রাজনৈতিক দোকান
দেওয়াল লিখন, পোস্টার, ব্যানারে ভরে আছে সারাদেশের পাড়া-মহল্লা, রাস্তাঘাট, বাজার। ভরে আছে ফেসবুক। এরা ভরে আছে ইউটিউবে। এরা সেমিনার করে, আলোচনা সভা করে, মানববন্ধন করে। আর এগুলোতে যোগ দেন মন্ত্রী, সাংসদ, বড় নেতা, মাঝারি নেতা, পাতি নেতা এমনকি সুশীল সমাজের লোকজনও।
এগুলো একেকটা দোকান। লীগ নামের দোকান। গত এক যুগে এমন কত লীগ সংগঠন জন্ম নিল, তার হিসাব জানা না গেলেও আঁচ করা যায় যে, সংখ্যাটা বেশ বড়। একটি অনলাইন পোর্টাল বলেছে, এদের সংখ্যা প্রায় ৩০০। আওয়ামী শিশু লীগ থেকে বয়স্ক লীগ, জননেত্রী পরিষদ থেকে তরকারি লীগ বা আওয়ামী অনলাইন লীগ থেকে বিশ্ব আওয়ামী অনলাইন লীগ—বাহারি সব নামে অসংখ্য দোকান। চাহিদা আর জোগানের তত্ত্ব চিন্তা করলে বলতেই হবে—চাহিদা আছে বলেই বাজারে আসছে এমন সব দোকান।
২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংসদ নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে। তখন থেকেই আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ সংগঠনগুলোকে ‘দোকান’ বলা হচ্ছিল তখন থেকেই। এই দোকানের সর্বশেষ আলোচিত নাম নারী ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরের চাকরিজীবী লীগ। আর এই নতুন দোকানকে সামলাতে না পেরে আওয়ামী লীগের উপ-কমিটি থেকে বহিষ্কৃতও হলেন হেলেনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তার পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো সংগঠন করতে হলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট'-এর অনুমোদন নিতে হয়। তাহলে প্রশ্ন হলো এত যে সংগঠন, এরা কারা? আর এদের কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় নেতারা কেন যেতেন?
প্রচলিত বাংলায় বলতে হয় হেলেনা ‘ধরা খেয়েছেন’। কিন্তু অসংখ্য এমন নেতা বহাল তবিয়তে আছেন। এসব দোকানের কর্মসূচিতে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে প্রধান অতিথি হয়ে যেতেন। ফলে, সংগঠনগুলোর সংবাদ গণমাধ্যমে আসত। মূলত, গণমাধ্যমে আসার কারণে নামসর্বস্ব এসব সংগঠনের নেতারা সরকারি পর্যায় থেকে নানা সুবিধা নিয়েছেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধিপত্য সৃষ্টি করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন পরিচয় দানকারী ওলামা লীগ দীর্ঘদিন নানা প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে দলকে বিব্রত করেছে। এই ওলামা লীগ নেতারা বাল্য বিবাহের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন, জামাত ও হেফাজতের নেতাদের মতো এরাও পহেলা বৈশাখে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো, উলুধ্বনি দেওয়া, শাঁখ বাজানো, মঙ্গল কলস সাজানো, ঢাক-ঢোলের ব্যবহার, মুখোশ পরে শোভাযাত্রাকে হিন্দুয়ানী বলে বিভিন্ন সময় বক্তব্য দিয়েছেন।
দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের মানুষ বিস্ময়ের সাথে দেখেছে এদের কর্মকাণ্ড, তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হয়েছে। ২০১৯ সালে মূল দল থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে বহু বছর পর। বলা হয়েছে, আওয়ামী ওলামা লীগের কোনো সম্পর্ক নেই আওয়ামী লীগের।
হেলেনা জাহাঙ্গীরের কাণ্ডের পর দলের নেতারা আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন—গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আটটি সহযোগী সংগঠন রয়েছে আওয়ামী লীগের। এর বাইরে দুটি সংগঠন শ্রমিক লীগ ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত। সহযোগী আটটি সংগঠন হলো—মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, তাঁতী লীগ, যুব মহিলা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইন পরিষদ ও মৎস্যজীবী লীগ। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তার পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো সংগঠন করতে হলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট'-এর অনুমোদন নিতে হয়।
তাহলে প্রশ্ন হলো এত যে সংগঠন, এরা কারা? আর এদের কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় নেতারা কেন যেতেন? এখন পর্যন্ত দল থেকে ভুঁইফোড় সংগঠন করার কারণে কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানা নেই।
হেলেনা কাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা টেলিভিশন টক শো’তে এসে বলেছেন তারা পুলিশ ও প্রশাসনকে বলেছেন, এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু দল ব্যবস্থা নিল না কেন তাদের বিরুদ্ধে যারা দলের নেতা-নেত্রী পরিচয়ে এদের কর্মসূচিতে গেছেন?
প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সম্প্রতি তার গৌরবোজ্জ্বল ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছে কিছুদিন আগে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি নানা লড়াই, সংগ্রাম, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখন টানা তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধুর দল অনেক ঝড়ঝাপটার সাক্ষী। বঙ্গবন্ধু কন্যা দৃঢ়তার সঙ্গে পরিচালনা করে দলকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন এবং দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলেছেন।
ক্ষমতার লোভে, রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে দলকে কব্জায় আনতে দলের ভেতরেই কাজ করছে বিভিন্ন মহল। ত্যাগী সাধারণ কর্মীদের পদ ও পদবী বঞ্চিত করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে চলেছেন কিছু নেতা।
কিন্তু গত ১২টি বছরে এই দল বিশেষ করে দলীয় সভানেত্রীর বাইরে নানা স্তরের নেতারা এবং কর্মীরা যতটা ক্ষমতা চর্চা করেছেন, ততটা রাজনৈতিক চর্চা করেননি। দলের ভেতরে যেন গভীরতর অসুখ। বিভিন্ন স্তরে, বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ে বিভিন্ন দল-উপদলের বিভক্তি এমন পর্যায়ে গেছে যে এখন জেলা উপজেলায়, পাড়া-মহল্লায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ, খুনাখুনি।
ঘরে ঘরে বিবাদ। চিহ্নিত সমাজ বিরোধীরা, বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা দলে ও দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে জায়গা করে নিয়েছেন বলে খোদ দল থেকেই সমালোচনা উঠছে। যুবলীগের ক্যাসিনো কাণ্ড, বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি ও সহিংস উগ্র আচরণ মানুষের মুখে মুখে।
দলের ভেতরকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, আর কিছু এমপি মন্ত্রীর ব্যক্তিতন্ত্র এমন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যেন দলের ভেতর শুধু সিন্ডিকেট আর সিন্ডিকেট। এই অরাজনৈতিক চর্চার সুযোগেই দলের নামে শত শত ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে উঠেছে। অসংখ্য হেলেনা জাহাঙ্গীরের আবির্ভাব ঘটেছে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে এরা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।
এমন করে যেনতেন ভাবে যা তা নামে ক্ষমতাসীন দলের নামে সংগঠন গড়ে ওঠা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ক্ষমতার লোভে, রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে দলকে কব্জায় আনতে দলের ভেতরেই কাজ করছে বিভিন্ন মহল। ত্যাগী সাধারণ কর্মীদের পদ ও পদবী বঞ্চিত করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে চলেছেন কিছু নেতা।
এ ধরনের সংগঠন সব দলের গঠনতন্ত্র বিরোধী। এগুলোকে থামাতে হবে। না থামালে নির্লজ্জ ক্ষমতালিপ্সু গ্রুপগুলো আরও জোরদার হবে। এতে করে প্রতিপক্ষকে সন্ত্রস্ত করে পেশীশক্তির আস্ফালনে বিশ্বাসী একেকটা গোষ্ঠীতে পরিণত হবে দলের নেতা-কর্মীদের অনেকে।
রাজনৈতিক সংঘর্ষের যে সংস্কৃতি বহু বছরে গড়ে উঠেছে তাকে আরও পল্লবিত করছে, বিভিন্ন জনপদে টাউট বাটপার সৃষ্টি করছে এসব সংগঠন। এই ক্ষমতার চর্চা, এই আধিপত্যবাদের মহড়ায়, এই সুযোগসন্ধানীদের কারণেই নিয়মিত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন জনপদে। তাতে দলেরই অসংখ্য কর্মী খুন হয়েছেন, কিন্তু তাদের কেউই কোনো সুবিচার পাননি। রাজনীতিকে কেন্দ্র করে যে হিংসার পরিবেশ, চাঁদাবাজির যে সংস্কৃতি সেটা থামাতে হলে এই লীগ নামধারী, বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী নামধারী সংগঠনগুলোর ইতি টানার কোনো বিকল্প নেই।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি