ভুলতার আগুনে মিথ্যার উত্তাপ বেশি
সামনে আগুন। পেছনে আগুন। আশেপাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। বের হওয়ার মাত্র দুটি সিঁড়ি। এই পথেই মানুষ বাঁচার আকুতি নিয়ে দৌড়ে মূল দরজার সামনে এলো। দেখল দরজা বন্ধ। এর পরের মানবিক বিপর্যয়ের গল্পটি চোখে দেখার নয়। অনুভবের। বাংলাদেশের মানুষের জন্যে এর পরের গল্প চিন্তা করে নেওয়া খুব সহজ, খুবই পরিষ্কার। কারণ এখানে যেকোনো কারখানায় দুর্ঘটনার পর বন্ধ হয়ে যায় শ্রমিকের পথ। এই অশ্লীলতা এখন নিয়মের মতো।
ভুলতার জুস কারখানায় আগুনের রাত থেকেই ভাবছিলাম বারবার কেন এমন হয়? এমন তো হওয়ার কথা নয়। যারা দরজা বন্ধ করে দেন তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েও চিন্তা করে দেখেছি। দুর্গত মানুষের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার কোনো লাভ খুঁজে পাইনি। অবশেষ এক মাঠের রিপোর্টার কিছু তথ্য দিলেন। প্রতিটি দুর্ঘটনার শুরুতে মনে করা হয় এটি এমন কিছু নয়। শ্রমিকদের বানানো হট্টগোল। দরজা বন্ধ না করলে লুটপাট হবে। তাই শোরগোল শুনলেই নিরাপত্তা কর্মীদের নিচের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া থাকে।
বিস্মিত হলাম। কিন্তু মাঠের প্রতিবেদনের তথ্য অবিশ্বাস করতে পারলাম না। কারণ এখানে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার একটা যুক্তি অন্তত পাওয়া যায়। কিন্তু আমার বিস্ময়ের কারণ, এটা কী কোনো যুক্তি হতে পারে? এতো অবিশ্বাস! মালিক যদি শুরুতেই শ্রমিককে প্রতিপক্ষ ভাবে, তার মাথায় যদি সারাক্ষণ থাকে, শ্রমিক কারখানা লুট করবে, তাহলে এর চেয়ে বড় বিস্ময় আর কী হতে পারে? আরও বড় প্রশ্ন জাগে মনে, বারবার যেহেতু একই রকম ঘটনা ঘটছে, এটা কি তাহলে গোটা দেশের মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের চিত্র?
মালিক যদি শুরুতেই শ্রমিককে প্রতিপক্ষ ভাবে, তার মাথায় যদি সারাক্ষণ থাকে, শ্রমিক কারখানা লুট করবে, তাহলে এর চেয়ে বড় বিস্ময় আর কী হতে পারে?
প্রায় প্রতিদিনই কারখানায় নানান নিয়ম বা অনিয়মের তথ্য পাই। শ্রমিকের বেতন না দিয়ে কর্তৃপক্ষ কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে, এমন নজির মুড়ি মুড়কির মতো। প্রায় প্রতিদিনই দেখছি সারা মাস পরিশ্রম করে শ্রমিক বেতনের জন্যে রাস্তায় দাঁড়াচ্ছেন। সড়ক অবরোধ করছেন। কখনো কখনো পাওনা বেতনের অর্ধেক নিয়ে মাঠ থেকে সরে যাচ্ছেন। ভাবছেন যা পেলেন তাই লাভ। এত বঞ্চনার পরেও কখনো শুনিনি শ্রমিক তার কাজের জায়গা নষ্ট করেছেন। গত ২০ বছরে কোনো শ্রমিককে কারখানায় গণ্ডগোল লাগিয়ে লুটপাটের তথ্য পাইনি।
ভুলতার কারখানার দুর্ঘটনায় দরজা বন্ধের নৃশংসতাসহ আরও সব ভয়াবহ তথ্য দিচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত যতজন নিখোঁজ শ্রমিকের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে তাদের অনেকেরই বয়স ১৮ এর নিচে। গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা তার ‘কত শিশু কাজ করতো ওই মৃত্যুকূপে’ শিরোনামের লেখায় কর্মরত ১২জন শিশুর নাম প্রকাশ করেছেন। যাদের বয়স ১৮ এর নিচে। গওহার নঈম ওয়ারার ওই গবেষণা ছিল তাৎক্ষণিক। নিশ্চয়ই আরও বিস্তারিত তিনি জানাবেন। অথচ কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই বলছিলেন, কারখানার কোনো শ্রমিকের বয়স ১৮ এর নিচে না। তাদের স্বজনেরা বয়স লুকাচ্ছে। একজন স্বজনহারা মানুষ হাহাকার করে কখনো মিথ্যাচার করে? ওই মুহূর্তে তার দরকার স্বজনের মরদেহ। পৃথিবীর কোনো কূটনীতি তখন তাকে স্পর্শ করার কথা নয়।
গত কয়েক বছর ধরে শিশুশ্রমের অপসংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। আইন করে কারখানা মালিকদের জানিয়ে দিয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে সেই আইন প্রতিষ্ঠায়। এতে সহায়তা করছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংগঠন। সবার সার্বিক পরিশ্রমে বাংলাদেশকে শিশুশ্রম রোধ বেশ খানিকটা সফল ভাবা হচ্ছিল দেশের বাইরেও। কিন্তু এই দুর্ঘটনায় সেই সাফল্যতো কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হলো।
হত্যা মামলা দায়েরের পর গ্রেপ্তার হয়েছেন কারখানার মালিক আবুল হাসেম। আগুনের পরপরই যিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এটি একটি নিছক দুর্ঘটনা। আমি কি গিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছি?’ গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, প্রকারান্তরে আগুন তিনিই ধরিয়েছেন। কারণ আগুন জ্বলেছে ২২ ঘণ্টা। খাদ্য পণ্য আর এর ভোজ্য তেলের আগুন এতক্ষণ থাকার কথা নয়। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা শুরু থেকেই এমন সন্দেহের কথা বলছিলেন।
এখন পর্যন্ত যতজন নিখোঁজ শ্রমিকের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে তাদের অনেকেরই বয়স ১৮ এর নিচে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আরও সন্দেহ করেন, ভবনে অন্য যেকোনো রাসায়নিক মজুদ ছিল। যার প্রভাবে প্রায় নিভে যাওয়ার পরেও আরও এক দফা আগুন জ্বলে ওঠে। তাদের এই সন্দেহ এরমধ্যে সত্যের কাছাকাছি চলে গেছে। কারণ নারায়ণগঞ্জের কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ পরিষ্কার বলে দিয়েছে, তারা বারবার চেষ্টা করেও কারখানার ভেতরে ঢুকতে পারেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তাদের যেতে দেওয়া হলো না?
জনাব হাসেম, এখানে কার প্রভাব ছিল, পরিদর্শকদের যেতে দিলে কি আপত্তিকর তথ্য বের হতো? এই যে তথ্য গোপন করলেন, এটা কি নিজ হাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেয়ে কোনো অংশে কম? বরং এটাতো এখন ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড হয়ে দাঁড়াল।
এদিকে কেন্দ্রীয় কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর বলছে, দুর্ঘটনায় পড়া কারখানায় কাজের পরিবেশ শ্রমিকবান্ধব ছিল না। বিষয়টি জানানো হলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে ৩০ জুন আদালতে একটি মামলা দায়ের হয়। কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন এই অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো গণমাধ্যমকে জানালে কী হতো? মামলা করলেই কি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? কর্তৃপক্ষের এই স্বেচ্ছাচারের গল্প সরকারের কাছে যাওয়ার জন্যে গণমাধ্যমের চেয়ে শক্তিশালী পথ আর কী আছে? একই প্রশ্ন করি, নারায়ণগঞ্জের কারখানা পরিদর্শকের কাছে?
ভুলতার কারখানায় ৫২ জনের মৃত্যুর পর বের হচ্ছে শত শত তথ্য। অনেকটা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনের মতো। এটা এখন মানুষকে শুধু আবেগ তাড়িত করবে। কোনো উপকার করবে না। অথচ এসব তথ্য আগে প্রচার হলে এই দুর্ঘটনা ঠেকানোর সম্ভাবনা থাকত। কিন্তু গণমাধ্যমগুলো জানতে পারেনি। তথ্য পাওয়ারও কথা নয়। কারণ এটা চার দেওয়ালের ভেতরের তথ্য। সেখানে তথ্য দেওয়ার কোনো পদ্ধতি নেই। বরং সেখানে কয়েক পরতে তথ্য লুকোনোর পদ্ধতি সক্রিয়।
সাংবাদিক কোনো সূত্রে এ খবর পেল সেটাও তার পক্ষে নিশ্চিত করা কঠিন। তবু নিজের কাজের জায়গায় দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি, মাঠের সাংবাদিক এই তথ্য পেলে প্রচার নিয়ে যুদ্ধ করার সুযোগটা পেত।
পলাশ আহসান ।। গণমাধ্যমকর্মী