লকডাউন শাটডাউন লেটডাউন
মিরপুর থেকে নিউ মার্কেট ‘গেটলক’ সার্ভিস বলে একটা সেবা ছিল, এখনো হয়তো আছে। বাসে উঠবেন, ঠিক জায়গায় নামিয়ে দেবে, সময় নষ্ট করবে না, ডাকাডাকি করে মাঝখানে কোনো যাত্রী তুলবে না, এই ছিল প্রতিশ্রুতি। দু’দিন না যেতে যেতেই ওয়াদার বরখেলাপ হয়, যাত্রীদের আস্থা ফেরত আনতে তারা কেউ গায়ে লিখত ‘বিরতিহীন গেটলক’; কেউ লিখত ‘সময় নিয়ন্ত্রিত গেটলক’; হাঁকডাকেও বলতো, এক্কেবারে গেটলক, ফিক্সড টাইম গেটলক—কিন্তু কাজে যেই সেই।
সংশয়ী এক যাত্রীকে নিশ্চিন্ত করতে চালকের এক সহকারী নাকি একবার বলেছিলেন, ‘খোদার কসম, গেটলক, স্যার’। এক গণমাধ্যমকর্মী বিষয়টাকে দৈনিকের এক স্লিপ করেছিলেন, সেই থেকে ছলনাপূর্ণ কিংবা ধোঁয়াশাভরা প্রতিশ্রুতিকে ‘খোদার কসম গেটলক’ বলাটা অনেকদিন চলেছিল ঢাকাতে।
‘লকডাউন’, ‘শাটডাউন’ ইত্যাদি শুনলে কৈশোরের সেই ‘খোদার কসম গেটলক’ এর কথাই মনে পড়ে। লকডাউনের সাথে শাটডাউনের মাত্রাগত পার্থক্যটা কী, লকডাউন লোকে মানতে চায় না বলে কি সেনাবাহিনী নামাবার হুমকি যুক্ত শাটডাউনের ঘোষণা এল? আমরা কেউই এগুলো নিয়ে খুব পরিষ্কার না।
শাটডাউনের ঘোষণা শুনে যাদের সাধ্য আছে তারা হুড়মুড় করে কেনাকাটা করছেন বটে, তারপরই খবর এল শাটডাউন আসবে সপ্তা শেষে। তিন দিন পর সেই শাটডাউন একই রকম থাকবে, নাকি ‘খোদার কসম গেটলকে’ পরিণত হবে, সেটাও কেউ বলতে পারছেন না। কিন্তু এই সম্ভাব্য শাটডাউনের মুখে দাঁড়িয়েও ঘটনাবলি খতিয়ে রাখা, আর কয়েকটা নতুন কথা যুক্ত করাটা আবশ্যক মনে করছি—
১. ভারতের সীমান্তে যখন মহামারির তুঙ্গ দশা, তখন আমাদের এই নীতিনির্ধারকরা সীমান্তকে বিচ্ছিন্ন করার তুলনামূলক বহুগুণ সহজ কাজটা করতে সমর্থ হলেন না কেন? এর ব্যর্থতায় কারও কি চাকরি গেছে? এই কাজটা না ভাবার ব্যর্থতায় কেউ পদত্যাগ করেছেন?
দেশটাকে শাটডাউন করার চেয়ে সহজ হতো না সীমান্ত বিচ্ছিন্ন করা, নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রবাসীদের আসতে দেওয়া এবং সীমান্তেই আরামদায়ক ও বাসযোগ্য ১০ দিনের সঙ্গ নিরোধের ব্যবস্থা করা? কাদের গাফিলতিতে আজ গোটা দেশ এত বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে?
ভারতের সীমান্তে যখন মহামারির তুঙ্গ দশা, তখন আমাদের এই নীতিনির্ধারকরা সীমান্তকে বিচ্ছিন্ন করার তুলনামূলক বহুগুণ সহজ কাজটা করতে সমর্থ হলেন না কেন?
২. সীমান্তের জেলাগুলো থেকে করোনা পরিস্থিতির নানান উদ্বেগজনক সংবাদ পাচ্ছি আমরা গণমাধ্যমে। হাসপাতালে জায়গা না থাকা, অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি, আইসিইউর স্বল্পতা, ওষুধের মজুদ ফুরিয়ে আসার আশঙ্কা ইত্যাদি। দেড় বছরের মহামারিকালে এবং মাস জুড়ে সীমান্তের মহামারির তুঙ্গ দশায় এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব কাদের ছিল? তারা কি রাজশাহী বা সাতক্ষীরার নিরপরাধ প্রাণহানির দায়িত্ব নেবেন? শাটডাউনের ক্ষতিপূরণ দেবে? নাকি তাদের হাতেই শাটডাউনেরও সিদ্ধান্তটা নেওয়ার এখতিয়ার?
৩. পরিস্থিতি আসলে কতটা আশঙ্কাজনক, তা বোঝার জন্য দরকার দৈনিক বিপুলসংখ্যক রোগীকে পরীক্ষার ভিত্তিতে শতকরা হার নির্ণয়। কেবল যাদের উপসর্গ আছে, তাদের পরীক্ষা করলে, সংস্পর্শে যারা ছিলেন তাদের পরীক্ষার মতো ব্যবস্থা না থাকলে উপসর্গহীনদের মাধ্যমে রোগের বিস্তার বাড়তেই থাকবে।
দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা সীমান্তের জেলাগুলোতে কেন এখনো এত কম? ২৩ জুনের বিবিসি অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষা করা হয়েছে ২৮ হাজার ২৫৬টি। উদাহরণ হিসেবে তুলনীয়, দৈনিক আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে করোনার তুঙ্গ অবস্থায় গত পাঁচ জুন পশ্চিমবঙ্গে ‘স্বাস্থ্য দফতরের হিসাব অনুযায়ী, ১ দিনে করোনা পরীক্ষা হয়েছে ৭২ হাজার ৬৭২টি’।
বাংলাদেশে এত সামান্য সংখ্যক পরীক্ষা নিয়ে কিভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছেন এই নীতিনির্ধারকরা? যেখানে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক! ভয় পাওয়া জরুরি, কিন্তু এইসব পদক্ষেপে বিবেচক হিসাব নিকাশের বদলে কি আমরা অবিবেচকদের আতঙ্কিত অস্থির কাজকর্ম দেখতে পাচ্ছি না?
৪. একই আমলাতন্ত্র, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী এবং শাটডাউন দিয়ে কি আক্রান্ত জেলাগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব? অতীতে কেন আক্রান্ত জেলাগুলো বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা সফল হয়নি, সেটা নিয়ে কোনো মূল্যায়ন, আত্মসমালোচনা বা পর্যালোচনা কি আছে সরকারের?
৫. ঢাকার বস্তিবাসীর একটা বড় অংশের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, আইসিডিডিআর’বি যে গবেষণা করেছে তার তাৎপর্য কী? এটা যদি তাদেরকে করোনা মুক্ত রাখে, তাহলে কেন শাটডাউনের নামে, লকডাউনের নামে তাদেরকে কষ্ট দেওয়া? ঢাকার অন্যান্য শ্রেণির জনগোষ্ঠীর মাঝে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না, তার জরিপ কেন হচ্ছে না? যদি হয়ে থাকে, কেন তাদেরকে আটকে রাখা হবে? যদি এই অ্যান্টিবডি তেমন কার্যকর নাও হয়, তাহলে সেটাও কেন জানানো হচ্ছে না? আমরা এগুলোর তাৎপর্য বিষয়ে কেন অন্ধকারে আছি? গবেষণা কোথায়?
৬. পোশাক শিল্প কেন খোলা থাকবে? পোশাক শ্রমিকদের করোনা হয় না? সম্ভাবনা হিসেবে যদি মেনেও নেই, করোনার পুরনো ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশের সব স্তরে ছড়ায়নি, জীবাণুর সাথে রোগীর অভ্যস্ততা কিংবা আলো-বাতাসপূর্ণ এলাকা কিংবা আবহাওয়াগত তারতম্যে—যদিও এই সম্ভাবনাপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে তেমন গবেষণাও হয়নি।
ডেল্টা নামে খ্যাত করোনার ভারত থেকে আগত ভ্যারিয়েন্টটি তো পশ্চিমবঙ্গের পর বাংলাদেশেরও মফস্বলেই রাজত্ব বিস্তার করছে। বাকি দেশবাসী যদি ঝুঁকিতেই থাকেন, পোশাক শিল্পের বেলাতে সেটা কেন মান্য করা হচ্ছে না?
৭. দুর্ভিক্ষের সময় রফিক আজাদ যেমন ‘ভাত দে হারামজাদা’ দাবি করে কবিতা লিখেছিলেন, টিকা চেয়ে প্রায় তেমন দাবি তোলার সময় চলে যাচ্ছে। টিকা নেই কেন? নির্লজ্জ লোকগুলো কেন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন না, আগাম অর্থ দেওয়ার পরও আমরা কেন টিকা থেকে বঞ্চিত? এই প্রক্রিয়ায় টিকা দেওয়া হলে কত বছরে আমরা টিকাকরণ সম্পন্ন করব?
টিকায় কারা প্রাধান্য পাবেন? শিক্ষকদের টিকা দিয়ে কেন দেশের স্থিতিশীল স্থানগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? কেন গণপরিবহন শ্রমিক, দোকানকর্মী, শিল্প শ্রমিকদের টিকা পাওয়ার বেলাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না?
৮. প্রচুর পরীক্ষা না করে আসলেই কি বলা সম্ভব ঢাকাসহ দেশের বাকি এলাকাগুলোতে গত এপ্রিল-মে মাসের চাইতে এখন করোনা পরিস্থিতি কতটা ভালো বা মন্দ? কোনো গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যান না দিয়ে গোটা দেশকে একসাথে বারংবার ‘লেটডাউন’ করাটা কীভাবে যৌক্তিক?
দুর্ভিক্ষের সময় রফিক আজাদ যেমন ‘ভাত দে হারামজাদা’ দাবি করে কবিতা লিখেছিলেন, টিকা চেয়ে প্রায় তেমন দাবি তোলার সময় চলে যাচ্ছে। টিকা নেই কেন?
যখন বরগুনায় করোনা রোগীর সংখ্যা কম, যখন নেত্রকোনায় কম বা ঢাকাতে কম, তখন কেন দেশের সেই সব এলাকাকেও সম্পূর্ণ অচল করে দিয়ে মানুষের ক্লেশ, ভোগান্তি, অনাহার, কর্মহীনতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল? মহামারির অর্থনৈতিক অভিঘাত কি দ্বিগুণ হয় না, যখন একটা গড়পড়তা নির্বোধ সিদ্ধান্ত সকল অঞ্চলের ওপর সমানভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়?
৯. শাটডাউনের সময়ে ঢাকাসহ সারাদেশের সেই বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্যের সংস্থান কারা করবে, যাদের সঞ্চয় নেই এবং যারা দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল? এই মানুষেরা পেটের জ্বালায় রাস্তায় নামলে তাদের উপর বাহিনীগুলোকে প্রয়োগ করা হবে? সাবধান না হলে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দেশজুড়ে মারাত্মক সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রশ্ন হলো, মানুষকে খাবার না দেওয়ার কারণে যদি লকডাউন ব্যর্থ হয়, তখন মানুষ যদি খাদ্যের সন্ধানে বাইরে যেতে বাধ্যই হয়, শাটডাউন সত্ত্বেও সেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্যও কি মানুষকেই দায়ী করা হবে?
১০. মানুষকে নিয়ে এমন জুয়া খেলা চলছে, সেই হিসাব কবে, কোনদিন হবে? দুনিয়ার মাঝে অন্যতম কম মাথাপিছু হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্স ইত্যাদি অবকাঠামো থাকার পরও বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো মহামারির মাঝে নজিরহীন দুর্নীতির যে অভিযোগগুলো আমরা দেখলাম, জুয়ার দান আমাদের বিপক্ষে গেলে মহামারির দংশনটাও কি জনগণের দরিদ্রতর অংশটাকেই বহন করতে হবে না?
সত্যি যদি আমাদের দেশে ইতালি, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বা ব্রাজিলের মতো উচ্চহারে মহামারির সংক্রমণ ঘটে—যার ভগ্নাংশও আমাদের দেশে এখনো ঘটেনি—কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে? এই জুয়ার খেলা তখনো অব্যাহত রাখা যাবে?
এই সব প্রশ্নের উত্তর কেউ দেবে না, আদায় করার একটা রাস্তা অবশ্য আছে। লকডাউন, শাটডাউন, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের লেটডাউন, সংসারের খরচা কাটডাউন ইত্যাদি নতুন নতুন বিদেশি শব্দের সাথে দেশবাসী যেমন পরিচিত হচ্ছেন, তেমনি আর একটা পুরনো শব্দ আছে ‘ডাউন উইথ’, সেই পথ না ধরে এমন প্রশ্নের উত্তর কোনো কালে মেলেনি।
ফিরোজ আহমেদ ।। প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং রাজনীতিক