করোনাকালীন জীবন-জীবিকা
প্রায় দেড় বছর ধরে করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে তাণ্ডব চালাচ্ছে। এই সময়ের যে অভিজ্ঞতা, তাতে মোটামুটি স্পষ্ট যে, ভ্যাকসিন গ্রহণ করে এর প্রকোপ কমানো সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ। কিন্তু যতদিন সকলের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, সেই সময় পর্যন্ত নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়ে এই ভাইরাসের ঝুঁকি ঠেকিয়ে রাখতে হবে।
সেই দিক থেকে উন্নত দেশগুলো সুবিধাজনক অবস্থানে আছে কারণ সেসব দেশের সরকার জনগণের জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের পর্যাপ্ত অর্থ পাঠিয়ে দিয়ে তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে ঘরে অবস্থান করতে বলতে পারে। কিন্তু আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দরিদ্র দেশে এই ধরনের সর্বজনীন অর্থ সাহায্য প্রদান প্রায় অসম্ভব, এমনকি দরিদ্রদের সবার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সাহায্য দীর্ঘদিন ধরে দেওয়া সরকারের জন্য মুশকিল, সরকার যতই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করুন না কেন, সে দিক থেকে লকডাউন কিংবা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমিয়ে দিয়ে, জনগণের চলাচল বন্ধ করে করোনার ঝুঁকি কিছুটা কমানো গেলেও জীবিকার ঝুঁকি অনেক বেশি হয়ে যায়।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর গত বছর যখন লকডাউন দেওয়া হয় তখন মানুষ তাদের হাতের যে সঞ্চয় ছিল তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে গেছে এবং দরিদ্রদের সহযোগিতা দিয়ে সরকার তাদেরকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এরপর থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরো স্বাভাবিক অবস্থায় না যাওয়ায় অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, উদ্যোক্তাদের সঞ্চয় কমে এসেছে, আর্থিক সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এদের অনেকে হয়তো এখনো পুরো দরিদ্র হয়ে যাননি কিন্তু তাদের আর্থিক সঙ্গতি কমে এসেছে।
লকডাউন কিংবা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমিয়ে দিয়ে, জনগণের চলাচল বন্ধ করে করোনার ঝুঁকি কিছুটা কমানো গেলেও জীবিকার ঝুঁকি অনেক বেশি হয়ে যায়।
এই অবস্থায় গত মার্চ মাস থেকেই সাময়িক বিরতি দিয়ে দিয়ে যে লকডাউন চলছে তাতে করে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়েছেন বহু মানুষ, যার প্রভাব শুধু যারা উদ্যোক্তা তাদের উপরই পড়ছে না, তাদের সাথে যারা কাজ করেন, তাদের কাঁচামাল সরবরাহ করেন যারা—সব দিকেই এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। এর কারণেই দেখা যাচ্ছে, নিম্ন মধ্যবিত্তের অনেকেই তাদের কাজ হারিয়ে, কিংবা আয় কমে যাওয়ায় জীবিকা নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কম মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহের জন্য টিসিবির দোকান থেকে কেনাকাটা করছেন তারা যা হয়তো আগে করতেন না।
করোনার ঝুঁকি কমাতে লকডাউন প্রয়োজন হলেও এর প্রভাবে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়া সকল মানুষের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয় বলে আর্থিক সংকটে পড়া মানুষের দুর্ভোগ অনেক। তাছাড়া অর্থনৈতিক সংকটে পড়া স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী, উদ্যোক্তা অথবা ব্যবসায়ীরা নিজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উপার্জনে আগ্রহী। তারা অতি দরিদ্র কিংবা দরিদ্র মানুষের মতো সাহায্য নিতে অভ্যস্ত নন। এই কারণেই লকডাউনের সময় কলকারখানার উৎপাদন সরকার চালু রাখার অনুমতি দিয়েছে ঈদুল আযহা পরবর্তী লকডাউনে। প্রথমে কলকারখানা বন্ধের ঘোষণা আসলেও সঙ্গতভাবেই পরবর্তীতে তা ১ আগস্ট থেকে খুলে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ঝুঁকি কিছুটা কমবে। স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টা থেকেই যাচ্ছে।
সার্বিক বিবেচনায় মাস্ক পরা মাস্কের সরবরাহ এবং এই বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক প্রচারণা অব্যাহত রাখা জরুরি। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের জন্য করোনা মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে সারাদেশব্যপী মাস্ক পরার উপরে কঠোর পদক্ষেপ অবলম্বন, সেক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষের কাছে মাস্কসহ পরিচ্ছন্নতার অন্যান্য সামগ্রী পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে।
একই সাথে এই বিষয়ক প্রচারণা অব্যাহত রাখতে হবে।
অর্থনৈতিক সংকটে পড়া স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী, উদ্যোক্তা অথবা ব্যবসায়ীরা নিজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উপার্জনে আগ্রহী। তারা অতি দরিদ্র কিংবা দরিদ্র মানুষের মতো সাহায্য নিতে অভ্যস্ত নন।
লকডাউন বাস্তবায়নের যে কঠোর অবস্থান আমরা দেখি, তা যদি শতভাগ মাস্ক পরানোর ক্ষেত্রে করা হয় তাহলে তা করোনার ঝুঁকি যেমন কমাবে অন্যদিকে অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলবে না।
তবে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করা সম্ভব নয় যেমন সঙ্গতভাবেই রেস্টুরেন্টে সরাসরি খাওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে, যা হয়তো আরও কিছুকাল অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে করোনার স্বাস্থ্যঝুঁকির মাত্রা বেড়ে না যায়। তবে করোনার প্রভাবে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি, তাতে সবচেয়ে বড় ভয় হলো মৃত্যুঝুঁকি। সেটি কমাতে হলে স্বাস্থ্য সেবার আওতা বাড়াতে হবে এবং করোনাসহ এই সময়ে ডেঙ্গুর যে প্রভাব শুরু হয়েছে তা কমাতে যে ধরনের স্বাস্থ্য সেবা দরকার তার সুযোগ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত তৈরি করতে হবে, যাতে চিকিৎসার অভাবে একটি জীবনও ঝরে না যায়।
করোনারভাইরাসের প্রভাবে যেমন জীবনের ঝুঁকি হতে পারে, তেমনি লকডাউনের অর্থনৈতিক প্রভাবেও মারাত্মক বিপর্যয় ঘটতে পারে। তাই স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো এবং জীবিকার ঝুঁকি কমানো—এই দুয়ের মধ্যে ব্যালেন্স করতে হলে দরকার সীমিত পরিসরে লকডাউন (যেমন রেস্টুরেন্ট কিংবা জনসভা বন্ধ রাখা), কিন্তু মাস্ক পরা বাধ্য করার কঠোর কর্মসূচি নেওয়া এবং সেই সাথে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বাড়ানো। আর দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচির বাস্তবায়নে দ্রুততার সাথে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদেরকে বাস্তবতার নিরিখে ভাবতে হবে।
ড. নাজনীন আহমেদ ।। কান্ট্রি ইকোনমিস্ট, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)