অপ্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনা
অরাজনৈতিক নাগরিক সমাজ একদা দেশের শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল সামরিক বাহিনীর সহায়তায়। ‘সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নামধারী সেই সরকার রাজনীতিকদের তুচ্ছ করেছিল। এই অরাজনৈতিক মানুষদের রাজনীতির বলি হয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০০১ থেকে বিএনপি-জামাত সরকারের দুর্নীতি ও দুঃশাসনে বীতশ্রদ্ধ মানুষ যখন আন্দোলন সংগ্রাম করে গণতান্ত্রিক সুশাসনের প্রত্যাশা করছিল তখন দেশে জারি হয় জরুরি আইন, ক্ষমতায় বসে ফখরুদ্দিন-মঈন উদ্দিনের প্রচ্ছন্ন সামরিক শাসন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ক্ষমতা নিয়ে সে বছরের ১৬ জুলাই ভোরে সেনা সমর্থিত তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধানমন্ডির বাসা—সুধা সদন থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে। শেখ হাসিনাকে মানুষ মুক্ত করে এনেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রাণ ভরে ভোট দিয়েছে এবং এখনো তিনি ক্ষমতায় আছেন টানা তৃতীয়বারের মতো।
আমরা সবাই জানি সময় থেমে থাকে না। ক্ষণে ক্ষণে তা অতীত হয়ে যায়। এই মুহূর্তটাকে হাতের মুঠোয় ধরতে গেলেই দেখা যায় সে অতীত হয়ে গিয়েছে। তাই বর্তমান কালটিকে বোঝার জন্য অতীতকে জানার প্রয়োজন বেশি। অতীত নিছক অতীত নয়, তার সুদীর্ঘ প্রেক্ষাপটেই ভবিষ্যতের সন্ধান দাতা। এই ১৬ জুলাইও অতীত হয়েছে, কিন্তু রাজনীতির ইতিহাসে ঠিকই থেকে যাবে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে।
শেখ হাসিনাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তাই অতীতের কথা উঠে আসে। উঠে আসে তার পিতা, বাঙালির জনকের কথা। বাংলার সমাজে সৌহার্দ্য আর সহমর্মিতার পাশাপাশি সংঘাতের ইতিহাসও দীর্ঘ। আমাদের বিভাজনের রাজনীতি আছে, আমাদের জাতীয়তাবাদের মধ্যে সংকীর্ণ আঞ্চলিকতা, জাতিভেদ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আছে। তবুও বহুত্ববাদের ভেতরকার অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে সরিয়ে সংহতি ও সমন্বয়ের এক বৃহৎ চিত্র এই সমাজে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আজ তার কন্যার হাতে জাতির নেতৃত্ব।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ক্ষমতা নিয়ে সে বছরের ১৬ জুলাই ভোরে সেনা সমর্থিত তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধানমন্ডির বাসা—সুধা সদন থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে।
শেখ হাসিনা তার এক লেখায় লিখেছেন, ‘পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আমি এই আদর্শ নিয়ে জনগণের সেবক হিসেবে রাজনীতি করে যাচ্ছি।’ তিনি যথার্থই বলেছেন যে, তার চলার পথটি বরাবরই বন্ধুর। দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনতে তাকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনে দেশকে আরও বেশি করে ঝাপটে ধরলো পাকিস্তান প্রেমীরা, যেমনটা ঘটেছিল ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে। তারপর ২০০৮ এর নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এদেশের মানুষকে সাথে নিয়ে শেখ হাসিনা ক্রমাগত লড়াই করেছেন। এই লড়াই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে, উদার আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার। কিন্তু লড়াই আর স্বপ্ন তো আরও থাকে, যে স্বপ্ন ছিল জাতির জনকেরও—বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়া যেন আত্মনির্ভর এক জাতির পরিচয় দিতে পারি আমরা।
তার শাসনামলে গত ১৩ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির স্থিতিশীলতা এসেছে, মানুষের মনে একটা উন্নয়ন স্পৃহা তৈরি হয়েছে। তাই যে বিশ্বব্যাংক প্রায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এদেশ থেকে, সে নিজ থেকেই সেই দেশকে দারিদ্র্য বিমোচনের রোল মডেল স্বীকৃতি দিয়ে ফিরে আসে উন্নয়নের বড় অংশীদার হতে।
মানুষের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা। কিন্তু এ মুহূর্তে সবচেয়ে অনিরাপদ শেখ হাসিনা নিজে। যারা বাংলাদেশকে পেছনে দেখতে চায়, সাম্প্রদায়িকতা দেখতে চায়, জঙ্গি দেখতে চায় তারা সকলে একজোট তাকে হত্যা করার জন্য। কারণ শেখ হাসিনা মানে যুদ্ধাপরাধের বিচার, শেখ হাসিনা মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় চলা দেশ, শেখ হাসিনা মানে উদার ও প্রগতির বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা মানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাথা উঁচু করে চলা বাংলাদেশ।
একটা বড় প্রশ্ন আছে। শেখ হাসিনা যা চান, তা কি বুঝতে পারে তার দল? এক দিকে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন, যার মাধ্যমে এক নতুন রাষ্ট্রীয় পরিচয় পাবে এদেশের মানুষ। অন্যদিকে, তার দল সেই পরিচয়কে বড় করে তুলতে কতটা বৃহত্তর পরিসরের রাজনীতি কি করতে পারছে? নিজেদের মধ্যে বিবাদ, এলাকায় আধিপত্য দেওয়ার মহড়া যদি চলতে থাকে তবে ক্রমেই ক্ষুদ্র হতে তাকে বৃত্তটি। আশা করবো দলের নানা স্তরে এই বোধটি আসবে।
শেখ হাসিনা মানে যুদ্ধাপরাধের বিচার, শেখ হাসিনা মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় চলা দেশ, শেখ হাসিনা মানে উদার ও প্রগতির বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা মানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাথা উঁচু করে চলা বাংলাদেশ।
তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে চ্যালেঞ্জ বহুমুখী। নিষ্ঠা, দৃঢ়তার প্রতীক তিনি দলেরও প্রধান। বহুবার বলেছেন, ‘বাবার মতো আমাকে যদি জীবন উৎসর্গ করতে হয়, আমি তা করতে প্রস্তুত।’ কিন্তু বাংলাদেশতো তাকে হারাতে চায় না। এ মুহূর্তে তার কোনো বিকল্প নেই। সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভরসার কেন্দ্রবিন্দু শেখ হাসিনা ধৈর্য ও সাহসের যেমন প্রতিমূর্তি, তেমনি দেশ ও জাতির ভরসা।
শেখ হাসিনা বড় স্বপ্ন দেখছেন ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার শুরু থেকে। এখন উন্নয়নের যেসব কাজ হচ্ছে, এদেশ এমন করে কখনো দেখেনি। নিজস্ব অর্থে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের যে লড়াই তিনি শুরু করেছেন, তা আরেকবার তার পিতাকে আলোচনার সামনে নিয়ে আসে।
বাঙালির সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পাবে। শেখ হাসিনার পিতা আমাদের সেই বড় স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন। আর এখনকার স্বপ্ন উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সেই স্বপ্নের পথে আমাদের নিয়ে হাঁটছেন শেখ হাসিনা।
রাজনীতির লোকজন ভুল-ত্রুটি করেন অজস্র, কিন্তু সেই ভুল-ত্রুটির মধ্য দিয়েই তারা শিক্ষিত হতে থাকেন, নিজেকে প্রস্তুত করে চলেন। শেখ হাসিনাও তাই করেছেন। তাকে যারা জেলে পুড়েছিল তারা আজ পলাতক।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং অর্থনীতি, দুইয়ের সাফল্যই নির্ভর করছে রাষ্ট্রীয় শাসন কতটা ভালোভাবে চলছে তার উপর। কেন্দ্র আর প্রান্তের মধ্যে সুযোগ, সুবিধা আর আর্থিক অসাম্যর শিকড় বহু যুগ ধরে বিস্তৃত। বিস্তৃত আছে মানুষে মানুষে ব্যাপক বৈষম্য। উন্নত শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি আমরা। এ সময়ে যদি বৈষম্য বাড়তে থাকে, তা হলে কিন্তু রাজনৈতিক শৃঙ্খলাও আঘাতপ্রাপ্ত হবে।
প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। তবে ভরসা আছে। এদেশে গণতন্ত্রের শক্তির একটা নিজস্ব চাপ রয়েছে। চাপ আছে শান্তি আর স্থিতিশীলতা বজায় রাখারও। তাই পেট্রল বোমা দিয়ে মাসের পর মাস সহিংসতা করে, মানুষকে পুড়িয়ে যেমন প্রবৃদ্ধির চাকা থামানো যায়নি, তেমনি বিদেশি হত্যা করে, সাম্প্রদায়িক বিভেদের প্রচেষ্টাকেও ব্যর্থ করেছে মানুষই।
দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, আবার প্রগতির পথে ফিরেছে। এই অন্তর্নিহিত শক্তি আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা আর সেই ভরসা তৈরি করেছেন, করে চলেছেন—শেখ হাসিনা।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি