জনপ্রতিনিধিরা কি মর্যাদা হারাচ্ছেন?
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতিবিদ তথা জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্রের আইনকানুন, নীতি কৌশল আর উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করবেন, আর জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে জনপ্রশাসনের সদস্যরা জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শ ও মতামতকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নয়নকে নিশ্চিত করবেন-এটিই তো প্রত্যাশিত।
একটি সরকার কাঠামোতে রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি আর আমলাতন্ত্রের সদস্যরা কোনোভাবেই একে অন্যের প্রতিপক্ষ নয় বরং পরিপূরক। তাহলে জাতীয় সংসদসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সংসদ সদস্যদের পদমর্যাদা আর আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা নিয়ে এতো হৈচৈ কেন? অর্থনীতির ভারসাম্য নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলেন, সম্পদ হস্তান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কেউ গরিব আবার কেউবা ধনী হয়। অর্থনীতির এই ভারসাম্য নীতিকে কোনোভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতিতেও প্রতিফলিত হচ্ছে? জনপ্রতিনিধি আর রাজনীতিবিদরা কি এমন কিছু হারাচ্ছেন যা আমলাতন্ত্রকে অতিমাত্রায় শক্তিশালী করে তুলছে?
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতা হারাচ্ছেন আর আমলারা ক্ষমতা অর্জন করছেন, এমন ঘটনার স্বপক্ষে আমার কাছে কোনো দালিলিক প্রমাণ বা পরিসংখ্যান নেই তবে নিবিড় কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। একজন ইউপি চেয়ারম্যান কিছুদিন আগে তার উপজেলার ইউএনও বা জেলার ডিসি মহোদয়ের সাথে আমার কোনো সংযোগ আছে কি না জানতে চাইলেন। এলাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে সরকারি এই কর্মকর্তাদের অনুরোধ করার জন্য সহযোগিতা চাইলেন। প্রত্যুত্তরে উপজেলা চেয়ারম্যান বা সংসদ সদস্য মহোদয়ের সাথে যোগাযোগের প্রস্তাব দিলে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে আমার প্রস্তাবনাকে নাকচ করে দিলেন। স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘এরা ক্ষমতাহীন। ডিসি, ইউএনওকে বলতে না পারলে কোনো কাজ হবে না।’
আবার এক সংসদ সদস্যের সাথে আলাপ হলে তিনি বললেন, ‘কোনো রকম মান সম্মান নিয়ে বেঁচে আছি, দেখো কোনোভাবে ইউএনও বা ডিসি সাহেবকে বলা যায় কি না!’ এক উপজেলা চেয়ারম্যানের অভিমত, ‘আমরা তো নিয়ম রক্ষার পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউএনও সাহেব রাজি না হলে কাজ হবে না।’ এসব ঘটনাবলী কি প্রমাণ করে না গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের পরিবর্তে আমলারাই অতিমাত্রায় শক্তিশালী হয়ে উঠছেন?
জনগণের দুর্যোগে, বিপদে আপদে রাজনীতিবিদরাই কাছে থাকেন, সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা করা, কোনোভাবেই উন্নয়ন বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ নয়।
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সাংসদ তোফায়েল আহমেদ সংসদে দাঁড়িয়ে জেলায় জেলায় সচিবদের দায়িত্ব পালন নিয়ে যে আবেগঘন বক্তব্য রাখলেন তা কোনোভাবেই কি কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকারের চিত্র হতে পারে? জনগণের সাথে সদা সম্পৃক্ত, এলাকার সমস্যা, সুবিধা-অসুবিধা আর সুখ-দুঃখের সাথী জনপ্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে সচিব আর প্রশাসনের আমলারাই যে উন্নয়ন আর থোক বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন—তোফায়েলের আহমেদের বক্তব্যে সেটি স্পষ্ট।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য মাহবুবুল আলম হানিফ এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জনগণের দুর্যোগে, বিপদে আপদে রাজনীতিবিদরাই কাছে থাকেন, সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা করা, কোনোভাবেই উন্নয়ন বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ নয়।’ হানিফের বক্তব্যেও আমলাদের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষের চিত্রই ফুটে উঠেছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারাও যদি আমলাদের ভূমিকাকে অযাচিত মনে করেন তাহলে আমলারা কি কোনো অনৈতিক, দৈবিক ক্ষমতা উপভোগ করছেন? একটি শক্তিশালী দক্ষ আমলাতন্ত্র তো রাষ্ট্রের অপরিহার্য অনুষঙ্গ, এটিকে যথাযথ উপায়ে ব্যবহার করতে রাজনীতিকরা কি ব্যর্থ হচ্ছে? রাজনীতিকদের কোনো অজ্ঞাত দুর্বলতা কি আমলাতন্ত্রকেও অনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তুলছে?
মাত্র অর্ধশতাব্দীর বাংলাদেশে অর্ধেকেরও বেশি সময় দেশটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামরিক স্বৈরাচারদের মাধ্যমে শাসিত হয়েছে। একনায়ক এরশাদের আমলে এদেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু হয়েছিল। সৌভাগ্যজনকভাবে এই একনায়কের আমলের উপজেলা পদ্ধতিকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। সেই সময়ে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের কাছে উপজেলার কর্মকর্তাদের কাজের জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা ছিল। পরিষদের সভায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুধুমাত্র সাচিবিক দায়িত্ব পালন করতেন।
গণতন্ত্রের সংকটে যেমন রাজনীতিকরাই ভরসা, তেমনি জনপ্রতিনিধিরাই আমজনতার সুখ দুঃখের আশ্রয়স্থল।
তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় অভিমত হলো, ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী, সংসদ সদস্যদের পদমর্যাদা সচিবদের উপরে। মানে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে বসার জন্য অন্যকিছুর জন্য নয়।’ একজন দক্ষ আমলা যখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পদমর্যাদা নিয়ে এমন ধারণা পোষণ করেন, তখন গণতন্ত্রের মর্যাদা আর সৌন্দর্য নিয়ে সংশয় জাগলে আমার মতো আমজনতার দোষ কোথায়? এরশাদ আমলে সকালের মন্ত্রী বিকেলে হতেন আমজনতা, গণতন্ত্রের চরম সংকটেও জনপ্রতিনিধির মর্যাদায় এমন আকাল দেখিনি। এই দুঃসময়ের জন্য কি রাজনীতিকদের কোনো দায় নেই?
প্রশাসনের আনুকূল্য না পেলে ২০১৪ আর ২০১৮ সালের আনুষ্ঠানিকতার নির্বাচন যেমন সম্ভব হতো না, তেমনি আজকের বহু পতাকাবাহী হয়তোবা আমজনতার সারিতেই থাকতেন। শুধুমাত্র অর্থবিত্ত আর কৃপা ধন্য হয়ে যারা মার্কা পেয়েছিলেন তাদের প্রতিষ্ঠিত করতে যে প্রশাসন ভূমিকা রেখেছিল, সেই একই প্রশাসন যদি আপনাদের মর্যাদা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে তাতে আহাজারির কী আছে?
গণতন্ত্রের সংকটে যেমন রাজনীতিকরাই ভরসা, তেমনি জনপ্রতিনিধিরাই আমজনতার সুখ দুঃখের আশ্রয়স্থল। পাইক পেয়াদা সমৃদ্ধ আমাদের আমলাতন্ত্রের যে ধারকরা এখনো ভাই আর আপা সম্বোধনে বিব্রত বোধ করেন, বিনা অনুমতিতে দপ্তরে প্রবেশকে আইনত দণ্ডনীয় বলেই বিশ্বাস করেন, খাস কামরায় প্রবেশাধিকার দিতে ক্ষমতা আর কুলীনতাকেই প্রাধান্য দেন, সেই আমলাতন্ত্র কখনো রাজনীতি আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার পরিপূরক হতে পারে না।
প্রশাসনের নির্ভরতাকে শূন্যে নামিয়ে জনতার রায়ের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে, কাগুজে মর্যাদা নিয়ে যতই হাহাকার হোক, সত্যিকারের পদমর্যাদা দুরাশাই থেকে যাবে। উন্নয়নের নামে আমলাতান্ত্রিক গণতন্ত্র জনবিচ্ছিন্নতার পথকেই করবে আরও দীর্ঘায়িত।
মো. মাহমুদ হাসান ।। কলামিস্ট, গবেষক