরুষ যেন শরণার্থীদের দীর্ঘ লাইন রাস্তায়। তাদের হাতে ব্যাগ, বাক্স প্যাটরা, মায়ের কোলে শিশু। কী বীভৎস, ভয়াবহ এক যাত্রা! ১ তারিখেই কাজে যোগ দিতে হবে, সুপারভাইজার ফোনে জানিয়েছে। বিজিএমইএ নেতারা যাই বলুক, তাদের বেতন তো বিজিএমইএ দেয় না, মালিক জানিয়ে দিয়েছে, ১ তারিখেই আসতে হবে—তাই এই প্রাণান্তকর যাত্রা।
সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ছিল ফেরিঘাটে। একেকটি ফেরিতে কত হাজার মানুষ উঠেছে তা গুণে শেষ করা যাবে না। ৩১ জুলাই সারাদিন টিভিতে সেই খবর মানুষ দেখেছে, ১ আগষ্ট দেশের সবগুলো দৈনিকের প্রথম পাতা জুড়ে ছিল সেই ভয়াবহ ভিড়ের ছবি। কিসের স্বাস্থ্যবিধি, কিসের সামাজিক দূরত্ব, কিসের মাস্ক! মানুষ জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঢাকায় ফিরেছেন, যে যেভাবে পেরেছেন।
রাতের মধ্যে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কঠিন দুর্ভোগ উপেক্ষা করে ঢাকায় ফিরলেন বা অনেকেই যখন ঢাকার কাছাকাছি, তখন হঠাৎ রাত নয়টার সময় সরকার ঘোষণা করলো যে, রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের কর্মস্থলে যোগদানের সুবিধার্থে ৩১ জুলাই রাত থেকে ১ আগষ্ট দুপুর ১২টা পর্যন্ত লঞ্চ চলাচল করবে। আরও এক ঘণ্টা পর ঘোষণা এলো গণপরিবহন চলবে, মানে বাস চলবে ১ আগষ্ট দুপুর ১২টা পর্যন্ত। কিন্তু রোববার সকালে কারখানাগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাত থেকে যানবাহন চালু করার সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের কোনো উপকারেই আসেনি। তারা আগেই নিজের উদ্যোগে ঢাকায় চলে এসেছেন।
সদরঘাট টার্মিনালে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ৩১ জুলাই রাতে বরিশাল থেকে একটা লঞ্চও আসেনি। কারণ যাত্রী ছিল না, যাত্রীরা তো আগেই পায়ে হেঁটে, ট্রাকে, ভ্যানে যে যেভাবে পেরেছেন ঢাকায় রওনা হয়ে গেছেন।
এই যদি আমাদের সরকার, গার্মেন্টস মালিক এবং নীতিনির্ধারকদের বিচক্ষণতা হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, ১৪ দিনের টানা লকডাউন কতটুকু বাস্তবসম্মত এবং কার্যকর। তারা শুরুতে বলেছিলেন, গার্মেন্টস কারখানা ৫ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ থাকবে, এক সপ্তাহ পরে বললেন ১ আগস্ট সব খুলে দেওয়া হবে। আর ৫টা দিন বন্ধ থাকলে কি দেশের রপ্তানি আয় সব ধ্বংস হয়ে যেত? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে হ্যাঁ, ৫ দিনেই বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি খাত ধ্বংস হয়ে যাবে, তাহলে সেটা আগে কেন বুঝলেন না? কেন তাদের বাড়ি যেতে দিলেন?
জুলাই মাসেই সবচেয়ে ভয়াবহ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে, গ্রামে গঞ্জে। এমন একটা কঠিন সময়ে এসে স্বাস্থ্যবিধির বারোটা বাজিয়ে, লকডাউনের নিয়ম ভেঙে আমরা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলাম।
লকডাউন বা করোনাভাইরাস তো দেশে নতুন আসেনি। গত প্রায় দেড় বছর ধরে তো আমরা করোনার সাথেই বসবাস করছি। তাহলে আগে থেকেই কেন গার্মেন্টস কারখানাকে লকডাউনের আওতামুক্ত রাখা হলো না? আরও কথা আছে, বিজিএমইএ সভাপতি এবং সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী যখন বলেন যে, ঢাকায় অবস্থানরত শ্রমিকদের নিয়েই কারখানা চালু করা হবে, বাইরে থাকা শ্রমিকদের লকডাউনের পরে ফিরলেও চলবে। তারপরেও কেন শ্রমিকদের এত ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে ঢাকায় ফিরতে হলো, এক তারিখেই কাজে যোগ দিতে হলো? বিজিএমইএ কি বিষয়টি তদন্ত করবেন?
গার্মেন্টস ইস্যুতে কখনোই সরকার শক্ত অবস্থানে থাকতে পারেনি। মনে আছে, ২০২০ সালে করোনা মহামারির শুরুতে যখন দেশে প্রথম লকডাউন বা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল, তখনো এমন লেজে গোবরে অবস্থা হয়েছিল। আমরা দেখেছিলাম, বগুড়া-ময়মনসিংহ থেকে শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে ঢাকায় রওনা দিয়েছেন। যদিও সরকার তখনো গার্মেন্টস কারখানা খোলার ঘোষণা দেয়নি। আসলে শ্রমিকের কাছে সরকারের ঘোষণার চেয়ে তার মালিকের, তার সুপারভাইজারের নির্দেশ অনেক বেশি জরুরি। তাই সরকার কী বললো, সেদিকে না তাকিয়ে চাকরি বাঁচানোর স্বার্থে জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ওরা কাজে চলে আসে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকরা যে কতটা দায়িত্ববান আর মালিকপক্ষ এবং তাদের তদারককারী সংস্থাগুলো যে কতটা দায়িত্বহীন—এই একটা ঘটনার মধ্য দিয়েই তা প্রকাশিত। কিন্তু সরকার যেহেতু রাষ্ট্রের সবকিছুর অধিকর্তা, তাই আমরা আশা করতেই পারি যে, সরকার নাগরিকদের প্রতি একটু দায়িত্ববান হবে। আশা করতেই পারি যে, সরকার মনে করবে শুধু গার্মেন্টস মালিকরা নয়, শ্রমিকরাও এদেশের মানুষ। এদেশের নাগরিক এবং সকল নাগরিক সমান অধিকার নিয়ে এদেশে বাস করতে পারবে।
জীবন, জীবিকা সব মানুষের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সরকার যখন সেই সমতার দায়িত্ব ভুলে মালিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখনই মানুষ হতাশ হয়।
এই লেখা শুরু করেছিলাম করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা দিয়ে। ১ আগষ্টের প্রতিবেদন বলছে যে, গত দেড় বছরে দেশে করোনায় যত মানুষ মারা গেছে তার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মারা গেছে এই জুলাই মাসে।
জুলাই মাসেই সবচেয়ে ভয়াবহ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে, গ্রামে গঞ্জে। এমন একটা কঠিন সময়ে এসে স্বাস্থ্যবিধির বারোটা বাজিয়ে, লকডাউনের নিয়ম ভেঙে আমরা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলাম। এই কুড়ালের আঘাত যে কতটা ভয়াবহ হবে—তা দেখার জন্য আমাদের খুব বেশিদিন হয়তো অপেক্ষা করতে হবে না।
জ. ই. মামুন ।। প্রধান নির্বাহী সম্পাদক, এটিএন বাংলা