সিরিয়ালের নারী বনাম কর্মক্ষেত্রের নারী
বহু বছর টেলিভিশন দেখা হয় না আমার। ২০১৪ সালে একটি দীর্ঘ পেশাগত প্রতিবেদন অনুবাদের কাজ শুরু করি। সেই ক্লান্তিকর কাজের সময় আমার দুই বড় বোনের সাথে বসে কয়েকদিন ‘স্টার জলসা’ ও ‘জি বাংলা’র সিরিয়াল দেখা শুরু করলাম। ‘মেঘের পালক’ নামে একটি সিরিয়াল দিয়ে দেখা শুরু হয়।
‘সুবর্ণলতা’, ‘টাপুর টুপুর’, ‘জল নূপুর’ বা ‘ইষ্টি কুটুম’ থেকে শুরু করে অনেক সিরিয়াল। একমাত্র ‘গানের ওপারে’ ছাড়া কোনটাই শেষ করা হয় না। এছাড়া ‘গোয়েন্দা গিন্নি’ আলাদাভাবে ভালো লেগেছিল, একজন গৃহবধূর সহজাতভাবেই গোয়েন্দা গুণসম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি দেখানোর জন্য।
এখন এখানেই প্রশ্ন, এই যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সব বয়সের নারী দর্শক সন্ধ্যার পর থেকে সিরিয়ালে আচ্ছন্ন থাকেন, এর মূল কারণ কী? ভারতীয় সিরিয়ালগুলোয় পরিবারের নারী সদস্যরা ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’ এই দুই ভাগে ভাগ থাকেন। এক পক্ষ আরেক পক্ষের উপর নিপীড়ন চালান। আমাদের সংস্কৃতিতেও হাজার বছর ধরে বউ-শাশুড়ি, ননদ-ভ্রাতৃবধূ, জায়ে-জায়ে দ্বন্দ্বের বিষয় আছে। কিন্তু এই একুশ শতকেও এসব চলবে? এমন নানা ভাবনার ভেতরেই অন্তর্জালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন হাতে পেলাম।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির মুজনা ফাতিমা আলভি এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মৈত্রেয়ী বরদিয়া দাস রচিত এই প্রতিবেদনের ইংরেজি শিরোনামটির বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘দুই বাংলা: পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ।’
এখন এখানেই প্রশ্ন, এই যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সব বয়সের নারী দর্শক সন্ধ্যার পর থেকে সিরিয়ালে আচ্ছন্ন থাকেন, এর মূল কারণ কী?
প্রতিবেদনের মুখবন্ধে দুই গবেষক বলছেন যে, ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভূ-প্রকৃতির প্রচুর মিল। দেশভাগের পরও দুই বাংলাতেই বহু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও বাংলাদেশে যেখানে ১৯৯০ থেকে তৈরি পোশাক শিল্প এবং স্বাস্থ্য সেবা আর কমিউনিটি সার্ভিসে দ্রুত উন্নয়নের জন্য অসংখ্য তরুণী নারী শ্রম খাতে অংশ নিচ্ছেন (৩৭.৫%), পশ্চিম বাংলায় নারীর শ্রম খাতে অংশগ্রহণ শোচনীয় মাত্রায় কম এবং ভারতের প্রধান সব প্রদেশের ভেতর সর্বনিম্ন (২২.৯%)।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, মা যদি শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ করেন, তবে শিশুর জ্ঞানভিত্তিক বিকাশ এবং স্কুলের পড়াশোনায় অগ্রগতি হয় (ব্লাউ এবং গ্রসবার্গ, ১৯৯২)। নারী কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করলে তার বিয়েও পিছিয়ে যায় এবং সন্তান নেওয়ার বয়স বাড়ে (ফার্নান্দেজ, ২০০৭)।
মুজনা ও মৈত্রেয়ীর গবেষণায় আরও জানা যায়, বাংলাদেশে ১৯৭০-এর দশকে সীমিত আকারে শুরু হওয়া পোশাক শিল্প আশির দশকে দ্রুত হারে বাড়ে এবং নব্বইয়ের দশকে বিকাশ লাভ করে। হীথ ও মোবারকের একটি গবেষণায় (২০১৫) দেখা যায়, ৬০টি গ্রামের ১৪০০ বাড়িতে সমীক্ষা চালিয়ে জানা গেছে, হাঁটা দূরত্বের ভেতরে পোশাক কারখানা আছে এমন গ্রামের মেয়েরা স্কুলে পড়া চালিয়ে যায় এবং তাদের বিয়ে ও সন্তান জন্মদান তুলনামূলক দেরিতে হয়।
অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কৃষি খাতে সবচেয়ে কম নারী নিযুক্ত। দেখা গেছে যে, ১৯৯৯-২০০০ এবং ২০০২-২০০৩ নাগাদ এনজিও এবং সেবা খাতে বছরে ২৯% শতাংশ হারে নারীর কর্মসংস্থান বাড়ে। মাইক্রো ক্রেডিটে নারীর অংশগ্রহণ নারীর উদ্যোক্তামূলক ভূমিকাও বাড়ায় (আফরিন এবং অন্যান্য, ২০০৯)।
পাশাপাশি পশ্চিম বাংলায় স্থানীয় সরকার পরিষদে নারী এবং শিডিউলড কাস্ট ও শিডিউলড ট্রাইব্সদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকায় দেখা গেছে যে, শিডিউলড কাস্ট ও ট্রাইব্স সদস্যরা যেসব এলাকায় স্থানীয় সরকার পরিষদে রয়েছেন, সেসব জায়গায় নারী পরিচালিত পরিবারগুলো তুলনামূলক ভালো আছেন এবং নারীরা যে স্থানীয় সরকার পরিষদের সদস্য, সেসব জায়গায় অপেক্ষাকৃত ভালো পানীয় জল ও ভালো সড়ক বিদ্যমান (এস্থার দ্যুফলো এবং অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ২০০৪)।
মা যদি শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ করেন, তবে শিশুর জ্ঞানভিত্তিক বিকাশ এবং স্কুলের পড়াশোনায় অগ্রগতি হয়। নারী কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করলে তার বিয়েও পিছিয়ে যায় এবং সন্তান নেওয়ার বয়স বাড়ে।
পশ্চিম বাংলায় সড়ক খুব গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, সড়ক নির্মাণ কাজে প্রচুর নারী কাজ পেয়ে থাকেন। ভারতে বাংলাদেশের মতো মাইক্রো-ফাইন্যান্স অত বড় ভূমিকা পালন না করলেও পশ্চিম বাংলায় শুরু হওয়া নারী সমবায় আন্দোলন পরে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। তবে, মেইয়ুক্সের একটি প্রতিবেদনে (১৯৯৫) দেখা যায় যে, এসব সমবায় সমিতির সাফল্য খুব বেশি নয়।
পশ্চিম বাংলায় তাঁত ও বয়ন সমবায় সমিতির উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, অনেক ক্ষেত্রেই এই সমবায় সমিতিগুলো ঠিকঠাক চলে না এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় পরিষদে নারী সদস্য নির্বাচনের মতো সমবায় সমিতিগুলোতেও একজন পুরুষ নিজে সামনে না থেকে স্ত্রীকে এগিয়ে দেন।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিম বাংলায় কৃষি খাতে নারী শ্রমের অংশগ্রহণ কম বলে সামগ্রিক শ্রম খাতেই অংশগ্রহণ কম। তবু সেটি ৪২ শতাংশের কাছাকাছি। সিনহার (২০০৫) এক গবেষণায় দেখা যায় যে, অবকাঠামো ও শিক্ষায় এগিয়ে থাকা পশ্চিম বাংলার চারটি জেলায় নারীর কর্মসংস্থানের হার সবচেয়ে কম।
নারীর কর্মসংস্থানের সাথে সমাজের গভীর দারিদ্র্যেরও কোনো আন্তসম্পর্ক রয়েছে। আবার সারা ভারতে ১৪ শতাংশ হলেও পশ্চিম বাংলায় ২৫ শতাংশের বেশি মুসলিম সম্প্রদায়কে নারীর চলাচলের প্রশ্নে তুলনামূলক রক্ষণশীল মনে হলেও মুর্শিদাবাদ ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোয় নারীর কর্মসংস্থানের হার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
চক্রবর্তী এবং চক্রবর্তী (২০১০)-এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মূলত গৃহভিত্তিক নানা কুটির শিল্পের কাজে আত্ম কর্মসংস্থানের কারণেই এই দুই জেলায় নারীর কর্মসংস্থানের হার বেশি। তবে পাশাপাশি মুসলিম সম্প্রদায়ের নর-নারী উভয়েরই ভালো বেতনের চাকরিতে সুযোগ কম।
এই যে পশ্চিম বাংলার সিরিয়ালে সারাদিনই এক জা অপর জা’কে খারাপ প্রমাণে তার রান্নায় গোপনে বাড়তি লবণ ঢেলে দিচ্ছে, ‘গোয়েন্দা গিন্নি’ থেকে ‘অপরাজিতা অপু’তে প্রতিটা নারীকেই কাজে বের হতে হলেও আগে বিশাল যৌথ পরিবারের ভালো বধূ বা মা হয়ে বের হতে হবে, এসবই একটি সমাজে নারীর কর্মসংস্থানের প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরে।
অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক