কওমি মাদরাসা: শিশুদের মনস্তত্ত্ব, সংকট ও সমাধান
জ্ঞান দিতে চাইলে সেটা দেওয়াই যায়। কিন্তু পরের সন্তানকে চাইলেই রাখা যায় না। আবার কেউ চাইলেই রাখতে পারে না। অর্থাৎ নিজের সন্তানকে রাখার জন্য যতটা দায়িত্বের ব্যাপার আছে পরের সন্তানকে রাখার ক্ষেত্রে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হয়। একটা আফসোস নিয়ে লেখাটা শুরু করতে হচ্ছে।
২০২১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই একটা দিনেই আমরা দেখেছি হেফাজতে ইসলাম রাস্তায় প্রতিবাদের নামে শিশুদের ব্যবহার করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কী বুঝে এসব করেছে? তাদের যারা ব্যবহার করেছে তারা কী জানে কতটা অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে এই শিশুদের? শিশুদের বাবা-মা কী জানে সহিংসতার মাঝে তাদের সন্তানকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে? সেই জায়গায় ভাবতে গিয়ে অনেক কিছুই পেলাম যেখানে পরিবর্তন জরুরি। সেই পরিবর্তন পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও প্রয়োজন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যে তাণ্ডব আমরা দেখলাম তাতে মূল নেতৃত্ব দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এদের মূল ভিত্তি কী? এদের মূল ভিত্তি হচ্ছে কওমি মাদরাসার ছাত্ররা। কওমি মাদরাসার যে ইতিহাস সেটা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনই বলা যেতে পারে। সমস্যা হচ্ছে কওমি মাদরাসার যে সংস্কৃতি, সেই জায়গায় ভালোবাসাহীনতার একটা জায়গা রয়েছে।
বিশেষত বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলো যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি বা আমলে নেই তাহলে দেখব যে গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত শত কওমি মাদরাসায় আসলে বাবা-মা’রা তাদের সন্তানদের ফেলে/রেখে যান। অভাবের তাড়নায় বলুন বা অন্য কোনো সীমাবদ্ধতার কারণেই বলুন তাদের বাচ্চাদেরকে ইসলামের শিক্ষা দেওয়ার নামে মাদরাসায় দিয়ে আসে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যে তাণ্ডব আমরা দেখলাম তাতে মূল নেতৃত্ব দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এদের মূল ভিত্তি কী? এদের মূল ভিত্তি হচ্ছে কওমি মাদরাসার ছাত্ররা।
বাংলাদেশে অবস্থিত একটি কলেজ যেমন একটা ক্যাডেট কলেজ অথবা একটা বিশ্ববিদ্যালয় যার আবাসিক হলে ছাত্রছাত্রীরা থেকে পড়াশোনা করে সেই জায়গাতেও কিছু ন্যূনতম গুণগত মান বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা আইনগতভাবেই আছে। তবে তা কতটা বজায় রাখা হয় সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো, সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বলতে চাই, কওমি মাদরাসায় কোনো বাবা-মা তার সন্তানদের যখন ‘ফেলে/রেখে যান’ তখন সেই সন্তান কোন পরিবেশে তার শিক্ষক বা ওস্তাদের সঙ্গে দিনাতিপাত করছেন, থাকছেন বা শিখছেন সেটা দেখার মতো কোনো তাগিদ আমরা অনুভব করি না। সেটা দেখার মতো কোনো সংস্থাও আমাদের দেশে নেই এখনো পর্যন্ত। যার কারণে আগামীকাল আমি চাইলেই বলতে পারি যে একটা কওমি মাদ্রাসা চালু করব।
অনেকের মনে হতে পারে যে এই আইনগত বা পর্যবেক্ষণ কেন জরুরি? একটু অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, বিভিন্ন সময় সংগঠিত হেফাজতে ইসলামের যে তাণ্ডব সেখানে কওমি মাদরাসার ছাত্রদের বলা হয় যে, ‘তোমাদের খেতে দেব না যদি তোমরা আমাদের সঙ্গে এসে প্রতিবাদ না করো।’ এগুলো করতে পারছে কারণ তারা জানে যে তাদের কেউ পর্যবেক্ষণ করছে না।
সুতরাং আমি মনে করি আজকের এই দিনে মামুনুল হক, কাসেমী, মুফতি ইজহারসহ আরও অনেকে যারা গ্রেফতার হয়েছে তার মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামের সংগঠিত হওয়ার যে জায়গাটি আছে সেটিকে স্তিমিত করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, হেফাজতের মতো দানবীয় শক্তির দানবিক ব্যবহার চিরকালের জন্য থামিয়ে দিতে হয় তাহলে কওমি মাদরাসার প্রথম ভালোবাসাহীনতার যে জায়গাটা আছে সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
অর্থাৎ চাইলেই একজন বাবা-মা তার সন্তানকে কোথাও দিয়ে যাবে এটা আমরা হতে দিতে পারি না। একজন বাবা-মায়ের যদি তার সন্তানকে শিক্ষাগ্রহণের জন্য কোনো আবাসিক ব্যবস্থাপনায় রাখতে হয় সেক্ষেত্রে সেই বাবা ও মায়ের তার সন্তানের থাকার জায়গার বিষয়ে সচেতন ধারণা থাকতে হবে। অর্থাৎ তাদের সন্তান সেখানে থাকতে পারবে কি না, নিরবচ্ছিন্নভাবে খাদ্য পাবে কি না, নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মাঝে জীবনধারণ করতে পারবে কি না, বাড়ন্ত সময়ে শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তার জায়গা সুনিশ্চিত কি না এগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
ঠিক একইভাবে সরকারের পক্ষ থেকেও এই বিষয়ে যিনি কওমি মাদ্রাসা চালাতে চান বা স্থাপন করতে চান তাকে ছাড়পত্র বা অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আজকে এই জায়গাটা যদি আমরা একটা ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে পারি তবে আমার সন্তানকে ‘খেতে দেওয়া হবে না’ অথবা ‘মারা হবে’ বলে ভয়ভীতি দেখিয়ে যেকোনো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করানো যাবে না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইউটিউব বিশ্লেষণ করলে সেখানে বিভিন্ন সভা বা ওয়াজের বক্তব্য ইদানীং দেখা যায়। অপেক্ষাকৃত অসচেতন জনগোষ্ঠীকে মোহিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে সেই সভাগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছে ওই মাদরাসাগুলোর প্রাঙ্গণে। এই মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হওয়া এসব সভা বা ওয়াজে বাচ্চাদের ও অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়।
বহিরাগতদের পাশাপাশি ওই মাদরাসায় অবস্থিত এই কোমল প্রাণ ছেলেমেয়েদের অধিকাংশ সময়ে এইসব বাধ্যতামূলক করে দেওয়া কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ না করলে নির্যাতনের শিকারও হতে হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায় সেই শিশুদের খাওয়া দেওয়া হয় না বা শারীরিক নির্যাতন করা হয়। অনেক সময় মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন নির্যাতনের শিকারও হয়ে থাকে এই শিশুরা। যদি এই শিশুদের কেউ ওয়াজে যাওয়ার জন্য অস্বীকৃতি জানায় তবে তাদের উপর নানা পর্যায়ে এই অত্যাচারগুলো হয়ে থাকে যাদের ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে ‘আন্ডার ডিউরেস দে আর কমপেল্ড টু পার্টিসিপেট’ (Under Duress they are compelled to participate)।
খাওয়া থেকে শুরু করে শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন এবং বহুলাংশে বহুক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের শিকার থেকে রক্ষা পেতে ওয়াজে উপস্থিত হওয়া এই কোমলমতিদের মাঝে দেখা যায় ‘অর্কাস্ট্রেটেড রেসপন্স’ (Orchestrated Response)। অর্থাৎ ভেতরে যতটুকু না সাহস আছে তার চাইতে বেশি ভাব প্রকাশ করা এবং কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতার ভাব প্রকাশ করা।
বিভিন্ন সময় সংগঠিত হেফাজতে ইসলামের যে তাণ্ডব সেখানে কওমি মাদরাসার ছাত্রদের বলা হয় যে, ‘তোমাদের খেতে দেব না যদি তোমরা আমাদের সঙ্গে এসে প্রতিবাদ না করো।’ এগুলো করতে পারছে কারণ তারা জানে যে তাদের কেউ পর্যবেক্ষণ করছে না।
কিছুক্ষেত্রে দেখা যায় ওয়াজে বক্তারা বলে, কথা বলেন না কেন? তখন অনেকে সমস্বরে সুর মেলায়। এটা হচ্ছে ‘অর্কাস্ট্রেটেড রেসপন্স’। বেশিরভাগ সময় এই বিষয়গুলো ঘটছে সেই কওমি মাদরাসাগুলোর মধ্যেই। একজন অসচেতন অন্ধ ব্যক্তি যার ওই পরিমাণ জ্ঞান বা শিক্ষা নেই তার পক্ষে এটা নির্ণয় করা একটু কষ্টসাধ্য। তার পক্ষে এটা বোঝাও কষ্টসাধ্য যে, এখানের ছেলেমেয়েরা বাইরে থেকে এসেছে নাকি ওই কওমি মাদরাসায় থাকে। সাধারণ মানুষ মোহিত হচ্ছে এই সকল ভীতসন্ত্রস্ত, বিভ্রান্ত ছাত্রদের অর্কাস্ট্রেটেড রেসপন্স দেখে।
মানুষের স্বভাব বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায় যখন এক জায়গায় সমবেত মানুষের মাঝে একসঙ্গে সমর্থন দিয়ে বসে তখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল মনের মানুষেরাও তাকে সমর্থন দিয়ে দেয়। এই সুযোগটাই নিচ্ছে সেই ওয়াজে বা সভাতে। সুতরাং অর্কাস্ট্রেটেড রেসপন্স যাতে শোষণের মাধ্যমে না করা যায়, অর্কাস্ট্রেটেড রেসপন্স যাতে ভয় ভীতি দেখিয়ে না করা যায় সেটা দেখা এবং সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়াও সরকারের অন্যতম দায়িত্ব।
সুতরাং আলেম ওলামাদের ভুল ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে যেমন প্রগতিশীল হিসেবে আমার অবস্থান থাকবে ঠিক একই সঙ্গে মানুষ যাতে হতাশায় নিমজ্জিত না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে সরকারকে।
ঠিক একই ভাবে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার যে মহৎ উদ্দেশ্যে কওমি মাদরাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য ভোকেশনাল ট্রেনিং ও অন্যান্য ব্যবস্থা থাকা দরকার। পাশাপাশি এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে কারো বাবা-মা চাইলেই তার সন্তানকে যেকোনো স্থানে ফেলে যেতে পারেন না।
কোনো সন্তান যখন দীর্ঘদিন ধরে তার বাবা-মা’র সংস্পর্শ ছাড়া থাকে তখন তার ভেতর একটি ক্ষোভ ও ঘৃণাবোধের জাগরণ ঘটে এবং তাকে খুব সহজেই এসব ধর্ম ব্যবসায়ীরা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তাদেরকে পরিচালিত করতে পারে।
অর্থাৎ কওমি মাদ্রাসাগুলোকে একটা আধুনিক কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে যেখানে রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে শিশুর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে। এক্ষেত্রে বাবা-মাকেও বোঝাতে হবে তার সন্তানের নাগরিক অধিকার যেন নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে তারা সন্তানকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে না দেয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সময়ে বাংলাদেশ যে তাণ্ডব দেখেছে তা থেকে মুক্ত হতে হলে ভালোবাসাহীনতার যে সংস্কৃতি এখনো বিরাজমান তাকে সমূলেই উৎপাটন করতে হবে।
দ্রুত কওমি মাদরাসায় যে শিশুরা পড়ালেখা করে তাদের সুরক্ষার জন্য পরিষ্কার আইন হওয়া প্রয়োজন। কারণ এই শিশুরা তো আর বাংলাদেশের বাইরের কেউ নয়। আমার প্রস্তাবনা হলো, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের যাত্রা আমাদের সেই জায়গা থেকে শুরু হতে হবে।
আজ থেকে শত শত বছর আগে কওমি মাদরাসার যে সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছিল তা নিশ্চয়ই ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে প্রাসঙ্গিক নয়। পাশাপাশি মানবাধিকারের জায়গাগুলোও ততটা পরিষ্কার ছিল না।
দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নিশ্চিতভাবে। সেই জায়গায় বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের একটি অংশ ভালোবাসাহীনতার যে সংস্কৃতি তাতে নিমজ্জিত হয়ে বড় হবে আর আরেকটি অংশের শিশুরা বাবা-মা ও স্বজনদের ভালোবাসা নিয়ে বেড়ে ওঠতে থাকে তবে সেখানে একটি বৈপরীত্য দেখা যায়। এই বৈপরীত্য যদি বিরাজমান থাকে তবে যতই অগ্রসর আমরা হই না কেন ভালোবাসাহীনতায় নিমজ্জিত সেই শিশুদের জঙ্গি করে, ক্ষুদ্ধ করে ও সংক্ষুব্ধ করে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু ভালো তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া যাবে।
রাশেক রহমান ।। আওয়ামী লীগ নেতা