গণপরিবহনে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও সংক্রমণ
বাংলাদেশ এখন করোনা মহামারির এক সংকটকাল অতিক্রম করছে। প্রতিদিনই শনাক্ত ও মৃত্যুর নতুন রেকর্ডে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। এরই মধ্যে এসেছে পবিত্র ঈদুল আজহা। এই উপলক্ষে সরকার লকডাউন শিথিল করেছে। চালু হয়েছে গণপরিবহন। এই সময়টাতে অনেকেই তাদের কর্মস্থল থেকে আপনজনের কাছে ফিরে যাবেন আবার উৎসব পালন শেষে কর্মস্থলে ফিরে আসবেন।
মানুষ থেকে মানুষে হাঁচি, কাশি, কথা বলা এমনকি স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায়। গণপরিবহনে নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক লোকের সাথে আপনাকে একটা লম্বা সময় বসে থাকতে হবে। আবার আপনার সিটে এর আগে অনেকে বসেছেন; আপনার সিটের হাতলে আপনার আগে অনেক হাত রেখেছেন। ফলে গণপরিবহন করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এই ঈদুল আজহার ছুটিতে গণপরিবহন ব্যবহার করায় অনেকেই নতুন করে আক্রান্ত হবেন এবং আক্রান্তরা অন্যকে সংক্রমিত করবেন।
বিভিন্ন যাতায়াত মাধ্যমে করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার তুলনামূলক ঝুঁকি নিয়ে সম্প্রতি একটি চমৎকার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ জন গবেষক ভারতের বিভিন্ন পরিবহন ব্যবস্থার উপর এই গবেষণাটি করেছেন।
এই ঈদুল আজহার ছুটিতে গণপরিবহন ব্যবহার করায় অনেকেই নতুন করে আক্রান্ত হবেন এবং আক্রান্তরা অন্যকে সংক্রমিত করবেন।
গবেষকদ্বয় অটোরিকশা, নন-এসি ট্যাক্সি, এসি ট্যাক্সি এবং নন-এসি বাস এই ৪ ধরনের পরিবহনের মধ্যে তুলনা করেছেন। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ধরে নেওয়া হয়েছে যানবাহনের মধ্যে একজন যাত্রী করোনা পজিটিভ।
গবেষণার ফলাফলটি সংক্ষেপে তুলে ধরছি—
১) এসি ট্যাক্সির তুলনায় নন-এসি ট্যাক্সিতে জানালা খোলা অবস্থায় ভ্রমণ করলে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি ২৫০ ভাগের ১ ভাগে নেমে আসে।
২) অটোরিকশায় ভ্রমণের তুলনায় নন-এসি ট্যাক্সিতে ভ্রমণ করলে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি ৮৬ গুণ বেড়ে যায় এবং এসি ট্যাক্সির ক্ষেত্রে তা ৩০০ গুণ বেড়ে যায়।
৩) ৪০ সিটের একটি বাসের একজন যাত্রী বাস থামা অবস্থায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি অটোরিকশার একজন যাত্রীর তুলনায় ৭২ গুণ বেশি।
৪) সব যানবাহনেই চলন্ত অবস্থায় এবং গতি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কমে।
৫) যে যানবাহনের বায়ু চলাচল যত ভালো সেখানে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তত কম। অটোরিকশায় সবাই খুব কাছাকাছি বসলেও সেখানে বায়ু চলাচল বেশি থাকায় সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
সুতরাং, গবেষণামতে, তুলনামূলক নিরাপদ যানবাহনের ক্রম তালিকা হলো- অটোরিকশা > বাস > নন-এসি ট্যাক্সি > এসি ট্যাক্সি।
৫ নম্বর ফলাফলটি অন্যান্য গবেষণাতেও পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, এসি যানবাহনে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে এবং নন-এসি যানবাহনে ঝুঁকি কমে। নন-এসির মধ্যে যেসব যানবাহনে বায়ু চলাচল যত বেশি সেখানে সংক্রমণের ঝুঁকিও কম। তবে বিমানের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম আছে।
যাত্রাকালীন সময়ে মুখ থেকে মাস্ক খোলা যাবে না। গবেষণায় এসেছে, এন-৯৫ মাস্ক, সার্জিক্যাল মাস্ক এবং কাপড়ের তৈরি মাস্ক যথাক্রমে ৯৭%, ৮৬% এবং ৬৭% সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম।
বিমানের জানালা কখনো খোলা যায় না, এসি চালু থাকে সবসময় এরপরেও সেখানে এসি বাস বা ট্রেনের তুলনায় সংক্রমণের ঝুঁকি কম পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও রোমানিয়ার গবেষকরা আলাদা আলাদা কিছু গবেষণায়। বিমানের ভেতরে হেপা ফিল্টারের মাধ্যমে বায়ু চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয় ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি অন্যান্য এসি যানবাহনের তুলনায় কিছুটা কম। তবে যাত্রার সময় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকিও বাড়ে।
আপনি যে যানবাহনেই ভ্রমণ করেন না কেন যাত্রাকালীন সময়ে আপনাকে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।
ক) কোনো প্রকার অসুস্থতা নিয়ে ভ্রমণ করবেন না।
খ) যাত্রাকালীন সময়ে মুখ থেকে মাস্ক খোলা যাবে না। গবেষণায় এসেছে, এন-৯৫ মাস্ক, সার্জিক্যাল মাস্ক এবং কাপড়ের তৈরি মাস্ক যথাক্রমে ৯৭%, ৮৬% এবং ৬৭% সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম। ছোট কোনো গাড়ি ভাড়া করে সপরিবারে ভ্রমণ করলেও যাত্রার পুরোটা সময় মাস্ক পরে থাকুন। কারণ, এই গাড়ি আপনার আগে কোনো সংক্রমিত ব্যক্তিকে বহন করেছে কি না বা চালক নিজে আক্রান্ত কি না আপনি জানেন না।
গ) ট্রেনের ক্ষেত্রে মুখোমুখি সিট পরিহার করুন।
ঘ) এসি যানবাহন এড়িয়ে চলুন।
ঙ) যানবাহনের জানালা সব সময় খোলা রাখুন।
চ) সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এক সিট খালি রেখে বসুন।
ছ) ভিড় এড়িয়ে চলুন।
জ) অতিরিক্ত মাস্ক সঙ্গে রাখুন।
ঝ) ঘন ঘন সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন। জীবাণুনাশক (স্যানিটাইজার) ব্যবহার করুন।
যাত্রী এবং সরকারের পাশাপাশি পরিবহন মালিকদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। যাত্রীরা সবাই সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মানছে কি না সেটা নিশ্চিত করা, প্রতিবার যাত্রা শেষে, যাত্রা বিরতির সময় যানবাহনে জীবাণুনাশক দেওয়া এবং যানবাহনে অতিরিক্ত মাস্ক রাখা, যাতে প্রয়োজনে কোনো যাত্রীকে তা দেওয়া যায়।
গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে যেন উৎসবের উজ্জ্বল দিনগুলো কালো বিষাদে ছেয়ে না যায় সেই দিকে সবার নজর দিতে হবে।
ডা. নাজিরুম মুবিন ।। চিকিৎসক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল